জেগে উঠেছে ক্যারিবিয়ান দানব

সামনেই টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ। এই ফরম্যাটে ক্যারিবিয়ানদের দাপট আর সামর্থ্য নিয়ে কারো প্রশ্ন থাকার কথা নয়। এরই মধ্যে অজিদের বিপক্ষে দাপুটে জয় প্রমাণ করে একসাথে জেগে উঠেছে ক্যারিবিয়ান দানবরা। চোখের সামনে হাতছানি দিচ্ছে আরেকটি বিশ্বকাপ শিরোপা। ক্লাইভ লয়েড, গর্ডন গ্রিনিজদের খেলে যাওয়া সেই সোনালি যুগ হয়তো ফিরবেনা। কিন্তু টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটে ক্যারিবিয়ানদের দাপট হয়তো চলবে যুগ যুগ।

৭০ এবং ৮০ এর দশকের ওয়েস্ট ইন্ডিজ দল মানেই ইতিহাসের অন্যতম সেরা দল। ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেটের স্বর্ণযুগ বলা হয় সেসময়কে। ১৯৭৫ সালে বিশ্বকাপের উদ্বোধনী আসরে জয়ের পর ১৯৭৯ সালে দ্বিতীয় বিশ্বকাপেও শিরোপা নিজেদের করে নেয় ক্যারিবিয়ানরা। ক্লাইভ লয়েডের নেতৃত্বে ভিভ রিচার্ডস, কলিন ক্রফট, জোয়েল গার্নার, গর্ডন গ্রিনিজ, অ্যান্ডি রবার্টস, ম্যালকম মার্শালদের নিয়ে গড়া সেই দল ছিলো যেকোনো প্রতিপক্ষের জন্য আতংক!

প্রায় দুই দশক ধরে বিশ্ব ক্রিকেটে ক্যারিবিয়ানরা ত্রাশ করেছিলো। ওয়েস্ট ইন্ডিজের ওই দল তখন অজিরা ছাড়া বাকি দলের জন্য একপ্রকার দূর্ভেদ্য দেয়ালের মতো ছিলো। এরপর নব্বই এর দশক থেকে শুরু হয় ক্রিকেটে অজিদের আধিপত্য। আর ধীরে ধীরে ক্যারিবিয়ানদের রাজত্বের যুগটা ইতি টানতে থাকে।

এরপর টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট আর ফ্র‍্যাঞ্চাইজি ক্রিকেটের অন্তর্ভুক্তি। ভৌগলিক অবস্থান আর পেশি শক্তির কারণে ফ্র‍্যাঞ্চাইজি ক্রিকেটে সবচেয়ে বেশি আধিপত্য বিস্তার করেছিলো ক্যারিবিয়ানরা। এমনকি জাতীয় দলের চেয়ে ফ্র‍্যাঞ্চাইজি ক্রিকেটকেই প্রাধান্য দিতো সবাই। বোর্ডের সাথে বেতন-ভাতা নিয়ে দ্বন্দ্বের কারণে জাতীয় দলে সারা বছর দেখা যেতো না তারকা ক্রিকেটারদের। তবে যখনি আইসিসির কোনো বিশ্বআসর অনুষ্ঠিত হয় পৃথিবির বিভিন্ন প্রান্তে ফ্র‍্যাঞ্চাইজি লিগ খেলা তারকা ক্রিকেটাররা দলে একত্রিত হয়।

ওয়ানডে কিংবা টেস্টে সেই সত্তর কিংবা আশির দশকের পারফরম্যান্স ধরে না রাখতে পারলেও টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের আগমনের পর থেকে ক্রিকেটের সংক্ষিপ্ত ফরম্যাটে নিজেদেরকেই সেরা প্রমাণ করেছে ক্যারিবিয়ানরা। ২০১২ এর পর ২০১৬ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের শিরোপা ঘরে তুলে এই ফরম্যাটে নিজেদের শ্রেষ্ঠত্বের প্রমাণ দিয়েছে তারা।

সারা বছর যেমনই থাকুক বিশ্বকাপ এলেই যেনো ক্যারিবিয়ান স্কোয়াডে দেখা দেয় তারকাদের মেলা! ক্রিস গেইল, আন্দ্রে রাসেল, ডুয়াইন ব্রাভো, কায়রন পোলার্ডরা সারা বছর বাইরের লিগে খেললেও বিশ্ব আসরে সবাই মিলিত হন দলের স্বার্থে।

সামনেই ২০২১ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ। ক্যারিবিয়ানদের দাপট দেখানোর আরেকটি সুযোগ! ইতিমধ্যেই নিজেদের দল গোছাতে শুরু করেছে প্রতিটি দল। বরাবরের ন্যায় প্রতিটা দলই আটঘাট বেঁধে দলের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন অভিজ্ঞ গেইল, রাসেল, পোলার্ড, ব্রাভোরা।

টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপকে সামনে রেখে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে সবশেষ ঘরের মাঠে সিরিজ খেলে ক্যারিবিয়ানরা। সেখানে ঘরের মাঠে প্রথমে টেস্ট সিরিজ হার! তারপর তাদের মূল শক্তির জায়গা টি-টোয়েন্টি সিরিজেও ৩-২ এ হারে ক্যারিবিয়ানরা। এর মধ্যে অবশ্য এক ম্যাচে মাত্র ১ রানে হেরে সিরিজ হাতছাড়া করে স্বাগতিকরা! ওয়েস্ট ইন্ডিজের এমন শক্তিশালী স্কোয়াডের বিপক্ষে সিরিজ জয়ে বেশ উচ্ছ্বসিত দক্ষিণ আফ্রিকা দল।

সেই হতাশা ভুলে গিয়ে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে সিরিজ শুরু করে গেইল-পোলার্ডরা। সদ্য সমাপ্ত অজিদের বিপক্ষে ৫ ম্যাচের টি-টোয়েন্টি সিরিজ নিজেদের দাপট দেখিয়ে ৪-১ এ জিতে নিয়েছে ক্যারিবিয়ানরা। ক্রিস গেইল, নিকোলাস পুরান, এভিন লুইস, শিমরন হেটমায়ার, ডুয়াইন ব্রাভো প্রত্যেকেই নিজেদের সেরাটা দিয়ে দলের জয় নিশ্চিত করেছেন।

এই জয়ে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের আগে ক্রিকেট বিশ্বকে ক্যারিবিয়ান শক্তিমত্তার আগাম বার্তা দিয়ে রাখলেন গেইল, ব্রাভো, রাসেলরা। এই সিরিজে সর্বোচ্চ রানের সাতজনের পাঁচজনই হলেন ওয়েস্ট ইন্ডিজের! সেই সর্বোচ্চ উইকেটশিকারির প্রথম পাঁচজনের চারজনই ওয়েস্ট ইন্ডিজের!

কিছুদিন আগেও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম সহ বিভিন্ন মিডিয়ায় বলা হচ্ছিলো ক্রিস গেইল ফুরিয়ে গেছেন! চলতি বছর ২০২১ সালে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে সিরিজের আগে পর্যন্ত ৭ ম্যাচে করেছিলেন মাত্র ৭৫ রান! এরপর অস্ট্রেলিয়া সিরিজে প্রথম দুই টি-টোয়েন্টিতে করেন ৪ ও ১৩ রান। ‘ইউনিভার্স বস’ খ্যাত ২২ গজে বোলারদের আতংক সেই গেইল কি তাহলে সত্যিই ফুরিয়ে গেছেন?

এরপর সিরিজের তৃতীয় টি-টোয়েন্টিতে ৩৮ বলে ৬৭ রানের ম্যাচজয়ী ইনিংসে ক্রিকেটবিশ্বকে জানিয়ে দিলেন তিনি ফুরিয়ে যাননি। ৪২ বছর বয়সে এসেও ২২ গজে চার-ছক্কার ফুলঝুরি ছড়াচ্ছেন গেইল! সেই সাথে টি-টোয়েন্টিতে এখন ১৪ হাজার রানের মালিকও এখন তিনি! একমাত্র ক্রিকেটার হিসেবে টি-টোয়েন্টিতে ১৪ হাজার রান সংগ্রাহক হলেন গেইল।

গেইল ছাড়াও দীর্ঘদিন পর দলে ফেরা লেন্ডল সিমন্স, আন্দ্রে রাসেলরাও তাদের সেরাটা দিয়েছেন। তারকায় টুইটুম্বুর এই দলে প্রতি ম্যাচেই কেউ না কেউ ব্যাট কিংবা বল হাতে জ্বলে উঠেছেন। বোলিংয়ে সর্বোচ্চ উইকেটশিকারি ছিলেন তরুন স্পিনার হেইডেন ওয়ালশ।

একাই ১২ উইকেট শিকার করে সিরিজে পার্থক্য গড়ে দিয়েছেন ওয়ালশ। এছাড়া ওবেড ম্যাকয় ও শেলডন কটরেলও বেশ দুর্দান্ত বোলিং করেছেন। দু’জনেই প্রায় ৭ ইকোনমি রেটে বল করেছেন। দু’জনে মিলে পুরো সিরিজে নিয়েছেন মোট ১১ উইকেট! সব মিলিয়ে বেশ দুর্দান্ত এক সিরিজ পার করেছে ক্যারিবিয়ানরা।

সামনেই টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ। এই ফরম্যাটে ক্যারিবিয়ানদের দাপট আর সামর্থ্য নিয়ে কারো প্রশ্ন থাকার কথা নয়। এরই মধ্যে অজিদের বিপক্ষে দাপুটে জয় প্রমাণ করে একসাথে জেগে উঠেছে ক্যারিবিয়ান দানবরা। চোখের সামনে হাতছানি দিচ্ছে আরেকটি বিশ্বকাপ শিরোপা। ক্লাইভ লয়েড, গর্ডন গ্রিনিজদের খেলে যাওয়া সেই সোনালি যুগ হয়তো ফিরবেনা। কিন্তু টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটে ক্যারিবিয়ানদের দাপট হয়তো চলবে যুগ যুগ।

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...