অপরাধের ফাঁদে বিপন্ন ক্রিকেট জীবন

ইংল্যান্ডের হয়ে বিশ্বকাপে বোলিং করা থেকে শুরু করে জেল জীবন পার – মাঝখানে আত্মহননের চিন্তার আনাগোনা। ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় তারকা হওয়ার সুযোগ মাটিতে ধুলিসাৎ। তবুও জীবনের নতুন মানে খোঁজার প্রচেষ্টা। গল্পটা ইংল্যান্ডের সাবেক ক্রিকেটার ক্রিস লুইসের।

ইংল্যান্ডের হয়ে কম না – ৮৫ টি ম্যাচ খেলেছিলেন ক্রিস লুইস। সেখানে ছিল ১৯৯২ ওয়ানডে বিশ্বকাপের সুখস্মৃতি। ইংল্যান্ডের হয়ে সেই বিশ্বকাপের ফাইনাল ম্যাচেও বোলিং করেছিলেন তিনি। কিন্তু নিয়তির অদ্ভুত বেড়াজালে নিজেকে জড়িয়ে ফেলেন তিনি। ২০০০ সাল নাগাদ আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে বিদায় জানিয়ে দেন। ২০০৮ অবধি খেলেছিলেন ঘরোয়া ক্রিকেট।

জীবনের শেষদিকে অভাব তাড়া করতে পারে তাঁকে। এমন এক চিন্তা থেকেই তিনি করে বসেছিলেন এক বিশাল বড় ভুল। মাদক চোরাকারবারের সাথে নিজেকে জড়িয়ে ফেলেন। ১ লাখ ৮৩ হাজার ডলারের একটা কোকেনের চালান চোরাকারবারে রাজি হয়ে যান। বিনিময়ে তাঁকে ৫০ হাজার পাউন্ড দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল মাদক ব্যবসায়ীরা।

সেন্ট লুসিয়া থেকে কোমল পানীয়ের ক্যানে করে তিনি সেই মাদক নিয়ে হাজির হন ইংল্যান্ডে। বিধিবাম, ধরা খেলেন কাস্টমসে। তখনও তিনি ঘরোয়া ক্রিকেটের এক নিয়মিত মুখ। কিন্তু আইন তো সবার জন্য সমান। তাঁকে শোনানো হল ১৩ বছরের কারাদণ্ড। আলোকিত জীবনের শেষে আঁধার নামার ভয় তাঁকে নিয়ে যায় অন্ধকার কোঠরে। সেখানে তিনি কাটিয়েছেন দীর্ঘ প্রায় সাড়ে ছয়টি বছর। এ সময়ে গান শোনাই বাদ দিয়েছিলেন তিনি।

লুইস বলেন, ‘ আমি জেলে যাওয়ার পর মুহূর্তেই গান শোনা বন্ধ করে দিয়েছিলাম। কেননা ভিন্ন সুরের সাথে জড়িয়ে থাকে নানান সব স্মৃতি।’ লুইসের জীবনের উত্থান-পতন নিয়ে সাবেক ক্রিকেটার জেমস গ্রাহাম-ব্রাউন তাঁর ছদ্মনামে এক বই প্রকাশ করেছেন। শিরোনাম ‘ অ্যা লং ওয়ে ব্যাক’ সেই বইয়ের উপরে একটি নাটক মঞ্চায়ন করছেন অস্ট্রেলিয়ান পরিচালক দম্পতি শেন মরগান ও মইরা হান্ট।

নিজের সেই নাটক নিয়ে তিনি বলেন, ‘বর্তমানে আমি আমার জীবনে সবচেয়ে বেশি উচ্চাকাঙ্ক্ষী এবং আশাবাদী। এটা আমার জীবনকে ঘিরে, কি করে এখানে এলাম আমি, যে কিনা এক দশক আগেও ছিলাম একজন ক্রিকেটার। তারপর সেখান থেকে আমার প্রায় শেষই হয়ে যাচ্ছিল।’

নিজের জেল জীবনের কথা রোমন্থন করতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘আমার শুনানি শেষে আমি আমার বিছানায় বসে সেদিন প্রচন্ড কেঁদেছিলাম। এরপর আর কোনদিন আমি কাঁদিনি। নিজের মাথা থেকে এক দশকের বেশি জেল খাটার কথা ঝেড়ে ফেলতে আপনি পারবেনই না। আপনার তখন মাথায় সবচেয়ে বাজে চিন্তাটা আসবে। আমার মাথায়ও এসেছিল, আত্মহত্যার চিন্তার।’

লুইসের দাদী বেশ গর্ববোধ করতেন লুইসকে নিয়ে। তাই লুইসের মা এবং বোন সিদ্ধান্ত নেন যে তাঁরা লুইসের দাদীকে লুইসের এই পরিস্থিতি সম্পর্কে জানাবে না। লুইসের এক ভাই তাঁর নাম করে দাদীকে বড়দিনে টাকা পাঠাতেন। যাতে করে তাঁর দাদী আন্দাজ করতে না পারেন কি পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন তিনি। দাদীও ছিলেন লুইসের খুব পছন্দের একজন মানুষ। আফসোস দাদীর মৃত্যুর দিন তিনি থাকতেন পারননি তাঁর পাশে। ‘দুঃখের কথা সে যখন মারা যায় আমি তখন জেলের ভেতরেই ছিলাম’ লুইস বলেন।

সেই কথা বলার আগেই লুইস নিজের জেল জীবনের কথা মনে করে বলেন, ‘জেলে টয়লেটটা আপনার বিছানার পাশেই থাকে। আপনি কি চাইবেন অন্যকোন মানুষের মলত্যাগের দূর্গন্ধ সহ্য করতে? আমি চাইতাম না। আমি নিজেকে নিজের মত করে সময় দিতে চাইতাম দেখে একাই থেকেছি।’

একটা ভয়, একটা আলতো করে পাতা ফাঁদ একটি সুন্দর জীবনকে নিয়ে যেতে পারে নিকৃষ্টতম অভিজ্ঞতার দিকে। ক্রিস লুইসের জীবনের গল্প তো আমাদের সেই শিক্ষাটুকুই দেয়। আর বারবার মনে করিয়ে দেয় লোভে পাপ, আর পাপে মৃত্যু। লুইসের কাটানো জেল জীবন তো আর মৃত্যু থেকে কম কিছু ছিল না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link