লর্ডসের কম্পটন গ্যালারিতে দুই কিংবদন্তি – গ্রাহাম গুচ এবং গ্রায়েম স্মিথের মাঝে ঠাঁই পেয়েছে তার স্থিরচিত্র। লর্ডস তাঁকে কাঁদিয়েছে, লর্ডস তাঁকে হাসিয়েছে। মাত্র ১৯ বছর বয়সে লর্ডসেই ইংল্যান্ডের বিপক্ষে অভিষেক। কিন্তু অভিষেকটা স্মরণীয় করে রাখতে পারেননি।
সেদিন তাঁকে বেধড়ক পিটিয়েছেন ইংরেজ ব্যাটসম্যানরা, ১২ ওভারে হজম করেছিলেন ১০১ রান। তিনি কেঁদেছিলেন কিন্তু হাল ছাড়েননি। পাঁচ বছর পর যখন আবারও নামলেন লর্ডসের সবুজ গালিচায়, লর্ডস যেন তাকে সুদে-আসলে সব ফিরিয়ে দিল। অ্যালিস্টেয়ার কুককে বোকা বানিয়ে শুরু করেছিলেন আর শেষ করেছেন জিমি অ্যান্ডারসনের উইকেট উপড়ে ফেলে।
তার গতি-সুইং আর আগ্রাসী বোলিংয়ের জবাব ছিল না ইংরেজ ব্যাটসম্যানদের কাছে। একে একে ফিরিয়েছেন জোনাথন ট্রট, ইয়ন মরগ্যান, টিম ব্রেসনানদের। প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে লর্ডসের অনার্স বোর্ডে নাম ওঠে তাঁর। টেস্টে এখনো মাশরাফি বিন মুর্তজার পর বাংলাদেশি পেসারদের মাঝে সর্বোচ্চ উইকেট তাঁর। তিনি শাহাদাত হোসেন, বাংলাদেশ ক্রিকেটের আজন্ম আক্ষেপ।
টেস্টে একজন আদর্শ পেসার না পাবার আক্ষেপ বাংলাদেশের আজন্ম। একজন কৌশিক এসেছিলেন আশা জাগিয়ে কিন্তু ইনজুরি তাকে পূর্ণতা পেতে দেয়নি। ২০০৫ সালের দিকে এদেশের ক্রিকেটে আবির্ভাব শাহাদাতের। দীর্ঘকায়, জোরে বল করতে পারেন, আছে দুই দিকেই সুইং করানোর সহজাত দক্ষতা সাথে যোগ করুন আগ্রাসী মনোভাব সব মিলিয়ে একজন আদর্শ পেস বোলারের যেসব গুণাবলি থাকা দরকার সবই ছিল শাহাদাতের।
অভিষেক টেস্টে ব্যর্থ হলেও তাই নিজেকে প্রমাণ করতে খুব বেশি সময় নেননি। ২০০৬ সালে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে সাদা বলের ক্রিকেটে বাংলাদেশের ক্রিকেটে প্রথম হ্যাটট্রিক করেন। হারারেতে সেই ম্যাচে ৪৫ তম ওভারে টানা তিন বলে সাজঘরে ফেরত পাঠান মুফাম্বিসি, এল্টন চিগুম্বুরা এবং প্রসপার উৎসেয়াকে। যদিও ব্রেন্ডন টেলরের শেষ বলের ছক্কায় সেদিন স্বপ্নভঙ্গ হয়েছিল বাংলাদেশের।
শাহাদাতের সামনে সুযোগ ছিল এদেশের ইতিহাসের সেরা বোলার হবার। কিন্তু ব্যক্তিগত জীবনে উ-শৃঙ্খল শাহাদাত থাকতে পারেননি বিতর্কমুক্ত। কোন দিকে ঝোঁক নেই তার! ফ্যাশন, হেয়ারকাট থেকে শুরু করে গাড়ির মডেল বদলানো সবকিছুতেই অন্যদের থেকে আলাদা শাহাদাত।
পত্রিকায় হাস্যরসাত্নক সব মন্তব্য করে হয়েছেন হাসির পাত্র। কখনো নিজেকে দাবি করেছেন সবচেয়ে সুদর্শন হিসেবে আবার কখনো ব্যক্ত করেছেন সিনেমার নায়ক হবার বাসনা। সিনেমার নায়িকারা মোটা, মডেলরা সুন্দর, শাকিব খানের ভাত মেরে দিতে পারেন এমন সব উদ্ভট মন্তব্য করে হয়েছেন বারবার।
পিছু ছাড়েনি ইনজুরির থাবাও। অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপনের পাশাপাশি চোটাঘাতে হারিয়ে ফেলেছিলেন ক্যারিয়ারের সেরা সময়গুলো। সর্বশেষ ২০১৫ সালে জাতীয় দলে সুযোগ পেয়েছিলেন, কিন্তু সে ম্যাচে দুই ওভার বল করেই ইনজুরিতে ছিটকে যান ম্যাচ থেকে। একসময় সবার অন্তরালে চলে যান শাহাদাত, হয়তো সবাই ভুলেই থাকতো। যদি না শাহাদাত বিবেকবর্জিত ঘটনাটি ঘটাতেন।
স্ত্রীকে সাথে নিয়ে গৃহকর্মীকে পিটিয়ে জেলে ছিলেন তিন মাস। সবাই ভেবেছিলেন এবার বোধহয় শোধরে যাবেন। কিন্তু স্বভাব কি আর এত সহজে বদলানো যায়, আবারও শিরোনাম হলেন খেলার মাঠে সতীর্থকে পিটিয়ে। ফলশ্রুতিতে তাকে পাঁচ বছরের নিষেধাজ্ঞা দেয় বিসিবি। কিন্তু মায়ের ক্যান্সারের চিকিৎসার জন্য অর্থের জোগান পেতে বিসিবির কাছে মানবিক আবেদন করেন তিনি। আঠারো মাস পর তাই নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়া হয়, আবারও মাঠে ফেরেন শাহাদাত। কিন্তু আগের ধার কি ফেরত পেয়েছেন?
শাহাদাতের সাথে একই টেস্টে অভিষিক্ত হয়েছিলেন মুশফিকুর রহিম। শাহাদাত থেমে গিয়েছেন ৩৮ টেস্টে ৭২ উইকেট নিয়েই অন্যদিকে, মুশফিক ছুটছেন আপন মহিমায়। শাহাদাত ছিলেন অপার সম্ভাবনাময়। কিন্তু তারকা খ্যাতির আলোতে ঝলসে যাওয়া শাহাদাত পারেননি নিজের প্রতি সুবিচার করতে, রয়ে গেছেন বাংলাদেশ ক্রিকেটের চিরকালীন এক আক্ষেপের নাম হয়ে।