বাবর-রিজওয়ান ‘বিচ্ছেদ’

নিয়মিতই বড় রানের জুটি গড়লেও সময় গড়ানোর সাথে সাথেই বেরিয়ে পড়েছে এই জুটির দুর্বলতা। পাওয়ারপ্লে কাজে না লাগানো কিংবা রান রেটের সাথে পাল্লা দিয়ে রান তুলতে না পারার মতো অভিযোগ উঠেছে এই জুটির বিপক্ষে। 

২০২১ সালের শুরুতে পাকিস্তান সফরে আসে দক্ষিণ আফ্রিকা। টেস্ট এবং ওডিয়াইয়ের পাশাপাশি সেই সফরে তিনটি টি টোয়েন্টিও খেলেছিল প্রোটিয়ারা। সেই সফরেই প্রথমবারের মতো ইনিংসের উদ্বোধন করতে দেখা গিয়েছিল বাবর আজম ও মোহাম্মদ রিজওয়ান জুটিকে। নিয়মিতই বড় রানের জুটি গড়লেও সময় গড়ানোর সাথে সাথেই বেরিয়ে পড়েছে এই জুটির দুর্বলতা। পাওয়ারপ্লে কাজে না লাগানো কিংবা রান রেটের সাথে পাল্লা দিয়ে রান তুলতে না পারার মতো অভিযোগ উঠেছে এই জুটির বিপক্ষে। 

দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে শুরুতে সফল না হওয়ায় নিজেকে তিন নম্বরে নামিয়ে আনেন বাবর। কিন্তু এক মাস পরই পাকিস্তানের দক্ষিণ আফ্রিকা সফরের সময় আবারো ওপেনিং এ ফিরেন। সেঞ্চুরিয়নে সিরিজের দ্বিতীয় টি টোয়েন্টিতেই নিজের সিদ্ধান্তের যৌক্তিকতা প্রমাণ করেন তিনি। সে ম্যাচে প্রোটিয়াদের দেয়া ২০৩ রানের লক্ষ্যমাত্রা আঠারো ওভারেই পেরিয়ে যায় পাকিস্তান।

বাবর ৫৯ বলে ১২২ রান করে আউট হলেও রিজওয়ান অপরাজিত থাকেন ৪৭ বলে ৭৩ রানের দারুণ এক ইনিংস খেলে। ইংল্যান্ড সফরেও অব্যাহত থাকে তাদের রানের ধারা, ট্রেন্টব্রিজে তাদের ৮৮ বলে ১৫০ রানের জুটির সুবাদে জয় পায় পাকিস্তান। ফলে ২০২১ টি টোয়েন্টি বিশ্বকাপেও একই উদ্বোধনী জুটি নিয়ে খেলতে যায় তাঁরা।

পাকিস্তানের ওপেনিং জুটির এই মধুচন্দ্রিমা চলে প্রায় দেড় বছর। এই সময়ে ২৯ ম্যাচে এই দুজন মিলে যোগ করেন ১,৩৩৩ রান। কমপক্ষে ১০০০ রান করা জুটির মাঝে তাদের ৪৭.৬০ গড় দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। তাদের পাঁচ শতরানের পার্টনারশিপ টি টোয়েন্টি ইতিহাসেরই সবচেয়ে বেশি। এরমধ্যে চারবারই তারা ছাড়িয়েছেন ১৫০ রানের কোটা। 

শুনে খুবই দুর্দান্ত লাগছে না? আসলে পরিসংখ্যানের হিসেবে সংখ্যাগুলো দুর্দান্ত হলেও ম্যাচের ফলাফল নির্ধারণে তা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারছে না। এই সময়টাতে বাবর- রিজওয়ান জুটি রান করেছেন ওভারপ্রতি ৭.৯৬ হারে। কমপক্ষে ৭০০ রান করেছেন এমন জুটির ক্ষেত্রে এই রানের হার টি টোয়েন্টি ইতিহাসেরই সর্বনিম্ন। শুরুতে কিন্তু এই জুটি রান তোলার ক্ষেত্রে এতটা ধীরে শুরু করেনি।

গত টি টোয়েন্টি বিশ্বকাপে ভারতের বিপক্ষে দশ উইকেটের বিখ্যাত সেই জয়ের আগে এই জুটি রান করেছেন ওভারপ্রতি প্রায় সাড়ে আট করে। ততদিন পর্যন্ত তাদের জুটিটা একটা সহনীয় পর্যায়ে ছিল। এরপরই হঠাৎ করে রান তোলার গতিতে ধ্বস নামে। নিউজিল্যান্ডের সাথে ৩১ বলে ২৮, আফগানিস্তানের বিপক্ষে ১২ বলে ১৫, স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে ৩৭ বলে ৩৫, অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ৬০ বলের ৭১ রানের জুটিগুলোই প্রমাণ করে কতটা ধীরগতির ব্যাটিং করেছেন এই জুটি। 

