‘সুযোগ পেলে স্টোকস এবং রুটের উইকেট নিতে চাই’ – ইংল্যান্ডের বিপক্ষে টেস্ট সিরিজ শুরুর আগে নিজের ইচ্ছার কথা বলেছিলেন আবরার আহমেদ। নিজের অভিষেকটা কি দারুণভাবেই না স্মরণীয় করে তুললেন তিনি! কেবল রুট-স্টোকস নয়, ইংলিশ ব্যাটিং লাইনআপের প্রথম সাত ব্যাটসম্যানকে সাজঘরে পাঠিয়েছিলেন একাই। এক আবরারে ভর করে প্রথম টেস্টের দু:স্বপ্ন কাটিয়ে উঠছে পাকিস্তান।
অথচ তাঁকে প্রথম দেখায় ক্রিকেটার হিসেবে ভাবতেই পারবেন না। বুদ্ধিদীপ্ত চেহারা, চোখে চশমা, শান্ত, সৌম্যকান্তি গড়নের এই তরুণকে দেখলে মনে হবে ক্লাসের সবচেয়ে সুবোধ বালক। বন্ধুদের আড্ডাতেও তাঁর পরিচিতি ‘হ্যারি পটার’ নামেই। অথচ বাইশ গজে নামলেই ভিন্ন রূপ আবরারের, ডানহাত থেকে বেরোয় গুগলি, ফ্লিপারের মতো মারণাস্ত্র। লেগস্পিনার হলেও ঝুলিতে আছে ক্যারম বলও।
অভিষেকটা আগের টেস্টেই হওয়ার কথা ছিল আবরারের। কিন্তু কোনো এক অজানা কারণে তাঁর বদলে দলে নেয়া হয় জাহিদ মাহমুদকে। রাওয়ালপিন্ডির সেই টেস্টে পরাজয়ের পর তাই আবরারের দলে ঢোকাটা অবশ্যম্ভাবী ছিল।
নিজের অভিষেক টেস্টেই জানান দিলেন নিজের সামর্থ্যের, বুঝিয়ে দিলেন আগের টেস্টে তাঁকে একাদশে না রেখে কি ভুলটাই করেছেন বাবর আজম। ১৯৯৬ সালে মোহাম্মদ জাহিদ এবং মোহাম্মদ নাজিরের পর তৃতীয় পাকিস্তানি বোলার হিসেবে অভিষেক টেস্টেই সাত উইকেট নেবার কৃতিত্ব অর্জন করেন আবরার।
অ্যাবোটাবাদ থেকে দূরে শিনকিয়ারি নামের প্রত্যন্ত এক গ্রামে জন্ম আবরারের। তবে বাবার চাকরির সুবাদে ছোটবেলাতেই করাচিতে চলে আসেন তিনি। সেখানেই টেপ টেনিস ক্রিকেটে বল স্পিন করিয়ে সবার নজরে চলে আসেন। পরে রশিদ লতিফ একাডেমিতে প্রখ্যাত পাকিস্তানি কোচ মোহাম্মদ মাসরুরের অধীনে নিজেকে শাণিত করতে শুরু করেন আবরার।
এরপর বয়সভিত্তিক ক্রিকেটের এক টুর্নামেন্ট ৫৩ উইকেট নিয়ে চলে আসেন পিএসএলের দলগুলোর রাডারে। আবরারে মুগ্ধ করাচি কিংস প্রথম সুযোগেই দলে ভেড়াতে দেরি করেনি। এরপর থেকে কেবলই এগিয়ে চলা আবরারের। জাতীয় দলের দরজাটা প্রায় খুলেই গিয়েছিল বছরদুয়েক আগে, কিন্তু অপ্রত্যাশিত এক ইনজুরি পিছিয়ে দেয় তাঁকে। লেভেল ফাইভের ফ্র্যাকচার হওয়ায় সবাই ভেবেছিলেন তাঁর পক্ষে হয়তো আর সর্বোচ্চ পর্যায়ের ক্রিকেট খেলা সম্ভব না।
অনেকে তো পরামর্শ দিয়েছিলেন অ্যাকশন বদলে অফস্পিনার হয়ে যাবার। এরপর জল গড়িয়েছে বহুদূর, কিন্তু আবরার হাল ছাড়েননি। নিজের লক্ষ্যে তিনি ছিলেন অবিচল। ২০২১ পিএসএলে কোনো দল না পেলেও থেমে থাকেননি, সিন্ধের দ্বিতীয় একাদশে সুযোগ পেয়ে সেখানেই খেলা চালিয়ে গেছেন।
শুরুতে সীমিত ওভারের স্পেশালিস্ট ভাবা হলেও ধীরে ধীরে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেছেন টেস্ট ক্রিকেটেও। টি টোয়েন্টি বিশ্বকাপের আগে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে সিরিজে দলে ডাক পেলেও সেবার মাঠে নামার সুযোগ পাননি।
কিন্তু এবারের কায়েদে আজম ট্রফিতে মাত্র ২১ গড়ে ৪৩ উইকেট শিকারের পর আর উপেক্ষা করা যায়নি । মাত্র ১৪টি প্রথম শ্রেণির ম্যাচের অভিজ্ঞতা থাকলেও সুযোগ পেয়ে গেছেন ইংল্যান্ডের বিপক্ষে দ্বিতীয় টেস্টে। আর তাতেই বাজিমাত! প্রথম পাকিস্তানি বোলার হিসেবে অভিষেক ম্যাচেই লাঞ্চের আগেই পেয়ে গেছেন পাঁচ উইকেট।
জ্যাক ক্রলিকে দিয়ে শুরু, এরপর একে একে সাজঘরে ফিরিয়েছেন বেন ডাকেট, অলি পোপ, জো রুট, হ্যারি ব্রুক, বেন স্টোকস, উইল জ্যাকসদের। একপর্যায়ে তো সম্ভাবনা জেগেছিল একাই দশ উইকেট শিকারের। কিন্তু জাহিদ মাহমুদ ইংলিশ টেলঅর্ডার গুটিয়ে দিলে সাত উইকেট নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয় আবরারকে।
পাকিস্তানকে বলা হয় পেস বোলারদের আঁতুড়ঘর। বিশ্বসেরা সব ফাস্ট বোলাররা উঠে এসেছেন পাকিস্তান থেকে, ত্রাস ছড়িয়েছেন ব্যাটসম্যানদের মাঝে। কিন্তু একইসময়ে আব্দুল কাদির, মুশ্তাক আহমেদ, দানিশ কানেরিয়ার মতো লেগস্পিনাররাও প্রতিনিধিত্ব করেছেন পাকিস্তানের।
আবরার আহমেদ পূর্বসূরীদের রেখে যাওয়া জুতোয় পা গলাতে পারবেন কিনা সে প্রশ্নের জবাব ভবিষ্যতের জন্য তোলা থাকুক। তবে অভিষেক ইনিংসেই যে ঝলক তিনি দেখিয়েছেন তাতে তাঁর পক্ষে বাজি ধরার লোকই বেশি।