‘অস্পৃশ্য’ অর্জনের অতিমানব

বাবা হেনরির সাথে ক্যালিসের সম্পর্কটা ছিল বন্ধুর মত। তাঁর ক্রিকেটার হবার পেছনে বাবাই ছিলেন সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণা। ২০০৩ বিশ্বকাপের সময় হঠাৎ করেই বাবার ক্যান্সার ধরা পড়ে। জীবনের অন্তিম মুহূর্তে বাবার পাশে থাকতে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে টেস্ট সিরিজ থেকে সরে দাঁড়ান ক্যালিস। তাঁর বাবা মারা যান ৬৫ বছর বয়সে। বাবার মৃত্যুর পর ক্যালিসের জার্সি নম্বরও হয়ে যায় ৬৫।

ইতিহাসের একমাত্র ক্রিকেটার যার রয়েছে টেস্ট-ওয়ানডে দুই ফরম্যাটেই দশ হাজারের বেশি রান ও আড়াইশো’র বেশি উইকেট! শচীনের ‘সেঞ্চুরি’র সেঞ্চুরি, ব্র্যাডম্যানের ৯৯.৯৪ ব্যাটিং গড় কিংবা মুরালির ১৩৪৭ আন্তর্জাতিক উইকেটের মতোই তাঁর এই অর্জনকে মনে করা হয় ‘অস্পৃশ্য’। বলছিলাম আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ২৫ হাজারের বেশি রান এবং ৫শ’র বেশি উইকেটের মালিক, ‘তর্কযোগ্যভাবে’ সর্বকালের সেরা অলরাউন্ডার, প্রোটিয়া কিংবদন্তি জ্যাক হেনরি ক্যালিসের কথা।

ক্যালিসের ব্যাটিং পরিসংখ্যানের দিকে একবার তাকান। ১৬৬ টেস্টে ৫৫.৩৭ গড়ে ১৩২৮৯ রান, ৪৫টা সেঞ্চুরি, ৫৮টা হাফ সেঞ্চুরি। সাথে যোগ করুন ৩২৮ ওয়ানডেতে ৪৪.৩৬ গড়ে ১১৫৭৯ রান, ১৭টা হান্ড্রেড, ৮৬টা ফিফটি!

এবারে টেস্ট ক্রিকেটে সর্বাধিক রান সংগ্রাহকদের তালিকাটাও একবার দেখে নিন।

  • শচীন টেন্ডুলকার: ১৫,৯২১ রান, গড় ৫৩.৭৮
  • রিকি পন্টিং: ১৩,৩৭৮ রান, গড় ৫১.৮৫
  • জ্যাক ক্যালিস: ১৩,২৮৯ রান, গড় ৫৫.৩৭
  • রাহুল দ্রাবিড়: ১৩,২৮৮ রান, গড় ৫২.৩১
  • অ্যালিস্টেয়ার কুক: ১২,৪৭২ রান, গড় ৪৫.৩৫
  • কুমার সাঙ্গাকারা: ১২,৪০০ রান, গড় ৫৭.৪০
  • ব্রায়ান লারা: ১১,৯৫৩ রান, গড় ৫২.৮৮

লক্ষণীয় ব্যাপার হল, তালিকায় তৃতীয় স্থানে থাকা ক্যালিসই একমাত্র ‘অলরাউন্ডার’। অর্থাৎ একজন অলরাউন্ডার হয়েও তিনি সর্বকালের সেরা রান সংগ্রাহকদের একজন। সমসাময়িক গ্রেটদের মাঝে কেবল কুমার সাঙ্গাকারার গড়ই ক্যালিসের চেয়ে বেশি। আর সেঞ্চুরি সংখ্যায় ক্যালিসের (৪৫) উপরে আছেন কেবল শচীন টেন্ডুলকার (৫১)।

টেস্টে চার নম্বর পজিশনে কমপক্ষে ৭৫ ইনিংস খেলা ব্যাটসম্যানদের মধ্যে সেরা ব্যাটিং গড় জ্যাক ক্যালিসের। তিনি ৪ নম্বরে ব্যাট করেছেন ১৭০ ইনিংসে, রান করেছেন ৯০৩৩, গড় ৬১.৮৭, সেঞ্চুরি ৩৫টা। টেস্টে চার নম্বর পজিশনে ক্যালিসের চেয়ে বেশি রান আছে কেবল শচীন টেন্ডুলকারের। ২৭৫ ইনিংসে শচীনের সংগ্রহ ১৩৪৯২ রান, গড় ৫৪.৪০, সেঞ্চুরি ৪৪টা।

