গত আসরের ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগে (আইপিএল) যদি ভারতীয় কোনো স্পিনার সবার নজর কেড়ে থাকেন তিনি হচ্ছেন বরুণ চক্রবর্তী। সাবেক অজি ব্যাটসম্যান মাইক হাসি যাকে উপাধি দিয়েছিলেন ‘নতুন রহস্যময় স্পিনার’ হিসেবে!
যিনি নিজের প্রথম আইপিএলেই রেকর্ড দামে বিক্রি হয়েছিলেন। পড়াশোনায় বেশ মেধাবী বরুন স্থাপত্যকলায় ডিগ্রি নিলেও খেলার টানে সবকিছু ফেলে চলে আসেন ক্রিকেটে! আর এক মৌসুমেই বনে গেলেন হিরো, ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগ থেকে সরাসরি জাতীয় দলে! তবে কেনো জানি ভাগ্য সহায় হচ্ছেনা এই স্পিনারের।
২৯ আগস্ট ১৯৯১, তামিল নাড়ুতে জন্ম নেন বরুণ চক্রবর্তী। পড়াশোনায় ছিলেন বেশ মেধাবী। চেন্নাইয়ের আর.এম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্থাপত্যকলায় নিয়েছেন ডিগ্রি। স্থাপত্যবিদ হিসেবে বেশ ক’বছর কাজও করেছিলেন তিনি। তবে ক্রিকেটের প্রতি ঝোঁক থাকায় স্থাপত্যকলায় ক্যারিয়ার না গড়ে সব ছেড়ে ছুটে আসেন ক্রিকেটের টানে।
১৩ বছর বয়স থেকেই ক্রিকেটার হবার ইচ্ছে, তখন অবশ্য উইকেটরক্ষক হিসেবেই খেলতে চাইতেন তিনি৷ অনেকটা সময় উইকেটের পেছনে কিপিং গ্লাভস হাতেই খেলেছেন বরুণ। পাড়ার ক্রিকেটে বেশ সুনামও ছিলো তাঁর।
বেশ প্রতিভাবান হলেও বয়স ভিত্তিক দলে বার বার তিনি উপেক্ষিত হতেন। বেশ কয়েকবার বয়স ভিত্তিক দলে সুযোগ না পাওয়ায় ক্ষোভে ক্রিকেট ছেড়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেন তিনি। বেশ কিছুদিন ছিলেন ক্রিকেটের বাইরে!
তবে ক্রিকেটের জন্য পিছুটান ছিলো বলেই হয়তো আবারো ফিরে আসেন বড় স্বপ্ন নিয়ে। যোগ দেন ক্রমবেস্ট ক্রিকেট ক্লাবে! তবে এবার নিজের মধ্যে বেশ পরিবর্তন আনলেন, উইকেটরক্ষক থেকে হয়ে গেলেন পেস অলরাউন্ডার। তবে এখানেও ব্যর্থ তিনি মাত্র ২ ম্যাচ খেলতেই চোটের কারণে লম্বা সময় চলে গেলেন মাঠের বাইরে!
চোট কাটিয়ে মায়ার টানে আবারো ফিরে আসেন ক্রিকেটে। এবার আরেক ধাপে নিজের মধ্যে পরিবর্তন আনেন! হয়ে খেলেন স্পিনার। দীর্ঘ সময় উপেক্ষিত আর ব্যর্থতার পর এবার যেনো তিনি পেলেন সাফল্যর মন্ত্র।
চেন্নাই লিগের চতুর্থ ডিভিশনে জুবিলি ক্রিকেট ক্লাবে যোগ দিলেন তিনি। এক মৌসুমে (২০১৭-১৮) ৩ ইকোনমি রেটে ৩১ উইকেট নিয়ে তাক লাগিয়ে দেন তিনি! ব্যাট হাতে তার ক্লাবের পক্ষে সেবার সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহকও ছিলেন তিনি। তার সাফল্যর শুরুটা যেনো এখান থেকেই এরপর তিনি শুধু সিড়ি বেয়ে উপরেই উঠেছেন!
