জিদান ও ১৯৯৮: একটি ফরাসি রূপকথা

নব্বই মিনিট পর থামে জিদান শো। লেস ব্লুসদের দেশটা তখন নিজেদের প্রথম বিশ্ব শিরোপার আনন্দে আত্মহারা। প্যারিস থেকে গোটা ইউরোপ কাপিয়ে দেওয়া উল্লাসে ধ্বনি-প্রতিধ্বনি। আলজেরিয়ান বংশদ্ভুত জিদান বনে গেলে ফ্রান্সের ইতিহাস রচনার নায়ক।

স্বপ্ন সবাই দেখে। তবে স্বপ্নটা সত্যি করবার সামর্থ্য বা ক’জনেরই থাকে! তবে যারা পারেন, তাঁরা বনে যান ধ্রুবতারা। ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা রয়ে যায় তাদের নাম। তেমনই এক নাম জিনেদিন জিদান। ফ্রান্সকে তিনি একত্রিত করেছেন ফুটবলের জাদুতে। ফ্রান্সকে তিনি দিয়েছিলেন নতুন এক দিনের শুরু। হাজারটা সমস্যার মাঝেও যেই জিদান ভেদাভেদ ভুলে সবাইকে ফান্সের সেই তিন রঙা পতাকাতলে নিয়ে আসতে পেরেছিলেন।

বছর ঘুরে আরও এক বিশ্বকাপ প্রায় দোর গোড়ায়। কতশত কিংবদন্তিদের নামই না বাতাসের সাথে ভেসে বেড়ায় পৃথিবীর এ প্রান্ত থেকে অপরপ্রান্তে। কতশত গল্প থাকে। কালজয়ী সব গল্প। না ঠিক গল্প বলা চলে না। এক একটি মহাকাব্য। সেসব কাব্যের প্রতিটি পরতে পরতে থাকে রাজ্যের ইতিহাস। তেমন এক ইতিহাসের কেন্দ্রবিন্দু তো জিনেদিন জিদানও।

আলজেরিয়ান বংশদ্ভুত জিনেদিন জিদান দ্বিতীয় প্রজন্ম হিসেবে জন্মেছিলেন ফ্রান্সে। দেশটা তখন নানা দেশি অধিবাসীদের দখলে। রাজনৈতিক পরিস্থিতিও খুব একটা অনুকূলে নেই। একতাবদ্ধ হবার তো প্রশ্নই ওঠেনা। ভিন্ন দেশের ঐতিহ্য বহন করা খেলোয়াড়দের দিয়ে গড়া একটি দল অন্তত ফ্রান্সকে প্রতিনিধিত্ব করতে পারে না বলেও মত। তবে সেই জিদান এই মতকে স্রেফ নব্বই মিনিট শেষে মুছে ফেলা ঘামে পরিণত করেছেন।

বৈচিত্র্যে ভরা দেশটাকে তিনি এক করেছেন। প্যারিসের থেকে মার্শেই, ফ্রান্সের প্রতিটা ঘরে তিনি ছড়িয়ে দিয়েছে ফুটবলের উন্মদনা। নতুন জাতিবাদ তত্ত্ব। শুধু এক অতীতের কারণে অন্তত কেউ ফ্রান্সের হয়ে নিজেকে বিলিয়ে দিতে পারবে না সেটা একদম ভুল প্রমাণ করেছেন মার্শেই শহরে জন্ম নেওয়া জিজুও। ছেলেবেলা মার্শেই শহরে বেড়ে ওঠা ছোট্ট ছোকড়া পরবর্তী সময়ে বনে গিয়েছেন ফ্রান্সের ‘পোস্টার বয়’। একটা বন্ধুর পথ পাড়ি দিয়ে তবেই সে অসাধ্য সাধন করা সম্ভব হয়েছিল।