ক্যালিস ছিলেন একজন বিশুদ্ধ ক্লাসিকাল ঘরানার ব্যাটসম্যান। টেকনিকালি নিখুঁত, টেম্পারমেন্টালি দুর্দান্ত। তাঁর ডিফেন্স ছিল সলিড এবং কমপ্যাক্ট। সিগনেচার শট ছিল কাভার ড্রাইভ আর ‘ফ্লিক অফ দ্য হিপ’।

ব্যাটসম্যান হিসেবে ক্যালিসের সবচেয়ে বড় গুণ ছিল ধৈর্য্য, মন:সংযোগ, একাগ্রতা এবং দায়িত্ববোধ। নিজের উইকেটের সঠিক মূল্য দিতে জানতেন তিনি। বলা হয়ে থাকে যে, ‘No batsman ever priced his wicket more highly than Kallis.’

২০১২ সালে ‘দ্য টেলিগ্রাফ’ পত্রিকায় প্রকাশিত এক আর্টিকেলে সাবেক ইংলিশ অধিনায়ক মাইকেল ভন লিখেছিলেন, ‘As a technician, he is right up there with the likes of Dravid and Mahela Jayawardene. He has that calmness under pressure – facing spin or quick bowling – whether his team were in a difficult position or a good position.’

সাবেক উইজডেন সম্পাদক শিল্ড বেরির ভাষায়, ‘He’s not Brian Lara or Ricky Ponting in terms of aggression or flair but he is rock solid and, added to that, has every shot in the book. Also his cover drive and flick off the hip are right up there in terms of execution and attractiveness.’

এবার আসি ‘বোলার’ এবং ‘ফিল্ডার’ ক্যালিসের সার্থকতা প্রসঙ্গে। টেস্টে বল হাতে ক্যালিসের শিকার ৩২.৬৫ গড়ে ২৯২ উইকেট। ম্যাচে কখনও ১০ উইকেট পাননি। ইনিংসে ৫ উইকেট নিয়েছেন পাঁচবার। সেরা বোলিং ৫৪ রানে ৬ উইকেট।

এছাড়া ওয়ানডেতে ৩১.৭৯ গড়ে নিয়েছেন ২৭৩টি উইকেট। ম্যাচে যথাক্রমে চার ও পাঁচ উইকেট নিয়েছেন দু’বার করে। সেরা বোলিং ৩০ রানে ৫ উইকেট। ডানহাতি মিডিয়াম পেসার ক্যালিস ছিলেন ক্ল্যাসিক ‘হিট দ্য ডেক’ বোলার। একগাদা অলরাউন্ডারে ঠাসা প্রোটিয়া দলে ক্যালিসের রোলটা ছিল মূলত ফোর্থ সিমারের।

উল্লেখ্য, টেস্টে ‘ফোর্থ সিমার’ রোলে সবচেয়ে বেশি উইকেটের রেকর্ডটাও ক্যালিসের দখলে। ৩০.৭৪ গড়ে ক্যালিসের শিকার ১৩৯ উইকেট যা ‘ফোর্থ সিমারের’ ভূমিকায় টেস্ট ইতিহাসে সর্বোচ্চ।

ক্যালিসের ন্যাচারাল ডেলিভারি ছিল আউটসুইঙ্গার। তবে আচমকা বাউন্সার দিয়ে ব্যাটসম্যানদের অস্বস্তিতে ফেলতেন মাঝেমধ্যেই। বলে খুব বেশি গতি না থাকলেও সহায়ক পিচ-কন্ডিশন পেলে ভয়ঙ্কর হয়ে উঠতে পারতেন যে কোন সময়।

উইজডেনের ভাষায়, ‘Yet, bowling is by no means a minor arrow in his quiver, but a weapon always potent and sometimes destructive.’

সাবেক ইংলিশ পেসার অ্যাঙ্গাস ফ্রেজারের মতে, ‘It always amused me when people described him as a medium-pacer because he could bowl as quick as anyone when the mood was right.’

