‘কলম চুরি’ থেকে বিশ্বকাঁপানো রান আউট

জোসেফের শখ ছিলো ক্রিকেটারদের অটোগ্রাফ নেয়া। বাউন্ডারির এপাশ থেকে খাতা-কলম বাড়িয়ে দিলেই তো অটোগ্রাফ পাওয়া যাচ্ছে তাদের। এমন এক পরিস্থিতিতে জোসেফ খাতা-কলম বাড়িয়ে দিলেন অরবিন্দ ডি সিলভার দিকে। তিনি সাইন করলেন, কিন্তু দৌঁড়ে বাউন্ডারি এপারে ফেরত আসার সময় জোসেফের কলমটা ফিরিয়ে দিতে ভুলে গিয়েছিলেন।জোসেফ দৌঁড়ে মায়ের কাছে কাঁদতে কাঁদতে গিয়ে বলেছিল, ‘অরবিন্দ ডি সিলভা আমার কলম চুরি করেছে।’

টওন্টনের কাউন্টি গ্রাউন্ডের কথা আমাদের সবারই মনে থাকার কথা। সাড়ে আট হাজার ধারণ ক্ষমতার ছোট অথচ দৃষ্টিনন্দন এ মাঠেই ২০১৯ সালের বিশ্বকাপে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে প্রচণ্ড দাপুটে জয় পেয়েছিল বাংলাদেশ।

স্টেডিয়ামটা নির্মিত হয়েছিল ১৮৮১ সালে। তার ঠিক ১০২ বছর পর প্রথম আন্তর্জাতিক ম্যাচ মাঠে গড়ায় এখানে। তিরাশির বিশ্বকাপে কপিল দেবের ভারত আর দুলীপ মেন্ডিসের শ্রীলঙ্কা দলের মধ্যকার ম্যাচ দিয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে যাত্রা শুরু করে টওন্টনের কাউন্টি গ্রাউন্ড। কিন্তু যে ম্যাচের কথা বলবো, সেটা নিরানব্বই বিশ্বকাপের। ভারত ও শ্রীলঙ্কা- দু’দলই ততদিনে জিতে নিয়েছে বিশ্বকাপ। দু’পক্ষেই রয়েছে ঝাঁকে ঝাঁকে তারকা ক্রিকেটার।

সামারসেটের হোমগ্রাউন্ডে অর্থাৎ এই টওন্টনে আবারও মুখোমুখি ভার‍ত ও শ্রীলঙ্কা। আগের বিশ্বকাপের শিরোপাজয়ী দক্ষিণ এশিয়ার দ্বীপরাষ্ট্র শ্রীলঙ্কা। ভারতকে বিদায় করেই ফাইনালে উঠেছিল তারা। তাই ভারতের জন্যেও ম্যাচটা ছিলো এক প্রকার মর্যাদার লড়াই।

সেদিন দর্শকসারিতে উপস্থিত ছিল নয় বছর বয়সী ইংরেজ বালক জোসেফ। সেই ম্যাচে সৌরভ গাঙ্গুলী করেছিলেন ১৮৩, রাহুল দ্রাবিড় করেছিলেন ১৪৫। এই দু’জনের মুত্তিয়া মুরালিধরনের মত বোলারকে একহাত নেয়া, মাঠ ছাড়িয়ে বল নদীতে নিয়ে ফেলা- এসবই ছিল ছোট্ট জোসেফের প্রথম ক্রিকেটীয় স্মৃতি।

জোসেফের শখ ছিলো ক্রিকেটারদের অটোগ্রাফ নেয়া। বাউন্ডারির এপাশ থেকে খাতা-কলম বাড়িয়ে দিলেই তো অটোগ্রাফ পাওয়া যাচ্ছে তাদের। এমন এক পরিস্থিতিতে জোসেফ খাতা-কলম বাড়িয়ে দিলেন অরবিন্দ ডি সিলভার দিকে। তিনি সাইন করলেন, কিন্তু দৌঁড়ে বাউন্ডারি এপারে ফেরত আসার সময় জোসেফের কলমটা ফিরিয়ে দিতে ভুলে গিয়েছিলেন।

