হয়তো পিয়ানোর সুরে সবাইকে মোহিত করে রাখার কথা ছিল তাঁর। পরিবারের অন্য সবার মত সংগীতেই হয়তো নাম করতে পারতেন। কিন্তু পিয়ানোর সুর ছাপিয়ে পাথিরানার মনে ধরলো ব্যাটারের স্ট্যাম্প ভাঙার শব্দ। আইপিএল দিয়ে পুরো বিশ্বের কাছে পরিচিতি পাওয়া ‘নতুন মালিঙ্গার’ উঠে আসার গল্পটাও বেশ মুখরোচক। ক্রিকেটের সবচেয়ে ছোট ফরমেটটিতে খুব দ্রুতই যে বল হাতে রাজত্ব করবেন মাথিশা পাথিরানা তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
নেট বোলার থেকে চলতি আসরেই প্রথমবার চেন্নাইয়ের হয়ে আইপিএলে খেলার সুযোগ পেয়েছেন পাথিরানা। তখন কে জানত যে এবারের আইপিএলেরই অন্যতম সেরা অবিষ্কার হয়ে উঠবেন এই লঙ্কান পেসার। আইপিএলে মাত্র দশ ম্যাচ খেলেই চেন্নাই সুপার কিংসের মূল ভরসা হয়ে উঠেছেন তিনি। ডেথ ওভারে মাহেন্দ্র সিং ধোনির মূল অস্ত্র এখন পাথিরানা। ইতিহাসের অন্যতম সফল অধিনায়ক ধোনির কাছ থেকে পাচ্ছেন প্রসংশা। এর চেয়ে বড় সার্টিফিকেট একজন তরুণ বোলারের জন্য আর কি বা হতে পারে।
শ্রীলঙ্কান কিংবদন্তি লাসিথ মালিঙ্গাকে অনুকরণ করা পেসার শ্রীলঙ্কাতে অভাব নেই। তবে অন্য সবার চেয়ে কিছুটা আলাদা ছিলেন পাথিরানা। ওমন অদ্ভুত অ্যাকশনে দুর্দান্ত পেসে নিখুঁত জায়গায় বল করতে পারতেন পাথিরানা। তাই স্কুল ক্রিকেট থেকেই শ্রীলঙ্কায় বেশ নাম ডাক পড়ে তাঁর।
স্কুল ক্রিকেটের পর শ্রীলঙ্কার বয়স ভিত্তিক পর্যায়ের সব ধাপ পেরিয়েছেন পাথিরানা। ওমন অ্যাকশনের কারণে সবার নজরে থাকলেও পারফরম্যান্স দিয়ে খুব একটা আলোচনায় কখনোই ছিলেন না পাথিরানা। শ্রীলঙ্কার হয়ে ২০২০ এবং ২০২২ অনুর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে অংশ নিয়ে ছয় ম্যাচ খেলে সাত উইকেট পান পাথিরানা। তবে ভারতের বিপক্ষে একটি ম্যাচে পাথিরানার করা একটি ডেলিভারি স্পিডোমিটারে প্রতি ঘন্টায় ১৭৫ কিলোমিটার গতি দেখালে আলোচনায় আসেন পাথিরানা।
স্কুল ক্রিকেটে পাথিরানার বোলিংয়ের একটি ভিডিও আসে চেন্নাই সুপার কিংসের কাছে। সেই ভিডিওতে পাথিরানার বোলিং দেখেই মনে ধরে মাহেন্দ্র সিং ধোনির। চেন্নাইয়ের নেট বোলার হিসেবে তাকে দলে চান ধোনি। চেন্নাই ম্যানেজমেন্টও শ্রীলঙ্কান ক্রিকেট বোর্ডের কাছ থেকে অনাপত্তিপত্র পেয়ে যায় এবং সে বছরের আইপিএলেই চেন্নাইয়ের নেট বোলার হিসেবে দলে যোগ দেন পাথিরানা।
পরের বছর চেন্নাই পেসার এডাম মিলনে ইনজুরির কারণে আইপিএল থেকে ছিটকে গেলে নেট বোলার থেকে পাথিরানাকে মূল দলে যুক্ত করে চেন্নাই। তবে চেন্নাইয়ের জার্সিতে অভিষেকের জন্য দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হয় পাথিরানাকে। প্লে অফ নিশ্চিতের পর এক প্রকার ডেড রাবার ম্যাচে পাথিরানাকে অভিষেক করায় চেন্নাই। আইপিএলের সফলতম পেসার ডোয়াইন ব্রাভোর জায়গায় দলে সুযোগ পেয়ে নিজের স্পেলের প্রথম বলেই শুভমান গিলের উইকেট তুলে নেন পাথিরানা।