জ্যাক ক্যালিসকে মনে করা হয় ইতিহাসের সবচাইতে বিশ্বস্ত স্লিপ ক্যাচারদের একজন। টেস্টে ২০০ আর ওয়ানডেতে ১৩১ ক্যাচের পরিসংখ্যানই বলে দিচ্ছে তিনি ঠিক কতটা উঁচুমানের ফিল্ডার ছিলেন। টেস্টে তাঁর চেয়ে বেশি ক্যাচ আছে শুধুমাত্র রাহুল দ্রাবিড় (২১০) এবং মাহেলা জয়াবর্ধনের (২০৫)। উইজডেনের চোখে, ‘In the slips, he was safe as a bank; his rattlesnake reflexes make ridiculous catches look regulation.’

ক্যালিসের ফার্স্ট ক্লাস অভিষেক ১৯৯৩ সালে মাত্র ১৮ বছর বয়সে, ওয়েস্টার্ন প্রভিন্সের হয়ে। তার ঠিক দু’বছর পরই ইংল্যান্ডের বিপক্ষে টেস্ট অভিষেক। অবশ্য মনে রাখার মত কিছু করতে পারেন নি সে ম্যাচে।

ক্যালিসের টেস্ট ক্যারিয়ারের শুরুটা কিন্তু মোটেও সুবিধার ছিল না। প্রথম পাঁচ ম্যাচ শেষে ব্যাটিং গড় ছিল মাত্র ৮! অথচ দিন শেষে তাঁর ক্যারিয়ার গড় শচীন, লারা, দ্রাবিড়, পন্টিংদের ওপরে!

১৯৯৬ সালে ওয়ানডে অভিষেকটাও ইংল্যান্ডের সাথে। ১৯৯৬ বিশ্বকাপের মূল স্কোয়াডে ছিলেন। কিন্তু নিজেকে ঠিক সেভাবে মেলে ধরতে পারেন নি। ৪ ইনিংসে ব্যাট করার সুযোগ পেয়ে করেছিলেন মাত্র ৬৩ রান।

টেস্ট ক্যারিয়ারে প্রথম সেঞ্চুরির দেখা পান ১৯৯৭ সালে মেলবোর্নে। পঞ্চম দিনের ‘ভাঙা’ উইকেটে ওয়ার্ন-ম্যাকগ্রার মত বোলারদের সামনে দাঁতে দাঁত চেপে খেলেছিলেন ৩৫৭ বলে ১০১ রানের এক অসামান্য ‘ম্যাচ সেভিং’ ইনিংস। সেদিন ক্যালিস নাকি এতটাই অবিচল ছিলেন যে, উপুর্যপরি স্লেজিং করেও তাঁর মন:সংযোগে বিন্দুমাত্র চিড় ধরাতে পারে নি অজি ফিল্ডাররা। এক পর্যায়ে হতাশ হয়ে গ্রেগ ব্লিউয়েট নাকি বলেছিলেন, ‘ও কি বধির নাকি?’

১৯৯৮-২০০৩ পর্যন্ত সময়টাকে বলা যায় অলরাউন্ডার হিসেবে ক্যালিসের উত্থানকাল। ১৯৯৮ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত উইলস ইন্টারন্যাশনাল কাপের (পরবর্তীতে আইসিসি চ্যাম্পিয়নস ট্রফি) শিরোপা জিতেছিল দক্ষিণ আফ্রিকা। টুর্নামেন্টের সেমিফাইনাল এবং ফাইনালে ‘ম্যাচ সেরা’ হয়েছিলেন ক্যালিস। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে সেমিতে ১০০ বলে ১১৩ আর ফাইনালে উইন্ডিজের বিপক্ষে বল হাতে ৩০ রানে ৫ উইকেটের পাশাপাশি ব্যাট হাতে করেছিলেন ৪১ রান। যথারীতি ‘প্লেয়ার অফ দ্য টুর্নামেন্ট’-এর ট্রফিটাও উঠেছিল ক্যালিসের হাতে (১৬৪ রান ও ৮ উইকেট)।

১৯৯৯ সালে লারা-চন্দরপল-অ্যামব্রোসদের উইন্ডিজের বিরুদ্ধে কেপটাউন টেস্টে আরও একবার ব্যাটে-বলে ঔজ্জ্বল্য ছড়ান ক্যালিস। ব্যাট হাতে এক সেঞ্চুরি (১১০) আর এক ফিফটি (৮৮) ছাড়াও বল হাতে নেন ৭ উইকেট (২/৩৪ ও ৫/৯০)।ওয়েস্ট ইন্ডিজকে ৫-০ ব্যবধানে হোয়াইটওয়াশ করা ঐতিহাসিক সেই সিরিজে ক্যালিসের অবদান ছিল ৬৯.২৮ গড়ে ৪৮৫ রান এবং ১৭.৫৯ গড়ে ১৭ উইকেট।