১৯৯৮ সালে বিশ্বকাপ খেলতে যাওয়া ফ্রান্সের উপর ছিল দারুণ চাপ। আগের দুই আসরে তাঁরা ছিল না বিশ্বকাপের মহামঞ্চে। এমন এক সেট ব্যাকের পর নিশ্চয়ই বাড়তি একটা চাপ থাকে বিশ্বকাপে সুযোগ পাওয়ার জায়গাটা তৈরি করে নেওয়ার। ১৯৯৪ সালে ভরাডুবির পর এমি জ্যাকেট দলের দায়িত্বভার নেন। এর পরই তিনি দলকে একটু একটু করে সাজাতে শুরু করেন। একটা দলে পরিণত করতে শুরু করেন। সে দলের ২২ বছরের এক তরুণ ফুটবলার হিসেবেই আবির্ভূত হন জিনেদিন জিদান।

জিদানের ফুটবল ক্যারিয়ারটা হয়ত এমন গৌরবে ঠাসা হত না। যদি না কান ফুটবল ক্লাব তাঁকে দলে ভেড়াত। জিদানের মধ্যে থাকা ফুটবলীয় প্রতিভা প্রস্ফুটিত হওয়ার অন্যতম দাবীদার কান ফুটবল ক্লাব। সেখান থেকে বোর্ডও ফুটবল ক্লাব থেকে ইতালির জুভেন্টাস। এর পরের গল্প নিশ্চয়ই জানা সবার। তুরিন থেকে মাদ্রিদ। তবে তাঁর আগে ঘরের মাঠে ১৯৯৮ বিশ্বকাপ। প্রত্যাশাহীন একটা আসর। কেননা, দল ১৯৯৬ এর ইউরোতে হেরেছে সেমিফাইনালে।

সবাই ভেবেই বসল জ্যাকেট তাঁর দল নিয়ে পূর্ণ প্রস্তুত নয়। তবুও আগের দুই বারের আক্ষেপ ঘুচিয়ে নতুন এক বিশ্বকাপ জয়ের মিশনে নেমে পড়ে লেস ব্লুসরা। এর আগে অবশ্য জিদান নিজেকে জাতীয় দলে প্রতিষ্ঠিত করে ফেলেছেন। নিজের জাত চিনিয়ে বনে গিয়েছে ফ্রেঞ্চদের সকল পরিকল্পনার কেন্দ্রবিন্দু। বিশ্বকাপেও তাঁর ব্যত্যয় ঘটেনি। ১৯৯৮ এর এক শুক্রবার মার্শেইয়ের স্টেড দে ভেলোড্রমে ফ্রান্স শুরু করে নিজেদের বিশ্বকাপ যাত্রা। ঘরের মাঠ, তবে দেশের একটা বড় অংশের বিন্দুমাত্র প্রত্যাশা নেই দলটি উপর।

কিন্তু জিদান তো বিশ্বাস করতেন তিনি একদিন জেতাবেন বিশ্বকাপ। বর্ণবাদ, রাজনৈতিক নানান সমস্যার মাঝেও দলটা ফ্রান্সের হয়ে খেলতে নামল। দশ নম্বর জার্সিটা স্বাভাবিকভাবেই উঠেছিল জিদানের শরীরে। যে শহরের অলিতে-গলিতে খেলেছেন, স্বপ্নের দুরন্ত পথে এগিয়ে যাওয়ার শুরুটা করেছেন সেই শহরেই তিনি হাজির স্বপ্নের ফেরিওয়ালা হয়ে। দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে প্রথম গোলটায় ঢিলাঢালা জার্সি পড়া একটা ছেলে কর্ণার বাড়িয়ে দিল। সে বলটা জালে জড়াতে বিন্দুমাত্র ভুল করেননি ক্রিস্টোফি ডুগারি।

