ফ্রাঙ্ক রাইকার্ড ও রুদ খুলিত: যৌথ জীবনের অজানা অধ্যায়

ফুটবল ইতিহাসের অন্যতম সেরা দল হিসেবে বিবেচনা করা হয় নেদারল্যান্ডসের ১৯৭৪ বিশ্বকাপের দলটিকে। অথচ ইয়োহান ক্রুইফ, রুড ক্রল, জোহান নেসকেন্সরা পারেননি জাতীয় দলকে শিরোপার স্বাদ এনে দিতে। বড়মঞ্চের পরীক্ষায় বারবারই আটকে গিয়েছেন তাঁরা।

তবে পেরেছিলেন রুড খুলিত- ফ্রাঙ্ক রাইকার্ড জুটি, ১৯৮৮ ইউরোতে নেদারল্যান্ডকে শিরোপা জিতিয়ে দেশবাসীকে এনে দিয়েছিলেন শিরোপার স্বাদ। এই দুইয়ে ভর করেই মহাদেশীয় শ্রেষ্ঠত্বের স্বাদ পেয়েছিল ডাচরা।

রুদ খুলিত আর ফ্রাঙ্ক রাইকার্ডের জুটি আসলে শুরু হয়েছিল তাঁদেরই জন্মের আগে থেকেই। তাঁদের বাবারা, জর্জ খুলিত এবং হেরম্যান রাইকার্ড দুজনেই ছিলেন সুরিনামের প্রতিভাবান স্ট্রাইকার। খেলতেন সুরিনামের দুই বিখ্যাত ক্লাবে। জর্জের ক্লাব ছিল ট্রান্সভাল, অন্যদিকে হেরম্যান খেলতেন এসভি রবিনহুডের। একই লিগে খেলায় দুই দলের মুখোমুখি ম্যাচে বেশ ক’বারই দেখা হয়েছিল দুজনের।

সেই সময়টাতে উন্নত জীবনের আশায় প্রায়ই আটলান্টিক পেরিয়ে ইউরোপে আসতো সুরিনামের মানুষ। অনেকেই নিজের নতুন আবাস গড়েছিল নেদারল্যান্ডসের রাজধানী আমস্টারডামে। ভাগ্যেই বোধহয় লেখা ছিল দুজনের জুটি, একই দিনে একই বন্দর থেকে একই জাহাজে চড়ে ভাগ্য পরিবর্তনের আশায় নেদারল্যান্ডসের উদ্দেশ্য পাড়ি জমান জর্জ আর হেরম্যান।

বিদেশ বিভূঁইতে এসে বদলে যায় দুজনের জীবন। হেরম্যান ফুটবলটাকেই আঁকড়ে ধরেন জীবিকা হিসেবে, খেলতে শুরু করেন আমস্টারডামের স্থানীয় ক্লাবের হয়ে।

জর্জ অবশ্য ইতি টানেন ফুটবল জীবনের, পড়ালেখা শুরু করেন ভ্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে। পড়াশোনা শেষের পর অর্থনীতির শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন স্থানীয় এক বিদ্যালয়ে। পরবর্তীতে আমস্টারডামেই জন্ম নেন ডাচ ফুটবল ইতিহাসের দুই কিংবদন্তি ফ্রাঙ্ক রাইকার্ড এবং রুদ খুলিত।

১৯৬২ সালে মাত্র এক মাসের ব্যবধানেই জন্ম হয়েছিল এই দুই ফুটবলশিল্পীর। গুলিতের পরিবার শুরুতে শহরের বাইরের দিকে থাকলেও তাঁর ফুটবল খেলার সুবিধার জন্য চলে আসে পশ্চিম আমস্টারডামে, বালবোয়া স্কয়ারে।

