যখন ক্রিকেট নিয়ে সামান্য উৎসাহ আরম্ভ হল তখন থেকেই কপিল দেব বলতে আমি মোটামুটি অজ্ঞান। বিশ্বকাপ জয় তো আছেই। তার সঙ্গে ব্যাটে–বলে অসম্ভব দাপট, ফিল্ডিং থেকে আরম্ভ করে মাঠের মধ্যে হাঁটা চলার মধ্যেও এক অসাধারণ আত্মবিশ্বাস এবং লাবণ্য। এই মানুষটাকে ছেড়ে যে অন্য কারও ভক্ত হওয়া সম্ভব সেটাই চিন্তা করে কেমন যেন লাগত।
তবে কিছু ক্রিকেট প্রাজ্ঞ আমাদের মতো উৎসাহীদের মাঝে মধ্যে লাগাম দেওয়ার চেষ্টা করতেন। উল্লেখ করতেন ইয়ান বোথাম নামের এক সুপারম্যানের নাম যে নাকি বিশেষ করে ব্যাটিংয়ে কপিলের চেয়ে কয়েক যোজন এগিয়ে। বিশেষ করে একজনের কথা মনে আছে জিনি হাসতে হাসতে বলেছিলেন, কপিল তো আনতাবড়ি ব্যাট চালায়।
মুষড়ে পড়েছিলাম খুব। কিন্তু তারপর রেকর্ড দেখলাম। অ্যাশেজে ঐতিহাসিক পারফরম্যান্স। ভারতের বিরুদ্ধে সিরিজে ১০০র ওপর গড়। সব মিলিয়েও মোট রান ও গড়ে কপিলের চেয়ে অনেকটাই এগিয়ে। মনে মনে স্বীকার করে নিয়েছিলাম ভদ্রলোকের কথা। ঠিক আছে, ব্যাটিঙে না হয় কপিল বোথামের পরেই থাকবেন। অদ্বিতীয় হয়েও দ্বিতীয়।
তারপর টেমস এবং গঙ্গা দুই নদীর মধ্যে দিয়েই বেশ কিছুটা জল গড়িয়েছে। বথামের ক্যারিয়র নিম্নগামী হয়েছে, অসাধারণ ভাবে উঠে এসেছেন ইমরান এবং হ্যাডলি। কপিল এখনও লড়ছেন কিন্তু কখনও কখনও দারুণ অসহায় লাগত তাঁকে দেখে। হয়ত কপিলেরই অসহায়ত্ব সংক্রামিত হত আমাদের মধ্যেও।
আসলে ১৯৮৩ সালে যে স্বপ্ন দেখতে সে শিখিয়েছিল সেটাকে ম্যাচের পর ম্যাচ, সিরিজের পর সিরিজ একার হাতে বাস্তবে পরিণত করা সম্ভব ছিল না কোনো মানুষের পক্ষেই। সুপারম্যানের পক্ষেও।
কিন্তু, মাঝে মধ্যে ঝিলিক দেখা যেত। পাটা পিচে ইনিংসে ৮ উইকেট, ফলো অনের মুখে দাঁড়িয়ে পরপর চারটে ছক্কা, ডোনাল্ড নামের বিশ্বত্রাস ফাস্ট বোলারকে প্রতি আক্রমণ, পরপর তিনটে বলে বোর্ডার এবং ডিন জোন্সকে নিজের আউট স্যুইঙ্গের ছন্দে নাচতে বাধ্য করা, ফলো থ্রু’তে বল তুলে নন স্ট্রাইকার এন্ডে রান আউট ঘটানো, ছুটে এক’কে দুই, দুই’কে তিন রানে নিয়মিত কনভার্ট করা – এসব বস্তু অন্য কারও কাছে একসঙ্গে পাওয়ার কথা কল্পনাও করা যেত না। এখনও যায় না।
যাই হোক, লেখা আরম্ভ করেছিলাম বথামের ব্যাটিং নিয়ে, সেই প্রসঙ্গেই ফিরে আস যাক। কিছুদিন আগে চারজন অলরাউন্ডার নিয়ে একটা সিরিজ লিখেছিলাম। তখন একটা অদ্ভুত ব্যাপার চোখে পড়ল। সেই যুগের সবচেয়ে শক্তিশালী দল, শুধু সে যুগেরই বা কেন লিখছি, সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ দলের বিরুদ্ধে বোথামের অত্যন্ত সাধারণ রেকর্ড।
ব্যাটে – বলে, দুটোতেই। বোলিঙে তাও তিনবার ইনিংসে পাঁচ উইকেট আছে কিন্তু ব্যাটিঙে কুড়িটা টেস্ট খেলে হাইয়েস্ট স্কোর মাত্র ৮১, গড় ২১.৪১। অথচ লিলি, হ্যাডলি, কপিলদের বিরুদ্ধে বেশ কিছু বড় ইনিংস আছে বথামের। সুতরাং তিনি ফাস্ট বোলিং খেলতে পারতেন না এই বদনাম কেউ দেবে না। নাকি দেবে?
