যে মুকুটের রঙ ছিল ‘মেরুন’

রাজার প্রবেশ কি রাজকীয় হয়, তাই না? দৃপ্ত পায়ে এগিয়ে আসবেন, চারিদিক থেকে কয়েক হাজার চোখ তার দিকে বিস্ময়ের দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকবে।

রাজার প্রবেশ কি রাজকীয় হয়, তাই না? দৃপ্ত পায়ে এগিয়ে আসবেন, চারিদিক থেকে কয়েক হাজার চোখ তার দিকে বিস্ময়ের দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকবে। তিনি কোন কিছুই ভ্রুক্ষেপ করবেন না। তিনি নিজের আত্মবিশ্বাসী হেঁটে যাওয়াতে দেবেন মনোযোগ। বাকি সবাইকে অপেক্ষায় রেখে নিজের স্থান করবেন দখল। ক্রিকেট ময়দানেও এমন এক রাজকীয় প্রবেশের দৃশ্য মঞ্চায়িত হয়েছে, গেল শতাব্দীর ৭০-৮০’র দশকে।

সেই রাজকীয় ভঙ্গিমায় বাইশ গজে আসতেন ভিভিয়ান রিচার্ডস। পুরো নাম ছিল আইজ্যাক ভিভিয়ান অ্যালেক্সান্ডার রিচার্ডস। ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেটের স্বর্ণালী যুগে তিনি ছিলেন অন্যতম পথিকৃৎ। সাজঘর থেকে বাইশ গজে তার হেটে আসার ভঙ্গিমায় ছিল ‘আইকনিক’।

চুইংগাম চিবোতে, চিবোতে স্থিন বদনে তিনি আসতেন বাইশ গজে। গোটা স্টেডিয়াম জুড়ে একটা সমীহ করার মত আবহাওয়া। বিস্ময়ে ভরা প্রতিটি চোখ তাকিয়ে থাকত তার দিকে। তিনি এসে বোলারের দিকে ছুড়ে দিতেন জ্বালাময়ী আগ্রাসী এক দৃষ্টিবাণ। ব্যাস! সেখানেই ধূলিসাৎ হতো বোলারদের সকল আত্মবিশ্বাস, আর দীর্ঘদিন ধরে করা পরিকল্পনা।

পরিসংখ্যানের পাতায় চোখ বুলালে হয়ত ভিভ রিচার্ডসের নৃশংসতা বোঝা যাবে না। কেননা তার নামের পাশে বিশাল সব রানের অংক নেই। শতকের ছড়াছড়িও নেই পুরো ক্যারিয়ার জুড়ে। তবে যা আছে, তাও নেহায়েত কম নেই। বোলারদের ত্রাস ছিলেন স্যার ভিভিয়ান রিচার্ডস। তখনকার দিনে তার ওয়ানডে স্ট্রাইকরেট ছিল প্রায় ৯০.২০।

তখনকার সময়ে ক্রিকেটে ছিল না ‘ফিল্ড রেস্ট্রিকশন’। সে সময়ে ছিল না ব্যাটিং সহায়ক উইকেট। ছিল পেসারদের আগ্রাসন। ছিল প্রতিকূল পরিবেশ। ব্যাটাররা স্রেফ বাইশ গজে টিকে থাকতে চাইতেন। কোন মতে বোলারদের বাউন্সার এড়িয়ে যেতে চাইতেন।

কিন্তু ভিভ রিচার্ডস ছিলেন ভিন্ন ধাঁচের। তিনি সময়ের বহু আগের ক্রিকেটটাই খেলে গেছেন তখনকার সময়ে। সেই বৈরি পরিবেশেও তিনি বোলারদের আতংকের কারণ হতে পেরেছিলেন। তিনি হতে পেরেছিলেন বিশ্ব ক্রিকেটে সেরাদের একজন।

বিশ্বের সেরা অলরাউন্ডারদের একজন স্যার ইয়ান বোথাম। তিনি বলেছিলেন, ‘তার (ভিভ) চেয়ে ভাল খেলোয়াড় কখনো হয়নি’। এই কথাটাই অন্তত প্রমাণ করে ঠিক কতটা কার্যকর ছিলেন তিনি। এমনকি পাকিস্তানের অন্যতম পেসার ওয়াসিম আকরাম ভীষণ পীড়ায় থাকতেন ভিভ রিচার্ডসের বিপক্ষে।

তিনি বলেছিলেন, ‘মর্টিন ক্রো, গাভাস্কারদের বিরুদ্ধে বল করা কঠিন ছিল কিন্তু ভিভ কে বল করতে গেলে রীতিমত গলা শুকিয়ে আসত আমার’। তাতেও প্রমাণিত হয় ঠিক কতটা ভয়ংকর ব্যাটার ছিলেন তিনি। দীর্ঘ একটা ক্যারিয়ার তার। প্রায় ১৭টা বছর ধরেই তার সাম্রাজ্য়ের বিস্তার। তিনি যেন আলাদা একটা পরিমণ্ডল তৈরি করে ফেলেছিলেন, একান্ত নিজের।

ক্যারিয়ারে দুইটি বিশ্বকাপ জিতেছেন স্যার ভিভিয়ান রিচার্ডস। ১৯৭৫ ও ১৯৭৯ বিশ্বকাপ গিয়েছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজের ঘরে। ১৯৭৯ বিশ্বকাপের ফাইনাল অনুষ্ঠিত হয়েছিল লর্ডসে। সেখানে স্বাগতিক ইংল্যান্ডের শিরোপা জয়ের সকল স্বপ্ন একা হাতেই মাটিচাপা দিয়েছিলেন ভিভিয়ান রিচার্ডস। ১৩৮ রানে ছিলেন অপরাজিত। ইংল্যান্ডের হাতের নাগাল থেকে ছিনিয়ে নিয়েছিলেন বিশ্বকাপ।

ক্যারিয়ারে ৫০ এর একটু বেশি গড়ে রান করেছেন টেস্ট ক্রিকেটে। আগ্রসনের সাথে ধারাবাহিকতাও ছিল তার নিত্যদিনের সঙ্গী। ২৪ সেঞ্চুরিতে টেস্ট ক্রিকেটে ৮৫৪০ রান করেছেন ক্যারিবিয়ান এই দানব। ওয়ানডেতে রয়েছে ১১টি সেঞ্চুরি, মোট রান তার ৬৭২১।

ক্রিকেটের এই আধুনিক যুগে, সম্ভবত সবাই আফসোস করে। ব্যাটিং প্যারাডাইসে দাঁড়িয়ে ভিভিয়ান রিচার্ডস ঠিক কতটা ভয়ংকর হতে পারতেন- সেটার একটা কাল্পনিক খেয়াল ভেসে বেড়ায় ভিভিয়ান রিচার্ডসের খেলা সামনে থেকে দেখা ভক্তদের চোখে। ঠিক পরক্ষণে জায়গা করে নেয় তার সেই সিংহের মত চলন, হেলমেটহীন মেরুন ক্যাপে বোলারের দিকে তাকিয়ে থাকা সেই আগ্রাসন।

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...