১৯৯৯ বিশ্বকাপেও অলরাউন্ড পারফরম্যান্স দিয়ে সবার নজর কাড়েন ক্যালিস। ব্যাটিংয়ে ৫২ গড়ে ৩১২ রান করার পাশাপাশি বল হাতে নেন ৮ উইকেট।

২০০০-০১ মৌসুমে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে হোম সিরিজে ‘তৃতীয়’ দক্ষিণ আফ্রিকান অলরাউন্ডার হিসেবে (অব্রে ফকনার ও ট্রেভর গডার্ডের পর) এক সিরিজে আড়াইশ’র বেশি রান ও ২০ উইকেটের ‘ডাবল’ অর্জন করেন জ্যাক ক্যালিস।

২০০১ সালে প্রথমবারের মত টেস্ট-ওয়ানডে দুই ফরম্যাটেই আইসিসি র‍্যাঙ্কিংয়ে ‘এক নম্বর’ অলরাউন্ডারের জায়গা দখল করেন ক্যালিস। প্রায় তিন বছর একটানা এই শীর্ষস্থান ধরে রাখতে সমর্থ হয়েছিলেন তিনি।

২০০৩ সালের ‘হেডিংলি টেস্ট’ ছিল ক্যালিসের ক্যারিয়ারের স্মরণীয়তম ম্যাচগুলোর একটি। কেননা ব্যাট হাতে ব্যর্থ হলেও (৪১ ও ৬ রান) ক্যারিয়ার সেরা বোলিং দিয়ে (৯ উইকেট) ঠিকই নিজের জাত চিনিয়েছিলেন তিনি।

মূল স্ট্রাইক বোলার শন পোলকের অনুপস্থিতিতে বোলিংয়ে বাড়তি ‘ওয়ার্কলোড’ নিতে হয়েছিল ক্যালিসকে। হেডিংলি টেস্টের শেষ দিনে ইংল্যান্ডের দ্বিতীয় ইনিংসে ৫৪ রানে ৬ উইকেট তুলে নিয়ে দলকে দারুণ এক জয় পাইয়ে দিয়েছিলেন তিনি। এর আগে প্রথম ইনিংসে নিয়েছিলেন ৩৮ রানে ৩ উইকেট।

২০০৩-২০০৪ মৌসুমে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে পাঁচ ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজে ১৮০.৫০ গড়ে ক্যালিসের ব্যাট থেকে আসে ৩৬১ রান। এছাড়া বল হাতে নেন ৬ উইকেট। ওয়ানডের ক্যারিয়ার সেরা ১৩৯ রানের ইনিংসটাও খেলেন এই সিরিজেই। দক্ষিণ আফ্রিকা সিরিজ জেতে ৩-১ ব্যবধানে।

একই মৌসুমে টানা ৫ টেস্টে সেঞ্চুরি (১৫৮, ১৭৭, ১৩০*, ১৩০* এবং ১৫০*) হাঁকিয়ে বিশ্বরেকর্ড গড়েন জ্যাক ক্যালিস। এক সিরিজে সাত শতাধিক রানসহ দুই সিরিজ মিলিয়ে ৭ ম্যাচে করেন ১০৬৬ রান, ১১৮.৪ গড়ে। এছাড়া বল হাতে নেন ১২ উইকেট।

উল্লেখ্য, টেস্ট ইতিহাসে টানা ৬ ম্যাচে সেঞ্চুরি আছে কেবল ব্র্যাডম্যানের। আর ক্যালিস ব্যতীত টানা ৫ ম্যাচে সেঞ্চুরির রেকর্ড আছে শুধুমাত্র ভারতের গৌতম গম্ভীর ও পাকিস্তানের মোহাম্মদ ইউসুফের।

২০০৪-০৫ সিজনে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে পাঁচ ম্যাচের টেস্ট সিরিজে ৩ সেঞ্চুরিসহ ৬৯.৪৪ গড়ে ক্যালিসের ব্যাট থেকে আসে ৬২৫ রান। তবে বল হাতে ছিলেন ব্যর্থ। ৭৫.৭৫ গড়ে উইকেট নিতে পেরেছিলেন মোটে চারখানা! দক্ষিণ আফ্রিকা সিরিজ হেরেছিল ২-১ ব্যবধানে।