প্রথমে মনে হল ঘটনাটা কাকতালীয়। কপিলও যেমন নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধে টেস্টে সফল নন একেবারেই। কিন্তু একদিনের ম্যাচে সেই খামতি পুষিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু বথাম পারেন নি। পঁচিশটা একদিনের ম্যাচে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে বথামের মাত্র একটা পঞ্চাশ, গড় ১৯.০৪।
২০টি টেস্ট এবং ২৫টি একদিনের ম্যাচকে কোনমতেই insignificant number বলা যাবে না। সুতরাং কিছু একটা সমস্যা ছিলই। কিন্তু সেক্ষেত্রে লিলির বিরুদ্ধে সাফল্যের কী ব্যাখ্যা দেব? আমার একটা থিয়োরি আছে। অন্যদের ক্ষেত্রে দলে একটা জেনুইন পেসার থাকায় তাদের স্পেল খেলে দিলেই বেশ কিছুক্ষণের জন্যে নিশ্চিন্ত থাকতে পারতেন বোথাম।
ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে সেই সুযোগ ছিল না। চারটে দুরন্ত ফাস্ট বোলার একের পর এক ক্রমাগত শক্ত পরিক্ষার মুখে ফেলত তাঁকে। এবং সেই পরিক্ষায় তিনি পাস করতে পারেন নি। তবে এই থিয়োরি পুরোপুরি সঠিক কিনা সেটা বোঝা যেত যদি দেখতে পেতাম বথাম শুধু লিলি ব হ্যাডলির বলে কত রান করেছেন। এখানে লক্ষণীয় যে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে তার দুটো সেঞ্চুরি সেই দুটো ম্যাচে যেগুলোতে ইমরান-সরফরাজ খেলেন নি।
শুধু একবার ভেবে দেখুন – যদি জানতে পারেন ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে সানির গড় ৬৫র জায়গায় ৩৫, সেক্ষেত্রে তার মাহাত্ম্য (সেই মাহাত্ম্য ঠিক কি ভুল সেটা অন্য আলোচনা) কোথায় গিয়ে দাঁড়াত?