তামিলনাড়ু প্রিমিয়ার লিগে মাদুরাই প্যান্থার্সকে শিরোপা জিতিয়ে সাড়া ফেলে দেন বরুন! ব্যাস, আইপিএলের নিলামে তার উপরই ছিলো আলাদা নজর। ২০১৯ আইপিএলের আসরের নিলামে অনেকটা যুদ্ধ করেই ৮ কোটি ৪০ লাখ রুপিতে তাঁকে দলে ভেড়ায় কিংস ইলেভেন পাঞ্জাব। যা কিনা আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে না আসা ভারতীয়দের মধ্যে তখন ছিলো সেরা দাম! অবশ্য ইনজুরিতে সেবার খেলতে পেরেছেন মাত্র এক ম্যাচ! তিন ওভার বল করে সে আসরে নিয়েছিলেন ৩৫ রানে মাত্র ১ উইকেট।
দীর্ঘ চড়াই-উৎরাই টপকে নিজেকে প্রমাণের বিশাল এক মঞ্চে এমন দূর্ভাগ্য জনক অবস্থা তিনি হয়তো দু:স্বপ্নেও ভাবেননি। এরপর নিজেকে আরো প্রস্তুত করে ফিরে এলেন ২০২০ আইপিএলের ১৩তম আসরে৷ পাঞ্জাব থেকে তাকে ছেড়ে দেওয়ায় আবারো নিলাম ডাকা হয় তাকে, তবে এবার বরুনকে কিনে নেয় কলকাতা নাইট রাইডার্স।
৬.৮৪ ইকোনমিতে ১৩ ম্যাচে ১৭ উইকেট! কলকাতার জার্সি গায়ে গত আসরে সবচেয়ে সেরা পার্ফরমারদের একজন হলেও বাকিদের হতাশাজনক পার্ফরমেন্সে দল পৌছুতে পারেনি প্লে অফে। তবে তার ভাগ্য পৌঁছে গিয়েছিলো জাতীয় দলে!
আইপিএলে নজরকাড়া পার্ফরম্যান্স দেখিয়ে জায়গা করে নিলেন অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে টি-টোয়েন্টি স্কোয়াডে! তবে দূর্ভাগার দূর্ভাগ্য, ইনজুরিতে ছিটকে গেলেন দল থেকে। জাতীয় দলের জার্সি গায়ে দেবার সুবর্ণ সুযোগ হাতছাড়া হলো তাঁর।
তবে কথায় বলে ‘সুযোগ বার বার আসে না’ – সেটিকে ভুল প্রমাণ করে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে টি-টোয়েন্টি সিরিজের জন্য আবারো ডাক পেলেন বরুন। তবে এবারো তার দূর্ভাগ্য! ইনজুরি কাটিয়ে ফিরলেও সম্পূর্ণ ফিট না থাকায় উৎরাতে পারেননি ফিটনেস টেস্ট। আর তাতেই জাতীয় দলে খেলার স্বপ্ন আপাতত স্বপ্নই রয়ে গেলো তাঁর। তাঁর বদলী রাহুল চাহার খেলার সম্ভাবনা রয়েছে চলতি ভারত-ইংল্যান্ড সিরিজে।
তবে বরুণের ফেলে আসা জীবনের গল্প শুনলে রূপকথার গল্প বলেই মনে হতে পারে। ক্রিকেট ছেড়ে স্থাপত্যকলায় যেয়ে আবারো ক্রিকেটে ফিরে আসাটা তার জন্য নতুন ‘অধ্যায়’। বরুণের ক্রিকেট খেলা শুরু হয়েছিল উইকেটরক্ষক হিসেবেই! কিন্তু নিজের প্রতিভা আর সামর্থ্য টা একটু দেরীতে হলেও বুঝতে পারায় বার বার তাঁর সামনে জাতীয় দলে খেলার সুযোগ কড়া নাড়ছে। ইনজুরির খোরাক কাটিয়ে হয়তো শ্রীঘ্রই অভিষিক্ত হবেন জাতীয় দলের জার্সিতে আর প্রমাণ করবেন ক্রিকেটে তার ফিরে আসার সিদ্ধান্তটা কতটা সঠিক ছিলো।