২০০৬-০৭ সিজনে পাকিস্তানের বিপক্ষে টেস্ট সিরিজ জয়ে (২-১) উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছিলেন ‘অলরাউন্ডার’ ক্যালিস। ব্যাট হাতে ৫৪.৪০ গড়ে ২৭২ রানের পাশাপাশি বল হাতে নিয়েছিলেন ১০ উইকেট। সিরিজ সেরার পুরস্কারটাও উঠেছিল ক্যালিসের হাতেই।

২০০৭ সালে টানা ৪ টেস্টে সেঞ্চুরি (১৫৫, ১০০*, ১০৭*, ১৮৬, ১৩১) হাঁকান জ্যাক ক্যালিস। ফলে স্যার ডন ব্র্যাডম্যান (৩ বার), কেন ব্যারিংটন ও ম্যাথু হেইডেনের পর ‘চতুর্থ’ ব্যাটসম্যান হিসেবে টেস্টে একাধিকবার টানা ৪ টেস্টে সেঞ্চুরির কীর্তি গড়েন ক্যালিস।

২০০৭ বিশ্বকাপে ৮০.৮৩ গড়ে দক্ষিণ আফ্রিকার পক্ষে সর্বোচ্চ ৪৮৫ রান করেন জ্যাক ক্যালিস। তবে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে হাইভোল্টেজ সেমিফাইনালে বাকি সবার মত ব্যর্থ ছিলেন ক্যালিসও; ব্যাট হাতে করেছিলেন মাত্র ৫ রান।

শচীনের মত ক্যালিসেরও টেস্টে ডাবল সেঞ্চুরি পেতে অপেক্ষা করতে হয়েছে দীর্ঘসময়। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ১৫ বছর অতিবাহিত করার পর অবশেষে ২০১০ সালে ভারতের বিপক্ষে সেঞ্চুরিয়ন টেস্টে আসে সেই ‘বহুল কাঙ্খিত’ ডাবল হান্ড্রেড (২০১*)। ক্যারিয়ারের ২য় ডাবলটি (২২৪) আসে ২০১২ সালে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে।

টেস্ট ক্যারিয়ারে মাত্র দুটি ডাবল সেঞ্চুরি হাঁকালেও ক্যালিস দেড় শতাধিক রানের ইনিংস খেলেছেন ১৪টি যা ইতিহাসে ষষ্ঠ সর্বোচ্চ। ২০১৩ সালের ২৫ ডিসেম্বর, ডারবানে ভারতের বিপক্ষে ক্যারিয়ারের শেষ টেস্ট খেলেন ক্যালিস। ক্যারিয়ারের ৪৫তম টেস্ট সেঞ্চুরিটাও (১১৫) পেয়ে যান সে ম্যাচে।

বেশিরভাগ মানুষই হয়ত ক্যালিসকে মনে রাখবে তাঁর রক্ষণাত্মক ব্যাটিং আর স্লো স্কোরিং রেটের কারণে। অথচ টেস্ট ইতিহাসে দ্রুততম ফিফটির রেকর্ডটাও একসময় নিজের করে নিয়েছিলেন ক্যালিস (২৪ বলে, জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ২০০৫ সালে)। শুধু তাই নয়, টেস্টে ক্যালিসের (৯৭) চাইতে বেশি ছক্কা মেরেছেন কেবল অ্যাডাম গিলক্রিস্ট (১০০), ব্রেন্ডন ম্যাককালাম (১০৬) ও ক্রিস গেইল (৯৮)।

রঙিন পোশাকেও ছক্কার সংখ্যাটা নেহায়েত কম নয়। ওডিয়াইতে দক্ষিণ আফ্রিকানদের মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ১৩৭টি ছক্কার মালিক ক্যালিস। ২০৪টি ছক্কা নিয়ে এক নম্বরে আছেন এবি ডি ভিলিয়ার্স।

অলরাউন্ডার হিসেবে ক্যালিসকে একটা সময় তুলনা করা হতো ইমরান, বোথাম, কপিলদের সঙ্গে। সমসাময়িক অ্যান্ড্রু ফ্লিনটফের সাথেও একটা ‘অলিখিত’ প্রতিযোগিতা চলত সবসময়। অথচ ক্যারিয়ার শেষে ‘সর্বকালের সেরা অলরাউন্ডার’ বিতর্কে ক্যালিসের প্রতিদ্বন্দ্বী শুধুমাত্র স্যার গ্যারি সোবার্স!