এখানেই বোথামকে টপকে যান দেব সাহেব। ১৯৮২-৮৩ সিরিজে ওয়েস্ট ইন্ডিজের মাটিতে একটি সেঞ্চুরি ও একটি হাফ সেঞ্চুরি সহ ২৫৪ রান করেন, গড় ৪২.৩৩। রবার্টস, হোল্ডিং, গারনার এবং মার্শাল – ক্রিকেট ইতিহাসের সবচেয়ে বিধ্বংসী পেস আক্রমণ ফুল ফোর্সে অপারেট করছিল সেই সিরিজে।
ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে ২৫ টেস্টে ৩টি সেঞ্চুরি এবং ৪টি হাফ সেঞ্চুরি সহ ৩০.৮৩ গড়ে ১০৭৯ রান করেছেন কপিল। একদিনের ম্যাচে গড় কিছুটা কম হলেও (২৪.০৬) বোথামের চেয়ে অনেকটাই বেশি। এর মধ্যে রয়েছে দুটো দুরন্ত ইনিংস – বারবিসে ৩৮ বলে ৭২ এবং নাগপুরে ৬৪ বলে ৮৭। অর্থাৎ বোর্ডের পরীক্ষায় বথামের মার্কস বেশি হলেও, জয়েন্টের পরীক্ষায় কপিল এগিয়ে।
অথচ কপিলের কপাল দেখুন – ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে একটা পারফর্মেন্সেরও ভিডিও রেকর্ড খুঁজে পাবেন না। যা কিছু আছে সেই ইংল্যান্ড কিংবা অস্ট্রেলিয়ার মাঠের ম্যাচগুলোর। সাধে হরপ্পা আর মহেঞ্জোদারোর জন্যে আমাদের সাহেবদের অপেক্ষা করতে হয়েছিল! তাই বথামের অ্যাসেজের যেখানে কাঁড়ি কাঁড়ি ভিডিও মজুদ, সেখানে কপিলের ৯/৮৩ বা হারিকেন ইনিংসগুলির কোনো চিহ্ন খুঁজে পাওয়া যায় না।
এছাড়াও আছে স্ট্রাইক রেট – বথামের চেয়ে অনেকটাই বেশি, ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে তো বটেই, সামগ্রিক ক্যারিয়র জুড়েও। টেস্ট এবং একদিনের ম্যাচ, দুটোতেই। অর্থাৎ যে যুক্তিতে ভিভ তার চেয়ে বেশি গড়ে রান সংগ্রহকারী সানি, চ্যাপেল বা জাভেদকে ছাড়িয়ে যান, সেই যুক্তি কপিলের পক্ষেও ছিল। তাই ভিভের সঙ্গে কপিলই একমাত্র ক্রিকেটার যার নিজেদের খেলার স্টাইলে টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের জন্যে কোনরকম এডজাস্টমেন্টের প্রয়োজন ছিল না।
সানি একসময় বলতেন কপিলের ব্যাটিং প্রতিভা ভিভের সঙ্গে তুলনীয়। আরও যদি একটু নিজেকে অ্যাপ্লাই করতেন তাহলে কোথায় যে পৌঁছতেন সেটা জল্পনার বিষয়। সেই যুগে অনেককেই বলতে শুনেছি ব্যাটসম্যান কপিল বোলার কপিলের চেয়ে এগিয়ে ছিলেন। তখন ভাবতাম এতে বোলার কপিলকে অপমান করা হচ্ছে। এখন বুঝেছি, সেটা অসম্ভব।
বোলার কপিল কী ছিলেন সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না, যারা তাঁকে পিক ফর্মে দেখেছেন, তারা জানেন। বরং আন্ডার এস্টিমেট করা হয়ে এসেছে ব্যাটসম্যান কপিলকে। তাই যেখানে বোথাম নিজের ৭০% টেস্ট ইনিংসে ১-৬ পোজিসানে ব্যাটিং করে এসেছেন, কপিলের ক্ষেত্রে সেই সংখ্যাটা মাত্র ১১%। অবশ্য ক্যাপ্টেনদের দোষ দিয়েই বা কী হবে – একবার তাঁকে প্রমোশন দেওয়ার পর ভেঙ্কটকে যে পরিমাণ সমালোচনা হজম করতে হয়েছিল (এখনও হয়) যে তারপর আর সেই পথে কেউ হাঁটেন নি।
যদি হাঁটত! আজকাল মনে হয় ঋশভের কপাল যে কতটা ভালো সেটা সম্ভবত ও নিজেও জানে না।