গডফ্রে হ্যারল্ড হার্ডি সংক্ষেপে জি এইচ হার্ডি গণিতের জগতে একটা শ্রদ্ধেয় নাম। ওনাকে ভারতীয়রা বিশেষ করে মনে রেখেছে শ্রীনিবাস রামানুজনের বিস্ময়কর প্রতিভাকে বিশ্বের সামনে তুলে ধরেছিলেন বলে। তবে এই লেখার বিষয়বস্তু তার গণিত বা রামানুজন নয়, তার ক্রিকেট প্রেম।
হার্ডি নিজেও মোটামুটি ভালোই ক্রিকেট খেলতেন যদিও বেশি পছন্দ করতেন খেলা দেখতে এবং তাই নিয়ে আলোচনা করতে। শুরুতে জ্যাক হবস ছিলেন তার প্রিয় ক্রিকেটার এবং যখনই কোনো গণিতজ্ঞ বা পদার্থবিদকে তার মনে ধরত, যেমন নিউটন, আর্কিমিডিস বা গাউস, তিনি তাদের ‘হবসের ক্লাস’-এ বসিয়ে সম্মানিত করতেন।
পরবর্তী কালে অবশ্য জনৈক ডন ব্র্যাডম্যানের ব্যাটিং দেখে হার্ডি এতটাই প্রভাবিত হয়েছিলেন যে তিনি এই তিনজনকেই ব্র্যাডম্যানের ক্লাসে ওঠার প্রমোশন দেন। তার মতে ব্র্যাডম্যানের ব্যাটিং বা এই তিনজনের গাণিতিক প্রতিভার চেয়ে উন্নততর কিছুর তিনি ক্রিকেট বা গণিতের ক্ষেত্রে কল্পনা করতে পারেন না।
নিজের বন্ধু বাছার ক্ষেত্রে ক্রিকেট একটা গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করত। তার বন্ধু স্নো লিখেছেন, ‘যৌবনে ক্রিকেটের পেছনে অনেকটা সময় নষ্ট করার একটা বড়সড় ভুমিকা ছিল আমার সঙ্গে হার্ডির বন্ধুত্বের।‘
গণিতের মতো ক্রিকেটের ওপরও বেশ কিছু ম্যাক্সিম (নিয়ম বা ব্যবহারিক সত্য) আবিষ্কার করেছিলেন হার্ডি। তার মধ্যে দুটো আজও বেশ জনপ্রিয় –
- ক্রিকেট হচ্ছে একমাত্র খেলা যেখানে তোমাকে বিপক্ষের ১১ জন প্লেয়ারের সঙ্গে সঙ্গে নিজের দলের ১০ জনের বিরুদ্ধেও খেলতে হয়।
- যদি তুমি প্রথমে ব্যাটিং করার ব্যাপারে নার্ভাস হও, সেক্ষেত্রে তোমার পার্টনারের তাড়াতাড়ি আউট হয়ে যাওয়ার মতো আর কোনকিছুই তোমার আত্মবিশ্বাস ফিরে পেতে সাহায্য করতে পারবে না।
জীবনের শেষ কটা দিন নিজের বোন গেরট্রুডের তত্বাবধানে কাটিয়েছিলেন হার্ডি যার প্রধান কাজ ছিল খবরের কাগজ থেকে বা ম্যাগাজিন থেকে ক্রিকেট বিষয়ক লেখা বা স্কোর কার্ড পড়ে শোনানো। সেই বোনের একটা চোখ ছিল পাথরের, চোখটি শৈশবে হার্ডির ব্যাটের আঘাতে নষ্ট হয়ে যায় (অবশ্যই সেটি অনিচ্ছাকৃত আঘাত ছিল)।
হার্ডি ক্রিকেটে সেই সৌন্দর্য এবং নিয়মের প্রতি আনুগত্য খুঁজে পেতেন যা গণিতের বিশেষত্ব। ঈশ্বরের সঙ্গে গোলমেলে সম্পর্ক ছিল হার্ডির। তিনি খেলা দেখার জন্যে মাঠে যাওয়ার সময় হাতে ছাতা নিয়ে বেরোতেন এবং বেশ কিছুটা ঘুরপথে মাঠে ঢুকতেন।