ধারণা করা হয়, এই বালবোয়া স্কয়ারেই প্রথমবার দেখা হয়েছিল এই দুই কিশোরের, যাদের পায়ের পরিবর্তিতে লেখা হয় ডাচ ফুটবলের রূপকথা। গুলিতই রাইকার্ডকে রাজি করান তাঁর একাডেমী এফসি ডওসে খেলার জন্য। সেখানেই পাঁচ বছর কাটানোর পর কিছুদিনের জন্য আলাদা হয় দুজনের জীবন। 

হারলেমের হয়ে ক্যারিয়ার শুরুর পর আর্সেনালে ট্রায়াল দিয়ে টিকতে পারেননি খুলিত। ফিরে আসেন এফসি আইন্দহোভেনে, সেখানে ডাচ লিগে রীতিমতো গোলের বন্যা বইয়ে দেন। ফলশ্রুতিতে এক মৌসুম পরই তাকে এসি মিলানে নিয়ে আসেন আরিগো সাচ্চি।

অন্যদিকে নেদারল্যান্ডসেরই বিখ্যাত ক্লাব আয়াক্সের হয়ে ক্যারিয়ার শুরু করেন রাইকার্ড। সেখানে সাত বছর কাটানোর পর যোগ দেন পর্তুগিজ ক্লাব স্পোর্টিং সিপিতে। কিন্তু সিপির হয়ে মৌসুমটা ভালো কাটেনি তাঁর। এসি মিলানে তখন ডাচ তারকাদের মিলনমেলা।

আগে থেকেই সেখানে ছিলেন বন্ধু ভন খুলিত, মার্কো ভন বাস্তেনরা। খুলিতের এক মৌসুম পরই তিনিও যোগ দেন এসি মিলানে। আরো একবার পুর্নমিলন ঘটে দুই বন্ধুর। 

এসি মিলানে দুজনে আরেক ডাচ ভ্যান বাস্তেনকে সাথে নিয়ে গড়ে তোলেন বিধ্বংসী এক ট্রায়ো। আরিগো সাচ্চির কোচিং এ সম্ভাব্য সকল ট্রফি জেতান মিলানের ক্লাবটিকে। টানা দুবার জেতান ইউরোপ সেরার খেতাব। তবে এই দুজনের মূল চ্যালেঞ্জ ছিল বোধহয় জাতীয় দলের হয়ে সাফল্য পাওয়া।

১৯৮৮ ইউরোর আগে তাই দুজনেই ছিলেন ভীষণ চাপে। সর্বশেষ ১৯৭৮ বিশ্বকাপের ফাইনাল খেলা বাদে দশ বছরে বলার মতো  কোনো অর্জন ছিল না ডাচদের। ইউরোর শুরুটাও বাজেভাবে হয়েছিল নেদারল্যান্ডের। ফেবারিট হয়ে শুরু করলেও প্রথম ম্যাচেই সোভিয়েত ইউনিয়নের কাছে হেরে বসে তারা। যদিও পরের দুই ম্যাচে যথাক্রমে ইংল্যান্ড আর আয়ারল্যান্ডকে হারিয়ে সেমির টিকেট পায় ডাচরা।

সেই দুই ম্যাচেই অনবদ্য ছিলেন এই জুটি, নিজেরা কোনো গোল না করলেও চারটি গোলেই অবদান ছিল এই জুটির। সেমিতে জার্মানি বাঁধা পেরিয়ে ফাইনালে ডাচরা মুখোমুখি হয়েছিল গ্রুপর্বে হেরে যাওয়া সোভিয়েত ইউনিয়নের। মিউনিখের অলিম্পিক স্টেডিয়ামে সেদিন অবশ্য বাঁধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি রাশানরা, শুরুতে গোল করে ম্যাচের সুর বেঁধে দিয়েছিলেন গুলিতই।

তাদের যুগলবন্দিতেই প্রথমবারের মতো মহাদেশীয় শ্রেষ্ঠত্বের স্বাদ পায় ডাচরা। আমস্টারডামের সেই অলিগলি থেকে শুরু হওয়া দুজনের যুগলবন্দী সেদিন আনন্দে ভাসিয়েছিল পুরো নেদারল্যান্ডসবাসীকে। 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link