গত মৌসুমেই আইপিএলে নিজের ক্যারিয়ারের ইতি টেনে চেন্নাইয়ের কোচিং স্টাফে যোগ দেন ব্রাভো। কিছুদিন আগেই যুবেন্দ্র চাহালের কাছে আইপিএলে ইতিহাসে সর্বোচ্চ উইকেট শিকারীর সিংহাসন হারানো ব্রাভো শুধু আইপিএল নয়, টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটেরই একজন কিংবদন্তি। তবে ব্রাভোর মত ডেথ ওভার স্পেশালিস্ট খুঁজে পেতে খুব একটা অপেক্ষা করতে হয়নি চেন্নাইকে। চলতি মৌসুমে ব্রাভ্রোর অভাব টেরই পেতে দিচ্ছেন না পাথিরানা।
চলতি আসরে এখন অবদি ১২ উইকেট শিকার করেছেন পাথিরানা। তবে সবচেয়ে চোখে পড়ার মত বিষয় হলো, নিয়মিত ডেথ ওভারে বোলিং করেও পাথিরানার ইকোনমি রেটটা ৮.৩৩। আধুনিক টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের জন্য এটিকে দুর্দান্ত বলতেই হবে।
শুধু নিজের অ্যাকশনের কারণেই বাড়তি একটা সুবিধা পেয়ে থাকেন পাথিরানা। কিন্তু শুধু অ্যাকশনই নয়, গতি, ভ্যারিয়েশনসহ নিজের অস্ত্রভান্ডার অনেকটাই সমৃদ্ধ এই পেসারের। গত দুই বছরে দারুণ উন্নতি করে নজর কাড়ছেন সবার।
পাথিরানায় মুগ্ধ চেন্নাইয়ের পরামর্শক এরিক সিমন্স। কঠিন পরিস্থিতিতে পাথিরানার মাথা ঠান্ডা রাখার দক্ষতাকে আলাদা ভাবে দেখতে চাইলেন সিমন্স। তিনি বলেন, ‘আমার কাছে মনে হয় সে আমাদের সবচেয়ে বেশি মুগ্ধ করেছে চাপের মুহূর্তে তাঁর মাথা ঠাণ্ডা করার দক্ষতা দিয়ে। এই পর্যায়ে এসে চাপের মুহুর্তে মাথা ঠান্ডা রাখতেই হবে।’
মাত্র ২০ বছর বয়সেই চেন্নাইয়ের পরিকল্পনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছেন পাথিরানা। বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ফ্রাঞ্চাইজি লিগের সেরা আবিষ্কার হয়ে উঠেছেন। স্লিঙ্গি অ্যাকশন, প্রায় ১৫০ কিলোমিটার গতি, মারাত্মক ইয়োর্কার করার দক্ষতা, সব মিলিয়ে ব্যাটারদের জন্য আতঙ্ক হয়ে উঠছেন ক্রমশই। ব্রাভোর বদলি হিসেবে চেন্নাইয়ে খেলা পাথিরানা হয়তো একদিন তাঁর কোচকেও ছাড়িয়ে যাবেন নিজেকে ধরে রাখতে পারলে।
যেমনটা প্রথমে বলা হয়েছে, সঙ্গীতাঙ্গনেই হয়তো ক্যারিয়ার গড়তে পারতেন পাথিরানা। তাঁর পরিবাবের প্রায় সবাই কোনো না কোনো ভাবে সঙ্গীতের সাথে যুক্ত। পাথিরানা নিজেও দারুণ পিয়ানো বাজান। এই বিষয়ে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাও নিয়েছিলেন। তবে পিয়ানো ছেড়ে ক্রিকেটের সাদা বলটার প্রেমেই পড়লেন পাথিরানা। বিশ্বজুড়ে ব্যাটারদের জন্য আতঙ্ক ছড়িয়ে চলেছেন সেই বল হাতে। কে জানে, হয়তো পিয়ানোর আওয়াজের চেয়ে ব্যাটারের স্ট্যাম্প উড়িয়ে দেবার আওয়াজটাই বেশি মনে ধরেছিল পাথিরানার।