বাম কর্ণার থেকে বল বাড়িয়ে দেওয়া ছেলেটা আর কেউ নয় জিনেদিন জিদান। একটা রুপকথার শুরুটা সেখান থেকেই। ম্যাচটি জিতে নেয় ফ্রান্স। ব্যবধান ছিল ৩-০। তখনও প্রত্যাশার পারদে উত্তাপ অনুপস্থিত। তবে ফ্রেঞ্চ শিবিরে খানিকটা স্বস্তি। একটা সুন্দর শুরু। এই ইতিবাচক শুরুটা বয়ে নিয়ে যেতে হবে একবারে শেষ অবধি। দ্বিতীয় ম্যাচে আবারও জিদান। সৌদি আরবের সাথে জিদানের কল্যাণেই আবারও প্রথম অর্ধ শেষ হবার আগেই ১-০ তে এগিয়ে ফ্রান্স।

স্কোরার অবশ্য থিয়েরি অঁরি। কিন্তু কোচ জ্যাকেটের চিন্তার বিষয়টা ছিল ভিন্ন। তাঁর কড়া নির্দেশ খেলোয়াড়রা যেন কোন প্রকার রেড কার্ড হজম করে না বসেন। তবে জিদান খানিকটা রগচটাই ছিলেন। ২০০২ বিশ্বকাপে তাঁর বিখ্যাত হেড মারার ঘটনাটা নিশ্চয়ই কোন অজানা তথ্য নয়। কোচের আশঙ্কা সত্যি করে জিদান দেখে ফেললেন রেড কার্ড। তবে সেদিনটায় অবশ্য রেফারিদের হাত পকেটে গিয়েছে বহুবার। সৌদি খেলোয়াড় ফুয়াদ আমিনের উপর দাঁড়িয়ে যান জিদান।

চাইলেই হয়ত অগ্রাহ্য করা যেত। তবে কঠিন সিদ্ধান্তে এক মুহূর্ত দেরি করেননি রেফারি। জিজুও খানিকটা অবাক নয়নে তাকিয়ে রইলেন। তবুও কিছু করবার নেই। দুই ম্যাচের জন্য তিনি নিষিদ্ধ। গ্রুপ পর্ব নিয়ে চিন্তার কারণ নেই। তবে চিন্তাটা যে সুপার ১৬ রাউন্ড নিয়ে। সেখানে প্রতিপক্ষে প্যারাগুয়ের বিপক্ষে দারুণ বেগ পেতে হয় ফ্রান্সকে। সাইড লাইনে বসে স্নায়ুচাপের মহা সমুদ্রে হাবুডুবু খাচ্ছিলেন জিদান। তবে সে যাত্রায় বাঁচিয়ে দেন লরেন্ট ব্ল্যাঙ্ক। তাঁর করা গোল্ডেন গোলেই কোয়ার্টার ফাইনালে উঠে যায় ফ্রান্স। এর আগে গ্রুপ পর্বের শেষ ম্যাচে ডেনমার্কের বিপক্ষে ২-১ গোলে ম্যাচ জিতে নেয় জিদানের সতীর্থরা।

আবারও কারিগর মাঠে নামবার সুযোগ পেয়ে গেলেন। এই দফা প্রতিপক্ষ ইতালি। প্রচণ্ড গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচ। ওইদিকে দেশের অভ্যন্তরে ফ্রান্স ফুটবল দল নিয়ে নিয়ে উন্মদনা ছাপিয়ে যাচ্ছে জাতিবাদের সকল বৈরিতাকে। হাজারটা জাতির পরিচয় ভুলে গোটা দেশ মাতোয়ারা ফ্রান্সের ফুটবলে। তবে উন্মাদনার মাঝেও একটা চাপে চিন্তার উদ্রেক। প্যারাগুয়ে ভুগিয়েছে বেশ। পাওলি মালদিনি সংবলিত ইতালির সেই শক্ত প্রাচীর ফ্রান্স ভাঙবে কি করে?

