এটা সেই সময়কার কথা, যখন ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগ (আইপিএল) নামক বিস্ময় গর্ভাবস্থার ফাইনাল স্টেজে। ২০০৮ সালের মার্চ মাস সেটা। আমি পড়ি ক্লাস সেভেনে। স্মার্টফোন নামক জিনিসটা তখন কষ্ট-কল্পনা। কাজেই ইশকুলে পৌঁছনোর পর খেলার স্কোর জানতে ভরসা একটাই, কিছু বন্ধু-বান্ধবের লুকিয়ে আনা ট্রানজিস্টার।
আর কখনো কখনো তাও না। স্কুল থেকে ফেরার পথে, আমাদের পুলকার যিনি চালাতেন সেই কাকুর মুখে খেলার খবর শুনতাম। আমাদের পুলকার ছিল এক ছোটোখাটো ক্রিকেটাড্ডার ঠেক। বাড়ির বকুনি অগ্রাহ্য করে তাই আমরা মোটামুটি সব খেলা দেখতাম। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে।
তা দক্ষিণ আফ্রিকা সেবার ভারতে এসেছে তিন টেস্টের সিরিজ খেলতে। প্রথম টেস্টেই বীরেন্দ্র শেবাগ দক্ষিণ আফ্রিকা কে এমন পেটানি দিলেন, যে ডেল স্টেইন, মরনে মরকেল, মাখায়া এনটিনি কিংবা পল হ্যারিসদের মুখগুলো দেখে আমাদেরও করুণা হচ্ছিলো। তা আহমেদাবাদে দ্বিতীয় টেস্ট যখন শুরু হল, আমাদের ধারণা ছিল আবার একটা জমজমাট ব্যাটিং দেখতে চলেছি।
আহমেদাবাদ টেস্ট যেদিন শুরু হয়, সেদিন আমাদের সেভেন থেকে এইটে ওঠার শেষ পরীক্ষা ছিল। কম্পিউটার । যেহেতু তখন কম্পিউটার নামক বিষয় ছিল আপাত গুরুত্বহীন (!), তাই সেই পরীক্ষার আগে টিভি দেখার অনুমতি ছিল। নিয়মমতো স্নান করে খেয়ে টিভি চালিয়েছি। দেখলাম ভারত টসে জিতে নিয়েছে ব্যাটিং।
পুলকার আসবে সারে দশটায়। তাই টেস্টের প্রথম ঘন্টা দেখেই বেরোতে পারবো। মনে তখন আনন্দের লাভা উদ্গিরণ হচ্ছে। সেহওয়াগের ব্যাটিং বেশ কিছুক্ষন দেখা যাবে। কিন্তু ভাঁড়ে মা ভবানী। পুলকার এসে যখন হর্ন দিচ্ছে, এখনও মনে আছে ভারতের স্কোর তিরিশের আশেপাশে, আর উইকেট তিন।
মনে আছে, গাড়িতে আমার আগে যাঁরা উঠে গেছেন, স্কোর জানার জন্যে তাঁদের অধীর আগ্রহে অপেক্ষমান মুখগুলোকে কি হতাশ লেগেছিলো স্কোর টা শুনে। কেউ কেউ আবার আশাবাদী, যে পিচটাই খারাপ। ভারত কম রানে আউট হয়ে গেলেও, দক্ষিণ আফ্রিকাকে চতুর্থ ইনিংস খেলতে হবে। আমরাও তার কথা শুনে, বেশ আশা নিয়েই পরীক্ষার হলে ঢুকেছিলাম।
দুপুর নাগাদ পরীক্ষা শেষ করে যখন পুলকার কাকুর থেকে স্কোর শুনেছিলাম, বজ্রাহত হয়েছিলাম বললে ভুল বলা হয়না। স্বাগতিক ভারত মোটে ৭৬ রানে অল-আউট। দক্ষিণ আফ্রিকা ২ উইকেটে ১০০ পেরিয়ে গেছে। আমি যে সময় থেকে খেলা দেখছি, এক ২০০৪ সালে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে হার ছাড়া, দেশের মাটিতে টেস্ট মানেই ভারত দারুণ কিছু করবে, এটা দেখে আসছি।
সেই প্রথম অস্ট্রেলিয়া ছাড়া অন্য দলের বিরুদ্ধে দেশের মাটিতে ভারতের লজ্জা প্রত্যক্ষ করলাম। সৌজন্যে ডেল স্টেইন নামে এক ভদ্রলোক। তীব্র গতি, স্মুথ অ্যাকশন, এবং অবশ্যই অব্যর্থ নিশানা। এই ত্রয়ীর জোরে উনি সবরমতির ধারের মাঠকে হাইভেল্ডের বুল রিংয়ে পরিণত করেছিলেন। ২০১০ সালে নাগপুরে যেমন পুরোনো বলে রিভার্স সুইং করে ঋদ্ধিমানের অভিষেক টেস্টে ভারতকে ভেঙেছিলেন, আহমেদাবাদে তা নয়।
নতুন বলের তারাবাজিতেই মাত হয় ভারত। কিশোর মনে স্টেনের ওই বোলিং, এতটাই প্রভাব ফেলেছিলো, যে পরবর্তী সাত-আট বছরে ওনার ক্যারিয়ার ফলো করে গেছি। নতুন বল, পুরোনো বল, ডিউক, কোকাবুরা, এস.জি – কোনোকিছুই ওনার দাক্ষিণ্য থেকে বঞ্চিত হয়নি।
মনে আছে পোর্ট এলিজাবেথে ২০১৪ সালে পুরোনো বলে একা শেষ করে দিয়েছিলেন অস্ট্রেলিয়াকে। সেটাও আমার দেখা ডেল স্টেইনের অন্যতম সেরা স্পেল। ৪০০’র কিছু বেশি তাড়া করতে নেমে ডেভিড ওয়ার্নার ও ক্রিস রজার্স ওপেনিংয়ে ১০০ ছাড়িয়ে গেছেন। সেই টেস্ট হারলে, দেশের মাটিতে সিরিজ এক ম্যাচ বাকি থাকতেই হেরে যাবে দক্ষিণ আফ্রিকা । সেখান থেকে ডেল স্টেইন একাই প্রায় ভাঙলেন অজিদের।
জীবনে একবারই লাল বলের ক্রিকেটে স্টেইনকে অসহায় মনে হয়েছিল। ২০১২ সালে ইংল্যান্ডের হেডিংলিতে। যখন কেভিন পিটারসেন চরম পিটিয়েছিলেন স্টেইনকে। দু’জনেই জন্মেছিলেন ২৭ জুন। স্টেইন ১৯৮৩ সালে। কেভিন পিটারসেন ১৯৮০। দু’জনই জন্মসূত্রে দক্ষিণ আফ্রিকান, কিন্তু মাঠে ছিলেন প্রতিপক্ষ।