উল্লেখ্য, টেস্টে ক্যালিসের ব্যাটিং এবং বোলিং গড়ের পার্থক্য ২০-এর বেশি। টেস্টে এই কৃতিত্ব আছে শুধুমাত্র স্যার গ্যারি সোবার্স এবং ওয়ালি হ্যামন্ডের। রাহুল দ্রাবিড়ের মতে, ক্যালিস হচ্ছেন, ‘আমাদের সময়ের গ্যারি সোবার্স।’ মাহেলা জয়াবর্ধনে বলেছেন, ‘এ যুগের সেরা অলরাউন্ডার।’

কেভিন পিটারসেনের মতে, ‘সম্ভবত সর্বকালের সেরা ক্রিকেটার।’ পল কলিংউডের চোখে, ‘স্ট্যাটিস্টিক্যালি দ্য গ্রেটেস্ট অলরাউন্ডার এভার।’ অ্যালেক স্টুয়ার্টের মতে, “দ্য মোস্ট কমপ্লিট ক্রিকেটার অফ অলটাইম।’

ক্যালিসের অবসরের পর বিবিসিকে দেয়া এক সাক্ষাতকারে মাইকেল ভন বলেছিলেন, ‘Many of the great all-rounders – Sobers, Botham or, more recently, Flintoff – generally bat at five, six or seven. But Kallis has batted at three and four throughout his career in all forms of the game.’

১৯৯৭ সালে কাউন্টিতে মিডলসেক্সের হয়ে খেলার সময় ক্যালিসের সতীর্থ ছিলেন সাবেক পেসার অ্যাঙ্গাস ফ্রেজার। ক্যালিসের পেশাদারিত্বের প্রশংসা করে তিনি বলেন, ‘Jacques was very disciplined and committed. He had total devotion to being the athlete he needed to be.’

ক্যালিসের মত পরিপূর্ণ ক্রিকেটীয় দক্ষতাসম্পন্ন খেলোয়াড় ইতিহাসে খুব কমই এসেছেন। ক্যালিসের ‘গ্রেটনেস’ বোঝানোর জন্য জাস্ট কয়েকটা পরিসংখ্যান দিচ্ছি।

  • টেস্ট ইতিহাসে সর্বাধিক ‘ম্যাচ সেরা’র পুরস্কার জেতা ক্রিকেটারের নাম জ্যাক ক্যালিস (১৬৬ ম্যাচে ২৩ বার)। সবচেয়ে কাছাকাছি থাকা মুরালিধরন জিতেছেন ১৯ বার।
  • টেস্টে কমপক্ষে ৯০০০ রান করা ‘ব্যাটার’দের মধ্যে সবচেয়ে বেশি উইকেট নিয়েছেন জ্যাক ক্যালিস। শুনলে অবাক হবেন, ক্যালিসের (২৯২ উইকেট) নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী স্টিভ ওয়াহর উইকেটসংখ্যা মাত্র ৯২!
  • টেস্টে কমপক্ষে আড়াইশ উইকেট নিয়েছেন এমন বোলারদের মধ্যে সর্বোচ্চ রানের মালিক জ্যাক ক্যালিস (১৩২৮৯)। এমনকি ছয় হাজার রানও নেই কারো। সবচেয়ে কাছাকাছি থাকা কপিল দেবের (৫২৪৮) সাথে তাঁর রানের ব্যবধান ৮০৪১!
  • টেস্টে কমপক্ষে ১০০ উইকেট নেয়া বোলারদের মাঝে সর্বাধিক ক্যাচের মালিক জ্যাক ক্যালিস (২০০)। তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী টেস্টে ৭০৮ উইকেটের মালিক শেন ওয়ার্নের ক্যাচের সংখ্যা ১২৫!

শেষ করব একটি অন্যরকম তথ্য দিয়ে। বাবা হেনরির সাথে ক্যালিসের সম্পর্কটা ছিল বন্ধুর মত। তাঁর ক্রিকেটার হবার পেছনে বাবাই ছিলেন সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণা। ২০০৩ বিশ্বকাপের সময় হঠাৎ করেই বাবার ক্যান্সার ধরা পড়ে। জীবনের অন্তিম মুহূর্তে বাবার পাশে থাকতে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে টেস্ট সিরিজ থেকে সরে দাঁড়ান ক্যালিস। তাঁর বাবা মারা যান ৬৫ বছর বয়সে। বাবার মৃত্যুর পর ক্যালিসের জার্সি নম্বরও হয়ে যায় ৬৫।

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...