উদ্দেশ্য – ঈশ্বর যাতে বুঝতে না পারেন হার্ডি খেলা দেখতে যাচ্ছেন; সেক্ষেত্রে নির্ঘাত বৃষ্টি ফেলে খেলার বারোটা বাজিয়ে দেবেন ভদ্রলোক। মাঠের মধ্যেও নিজের প্রিয় জায়গা দখল করার সময় তার সঙ্গী থাকত ছাতা, সোয়েটার, কিছু গণিতের পেপার – এগুলোকে হার্ডি নিজের ‘Anti God Battery’ বলতেন।
হার্ডির জীবনে ক্রিকেটের গুরুত্ব সম্বন্ধে কিছুটা ধারণা তার নতুন বছরের সঙ্কল্পের লিস্ট থেকে পাওয়া যায়। লিস্টটা ছিল অনেকটা এইরকম –
- রেইম্যানের হাইপথেসিস প্রমাণ করা
- গুরুত্বপূর্ণ ক্রিকেট ম্যাচে অসাধারণ পারফর্ম করা
- ঈশ্বর যে নেই সেটা প্রমাণ করা
- প্রথম মানুষ হিসবে মাউন্ট এভারেস্ট আরোহণ করা
- সোভিয়েত রাশিয়া, জার্মানি এবং গ্রেট ব্রিটেনের প্রথম রাস্ত্রপতি হওয়া এবং
- মুসোলিনিকে শেষ করা
বেশ কয়েকটি একাদশ নির্বাচন করেছিলেন হার্ডি। সেগুলিতে স্থান পেয়েছিলেন হবস এবং ফেন্ডারের মতো ক্রিকেটার, আইনস্টাইন, আর্কিমিডিসের মতো বিজ্ঞানী, স্পিনোজার মতো দার্শনিক, এছাড়া ঈশ্বর এবং যীশু। এগুলি ঠিক কীসের দল ছিল সেটা নিয়ে ইতিহাসের অধ্যাপকরা কিছুটা ধন্ধে রয়েছেন আজও।
বারট্রান্ড রাসেলের খুব কাছের বন্ধু ছিলেন হার্ডি। তিনি একবার রাসেলকে বলেন, ‘আমি যদি যুক্তির দ্বারা প্রমাণ করতে পারি যে আগামী পাঁচ মিনিটের মধ্যে তুমি মারা যাবে এবং সত্যি সত্যিই যদি তাই ঘটে, সেক্ষেত্রে তোমার মৃত্যুতে আমি কিছুটা দুঃখ পাবো ঠিকই, কিন্তু আমার প্রমাণটা যে সঠিক ছিল তার আনন্দে সেই দুঃখের ভার অনেকটাই লাঘব হবে।’ বুঝুন!
বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ কেয়ন্স বলেছিলেন, হার্ডি যতটা মনোযোগ দিয়ে ক্রিকেট স্কোর দেখেন, ততটা মনোযোগ তিনি দিনে আধ ঘণ্টাও স্টক মার্কেটের ওপর দেন, তাহলে তিনি নি:সন্দেহে ধনী হয়ে উঠবেন। কিন্তু সত্যিকারের ভালোবাসার বস্তুকে মানুষ কবেই বা অর্থের বিনিময়ে ত্যাগ করেছে?
হার্ডি বলেছিলেন, যদি তিনি জেনে যান যে আজকে তার মৃত্যু ঘটবে, সেক্ষেত্রেও তিনি যাওয়ার আগে ম্যাচের স্কোরকার্ড জেনে যেতে চাইবেন। মৃত্যুর দিন অস্ট্রেলিয়া এবং ভারতের ম্যাচ নিয়ে জীবনের শেষ আলোচনা করেন হার্ডি। সুতরাং এই কথা বলা যেতে পারে যে তার শেষ ইচ্ছে পূর্ণ করেছিলেন ঈশ্বর। সেই ঈশ্বর যার অনস্তিত্ব প্রমাণ করতে চেয়েছিলেন তিনি।