৭ জুন, ২০১৯।
ঠিক দুপুর বেলা বাংলাদেশের বিশ্বকাপ দল ঘোষণা করা হল। তবে কিছুক্ষণ বাদেই সেই স্কোয়াডের আলোচনাকে পিছে ফেলে গণমাধ্যমে ভেসে আসলো বিসিবি অ্যাকাডেমি মাঠের সামনে তাসকিন আহমেদের অশ্রুভেজা চোখের ছবি।
তিনি স্বপ্নের বিশ্বকাপ দলে নেই এটি সাংবাদিকরা মনে করিয়ে দিতেই আর নিজেকে সামলে রাখতে পারলেন না। যতদূর মনে পড়ে কথা গুলো তাসকিন এমন করেই বলেছিলেন, ‘যা হয়েছে ভালোর জন্যই হয়েছে। সবাই ভালোই চায়, কেউ তো খারাপ চায়না। সামনে ভালো খেলব ইনশাল্লাহ।’
সামনে ভালো খেলবেন এই কথাটা তাসকিন রাখতে পেরেছেন। একদম মনের গভীরে পাওয়া তীব্র আঘাতের উত্তরে কথাটা বলেছিলেন বলেই হয়তো রাখতে পেরেছেন। বিশ্বকাপের আগে বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগে ( বিপিএলে ) আগুন ঝড়ানো বোলিং করেছিলেন তাসকিন।
২২ উইকেট নিয়ে আসরের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ উইকেট শিকারী ছিলেন তিনি। ফলে নির্বাচকরা কোনোরকম চিন্তা ভাবনা ছাড়াই তাসকিনকে বিশ্বকাপের আগে নিউজিল্যান্ড সিরিজের দলে রেখেছিলেন। তবে সেই সিরিজের কিছুদিন আগেই অ্যাংকেলের চোঁটে সব যেন এলোমেলো হয়ে যায়।
তবে বিশ্বকাপকে সামনে রেখে দ্রুতই ইনজুরি থেকে ফিরে আসেন। ম্যাচ খেলার মত ফিট প্রমাণ করার জন্য দল ঘোষণার আগে লিজেন্ডস অব রূপগঞ্জের বিপক্ষে একটি ম্যাচও খেললেন। তবুও ম্যাচ খেলার মত ফিট না বলে তাঁকে দলে রাখা হলো না।
এই স্পিডস্টারকে ছাড়াই বাংলাদেশ ইংল্যান্ডে বিশ্বকাপ খেলতে গেলো। সেখানে কোনো একটা কিক পেয়ে পুরো বিশ্বকে অবাক করে দিলেন সাকিব আল হাসান। তবে তাসকিনের জন্য ২০১৯ বিশ্বকাপই ছিল সবচেয়ে বড় কিক।
এরপরই থেকে সত্যিই তাসকিন ভালো খেলে শুরু করলেন। বিশ্বকাপের পর করোনার কারণে ঘরে থেকেই নিজের ফিটনেস ও টেকনিক নিয়ে কাজ করতে থাকলেন। ফলে তাঁর ক্রিকেটীয় মানসিকতায়ও এসেছে বিরাট পরিবর্তন। করোনার পর সেই কঠোর পরিশ্রমের ফল পাওয়া গেল। তাসকিন যে সেদিন বিসিবি অ্যাকাডেমি মাঠের সামনে শুধু বলার জন্য ‘সামনে ভালো খেলব’ বলেননি তাঁর প্রমান পেতে শুরু করলাম আমরা।
গতবছর বিসিবি প্রেসিডেন্ট’স কাপ ও বঙ্গবন্ধু টি-টোয়েন্টি কাপে এক অন্য তাসকিনকে দেখা গেল। দেশের ওই পিচেও ১৪০ এর আশেপাশে বল করতে থাকলেন। বলা যেতে পারে তিনি তো সবসময়ই জোরে বল করেন। তফাতটা কি? এবার তিনি বল করতে লাগলে নিখুঁত লাইন-লেন্থে। ওই দ্রুত গতির বাউন্সার গুলো ব্যাটসম্যানের গাঁ ঘেষে ছুড়ছিলেন তখন বোঝা যাচ্ছিল কিছু একটার জবাব দিচ্ছেন তিনি।