জোসেফ দৌঁড়ে মায়ের কাছে কাঁদতে কাঁদতে গিয়ে বলেছিল, ‘অরবিন্দ ডি সিলভা আমার কলম চুরি করেছে।’

টওন্টনের কাউন্টি গ্রাউন্ডে অরবিন্দ ডি সিলভা নিরানব্বই বিশ্বকাপে যার কলম চুরি করেছিলেন, বিশ বছর পর সেই জোসেফই লর্ডসে মার্টিন গাপটিলকে রানআউট করে সমগ্র ইংল্যান্ডকে ভাসিয়েছিলেন আনন্দে।

জোসেফ চার্লস বাটলার, জস বাটলার নামেই যিনি সমধিক পরিচিত৷ স্টুয়ার্ট ব্রড, মাইকেল ভনদের মতে যিনি ইংল্যান্ডের সর্বকালের সেরা সাদা বলের ক্রিকেটার৷

হবেনই বা না কেন? চল্লিশোর্ধ্ব গড়ধারী ব্যাটসম্যানদের মধ্যে ওয়ানডেতে বাটলারের চাইতে দ্রুতগতিতে রান তোলা ব্যাটসম্যান একজনও নেই। অনুমিতভাবেই ইংল্যান্ডের হয়ে একদিবসীয় ক্রিকেটে দ্রুততম শতকের কীর্তিটা তারই দখলে। অবাক হওয়ার পালা তখনই, যখন আপনি জানবেন যে, তালিকায় দ্বিতীয় নামটাও বাটলারেরই।

সমারসেট কাউন্টি দলে তার শুরুর দিকের সতীর্থ আলফনসো থমাস বলেছিলেন, ‘এবি ডি ভিলিয়ার্সের মধ্যে আমি যা দেখি, তাকে আমার কখনোই অতি-আত্মবিশ্বাসী মনে হয় না। বরং এটা তার সহজাত ক্ষমতা আর ইচ্ছাশক্তি। আমি যার মধ্যে এবির এই দুই গুণের সমন্বয় দেখি, সে হলো বাটলার।’

তখন অনেকেই হেসে উড়িয়ে দিলেও এখন আর তার উপায় নেই। বাটলারের পরিসংখ্যান আর ব্যাট হাতে তার অর্জন আলফনসো থমাসের উক্তির পক্ষেই কথা বলে।

বাটলার নিজেও ডি ভিলিয়ার্সের ভক্ত। গত আইপিএলে তাদের মধ্যে মোটামুটি কথাবার্তা হয়েছিল। তো ডি ভিলিয়ার্স কথায় কথায় বললেন, ‘এসো বিয়ার খেতে খেতে গল্প করা যাবে।’

বাটলার তো মহাখুশি৷ বাগদত্তা (বর্তমানে স্ত্রী) লোইসকে শিখিয়ে পড়িয়ে নিয়ে গেলেন, ‘দেখো, এটা কিন্তু আমার স্বপ্নের মত একটা সময়। ওখানে উল্টোপাল্টা কিছু বলে ফেলো না যেন।’

বাটলার ও ডি ভিলিয়ার্স কথা বলছেন। ডি ভিলিয়ার্স অবশ্যই ভারী দক্ষিণ আফ্রিকান বাচনভঙ্গিতে কথা বলেন৷ বিশ মিনিট মতো পার হওয়ার পর মুখ খুললেন লোইস, ‘আচ্ছা এবি, তোমার বাড়ি নিউজিল্যান্ডের কোন জায়গায়?’ বাটলার মুখ লুকোনোর জায়গা খুঁজছিলেন সম্ভবত।

তিনি সমারসেট ও ইংল্যান্ডের এই উইকেটরক্ষক ব্যাটসম্যান। সীমিত ওভারের ক্রিকেটে এযাবৎকালের সেরা ব্যাটসম্যানদের তালিকায় তাঁর নাম রাখতে আপনি বাধ্য। টেস্ট ক্রিকেটে নিজেকে পুরোপুরি হয়তো মেলে ধরতে পারেননি, তবে এই গ্রীষ্মে যতটুকু ব্যাটিং করেছেন, তাতে মনে হচ্ছে লাল বলের খেলাটায় সাদা বলের সাফল্যের পুনরাবৃত্তি করা তার জন্যে সময়ের ব্যাপার মাত্র।

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...