তবে ভাঙা গেল না আজ্জুরিদের রক্ষণভাগ। নেপোলিয়ানের রণকৌশল তো ফ্রান্সেরও ভাল রপ্ত করা। গোল শূন্য ড্র নিয়ে খেলা গড়ালো পেনাল্টি শ্যুটে। প্রথম শ্যুটটা নিলেন জিজুও। আর এরপরই আকাশ পানে হাত তুলে জানান দিলেন নিজের উপস্থিতি। আস্থা রাখার একটা তীব্র বার্তা জানান দিলেন। ফ্যাবিয়ান বার্থেজের দৃঢ়তায় সে যাত্রায় ম্যাচটি জিতে যায় ফ্রান্স। প্রায় দেড় দশকের বেশি সময় পরে আবারও বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে ফ্রেঞ্চরা। একটা উৎসবের আমেজ শুরু হয়ে যায়।

১৫টি বছর পর আবারও দলটি দেশের মানুষকে এক করতে সক্ষম হয়। সেমিফাইনালে ক্রোয়াশিয়ার সাথে লড়াইটা হয়েছে জম্পেশ। ২-১ ব্যবধানে জেতা ম্যাচটির তদারকি করেছেন মাঝ মাঠ থেকে দশ নম্বর জার্সি পড়া লোকটি। ওই যে মার্শেই শহরে অধিবাসী বলে যারা তাঁকে খেপাতো তাঁরাও তো উচ্চস্বরে চেঁচিয়ে যাচ্ছে জিদান, জিদান বলে। এমনই বোধ হয়। এভাবেই ফুটবল পুরো একটা দেশকে এক করে। জাতিবাদের সকল বিভেদ ভুলে একটা পতাকা আকড়ে ধরতে সেখায়।

সেই পথটা দেখিয়ে দিয়ে হট ফেভারিট ব্রাজিলের মুখোমুখি ফ্রান্স। লোকমুখে শোনা যায় সেবার নাকি অনেক পরিকল্পনা করেই একটা রুপরেখা সাজানো হয়েছিল। যেখানে ফাইনালের আগে ব্রাজিলের মুখোমুখি হবে না ফ্রান্স। সত্য কিংবা মিথ্যা নিয়ে বহু আলোচনা হতে পারে। এমনকি মিশেল প্লাতিনি ফ্রান্সের কিংবদন্তি ফুটবলারও এমন আভাসের আগুনে বাতাস দিয়েছেন। সে যাই হোক।

জিনেদিন জিদান দৃঢ় প্রত্যয়ী ছিলেন। তিনি তাঁর স্বপ্ন পূরণে এক ছটাক ছাড় দিতে নারাজ। তাইতো ১৯৯৮ বিশ্বকাপের সেই ফাইনালটা আজও জিদানময়। ১৯৯৮ বিশ্বকাপের স্মৃতিতে এখনও জিদান উজ্জ্বল, বর্ণিল এক অধ্যায়। দু’টো কর্ণার, দু’টো হেড। ব্যাস! শেষ ওখানেই শেষ ব্রাজিলের সব আশা। ব্রাজিলের তারকায় ঠাসা দলটা নিস্তব্ধ। সে রাতে রবার্তো কার্লোস নিশ্চয়ই ঘুমোতে পারেননি। তাঁর দু’পায়ের ফাঁক গলে বল জড়িয়েছিল জালে। দ্বিতীয় গোলটায় নিশ্চয়ই তিনি নিজেকে দোষারোপ করেন।

নব্বই মিনিট পর থামে জিদান শো। লেস ব্লুসদের দেশটা তখন নিজেদের প্রথম বিশ্ব শিরোপার আনন্দে আত্মহারা। প্যারিস থেকে গোটা ইউরোপ কাপিয়ে দেওয়া উল্লাসে ধ্বনি-প্রতিধ্বনি। আলজেরিয়ান বংশদ্ভুত জিদান বনে গেলে ফ্রান্সের ইতিহাস রচনার নায়ক। নেপোলিয়নের পর নিশ্চয়ই ফ্রান্সের ইতিহাসে অন্যতম এক ব্যক্তিতে পরিণত হলেন জিজুও। যা কিছু প্রথম তা নিশ্চয়ই অবিস্মরনীয়! সাথে জিদানও।

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...