বিশ্বকাপের এক সপ্তাহ পরই বাংলাদেশের বিপক্ষে সিরিজের এক ম্যাচে ৭৩ বলে গড়েন ৬০ রানের জুটি। এরপর থেকেই তাদের রান তোলার গতি আর পূর্বের মতো বাড়াতে পারেননি। ভারতের বিপক্ষে সেই ম্যাচের পর থেকে এই জুটি রান তুলেছেন ৭.১২ হারে, যা কিনা পূর্বের তুলনায় ২০ শতাংশ কম।

অবশ্যই প্রজন্মের দুই ব্যাটসম্যানকে কেবল স্ট্রাইকরেট দিয়ে বিবেচনা করা ঠিক হবে না। কিন্তু ঘটনাটা আরো গভীর। আগে ব্যাট করেছেন এমন ম্যাচে এই জুটি রান করেছেন ৭.৭৩ হারে, যা কিনা তাদের টোটাল রান তোলার হারের চাইতেও কম। ২০২১ টি টোয়েন্টি বিশ্বকাপের পর থেকে যা নেমে দাঁড়িয়েছে ৭.০৯। 

এতক্ষণের পরিসংখ্যানগুলো ছিল যতক্ষণ পর্যন্ত তারা দুজনেই ক্রিজে ছিলেন। তাদের পরিসংখ্যান কেমন দাঁড়াবে তাদের একজন আউট হয়ে যাবার পর। তাদের ব্যক্তিগত পরিসংখ্যান কি বলে? 

ওপেনার হিসেবে বাবর ১৩২ স্ট্রাইক রেটে করেছেন ১,৯৮০ রান। অন্যদিকে ১৩১ স্ট্রাইক রেটে  রিজওয়ানের সংগ্রহ ১,৭৫৮ রান। টি টোয়েন্টি ইতিহাসে তারাই চতুর্থ এবং পঞ্চম ধীরগতিতে ব্যাট করা ওপেনার। তাদের উপরে থাকা তিনজনের মাঝে তিলকরত্নে দিলশান এবং তামিম ইকবাল ইতোমধ্যেই অবসর নিয়ে ফেলেছেন।

অন্যদিকে দ্বিতীয় স্থানে থাকা শিখর ধাওয়ান ২০২১ সালের পর থেকে এখনো টি টোয়েন্টিতে মাঠে নামেননি। তাদের কাছাকাছি স্ট্রাইকরেটে ব্যাট করেছেন জেসন রয়(১৩০ স্ট্রাইকরেয়াত) এবং ইশান কিষাণ(১৩৩ স্ট্রাইকরেট)। যারা দুজনেই ইতিমধ্যেই বাদ পড়েছেন নিজ নিজ দলে বিশ্বকাপ স্কোয়াড থেকে।

উদ্বোধনী জুটির দুজনের মাঝে যেকোনো একজন মারমুখী হয়ে খেললেই রানের চাকা সচল রাখা সম্ভব। এই সময়টাতে বাবর ৩০ রান করতে খরচ করেছেন ২৩ বল। অন্যদিকে রিজওয়ানের ৪৯ রান করতে খেলতে হয়েছে ৩৮ বল। তারা দুজনে মিলে ৬০ বল খেলে সংগ্রহ করেছেন ৮০ রান। মোটামুটি ইনিংসের অর্ধেক বল খেলে ফেলার পর তাদের এই সংগ্রহ মারকাটারি ক্রিকেটের এই যুগে খুবই নগন্য।

তর্ক হতে পারে বাবর-রিজওয়ানের দীর্ঘ এই জুটি পাকিস্তানকে শেষ দিকে হাত খুলে খেলার স্বাধীনতা দিচ্ছে। কিন্তু সত্যি বলতে পাকিস্তানের মিডল অর্ডার সেই সুযোগটা নিতে পারছে না। ইফতেখার আহমেদ, খুশদিল শাহ কিংবা আসিফ আলিরা পারেননি ধারাবাহিকভাবে বড় সংগ্রহ এনে দিতে। বিশেষ করে এশিয়া কাপ ফাইনালে ওপেনিং জুটির বেশি বল খেলে ফেলার ধাক্কাটা সামলে উঠতে পারেনি মিডল অর্ডার। ফলশ্রুতিতে পাকিস্তানকে সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছে রানার্স আপ হয়েই। 

বিশ্বকাপ শুরুর ঠিক আগ মূহুর্তে এসে পাকিস্তানকে দলে ভারসাম্য আনতে হবে। বোঝাই যাচ্ছে পাকিস্তানের জন্য কোনোকিছুই এই মুহূর্তে ঠিকঠাক যাচ্ছে না। বাবর-রিজওয়ানের যেকোনো একজনকে তাদের স্বরূপ থেকে বের হয়ে আসতে হবে, দলের স্বার্থে নিজের উইকেট ঝুঁকিতে ফেলে আগ্রাসী ব্যাটিং করতে হবে। অন্যথায় এবাবের বিশ্বকাপে পাকিস্তানের জন্য কঠিন সময় অপেক্ষা করছে।  সময় কিন্তু ফুরিয়ে আসছে পাকিস্তানের।

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...