ঘরোয়া ক্রিকেটে এই আগুন ঝড়ানো বোলিং এর পর ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে দলে ডাক পেলেন। তবে ঘরের মাঠে এই সিরিজে সেভাবে ম্যাচ খেলার সুযোগ পেলেন না তিনি। এরপর নিউজিল্যান্ড সফরে দেখা গেলো তাঁর নতুন রূপ। প্রথম ম্যাচের শুরুতে মার্টিন গাপটিলকে আউট করলেন।
তবে পুরো ম্যাচে তাঁর বোলিং যে নিউজিল্যান্ডকে কতটা ভুগিয়েছে সেটা না দেখলে ঠিক বোঝা যায় না। তৃতীয় ওয়ানডেতেও আবার সেই মাপা লাইন-লেন্থ আর বাউন্সারে হাঁপিয়ে তুলেছিলেন প্রতিপক্ষকে। তবে কিপার মুশফিক ও অন্যান্য ফিল্ডারদের ক্যাচ মিসের মোহড়ায় স্কোরকার্ড বুঝলো না সেদিন কী উজ্জ্বল ছিলেন তাসকিন।
এই ক্যাচ মিসের মিছিল বয়ে চলেছে শ্রীলঙ্কাতেও। তাসকিনের বলে এই মিছিল যেনো আরো জোড়ালো হয়। তবুও প্রথম টেস্টে দলের সর্বোচ্চ তিন উইকেট নিয়েছিলেন তিনি। তবে দ্বিতীয় টেস্টের দ্বিতীয় দিন সকালে যেনো আরো ভালো খেলার প্রতিজ্ঞা করেই নেমেছিলেন।
সকালে ১৪০ রান করা থিরিমান্নেকে ফিরিয়ে শুরু করেন তাঁর আগুন ঝড়ানো বোলিং। পরে যেই আগুনে ছারখার হয় শ্রীলঙ্কার ব্যাটিং লাইন আপ। এরপর সেট হওয়ার আগেই ফেরান অ্যাঞ্জেলো ম্যাথিউসকে। এরপর পাথুম নিশাঙ্কা যেনো বুঝতেই পারলেন না তাসকিনের সেই বল। ৩০ রানেই বোল্ড হয়ে ফিরেন এই ব্যাটসম্যান।
পরদিন সকালে নিলেন আরেকটা। তবে এই চার উইকেট দিয়ে আসলে তাঁর বোলিং এর ঝাঁজটা বোঝা যাচ্ছেনা। পালেকেল্লের মরা পিচেও যেন ফুল ফোটালেন তিনি। তাছাড়া এই অসম্ভব গরমে এখন অবধি ৩৪.২ ওভার বল করেছেন তিনি। তবে ম্যাচের কোনো মুহুর্তেই আপোষ করেননি স্পিড কিংবা লাইন লেন্থ নিয়ে। সব মিলিয়ে তাঁর শরীরি ভাষায় স্পষ্ট বোঝা যায় তিনি এক নতুন তাসকিন।
২০১১ বিশ্বকাপেও ঠিক ফিটনেসের অজুহাতে বাদ পড়ে কান্নায় ভেঙে পড়েছিলেন তাসকিনের বড় ভাই মাশরাফি বিন মুর্তজা। তারপর সেই মাশরাফি রাজ করেছেন দেশের ক্রিকেটে। বড় ভাইয়ের কাছেই হয়তো ফিরে আসার ব্যাপারটা শিখেছেন তাসকিনও, যেভাবে চ্যাম্পিয়নরা ফিরে আসে। তাসকিনও রাজ করুন দেশের ক্রিকেটে। তবেই তো লাভবান হবে বাংলাদেশের ক্রিকেট।