ভারতের ক্রিকেটের স্বনামধন্য কোচ রমাকান্ত আচরেকার। তাঁর হাত ধরেই উঠে এসেছিল শচীন টেন্ডুলকার কিংবা বিনোদ কাম্বলিদের মত ব্যাটসম্যানরা। গুরু রমাকান্ত আচরেকারের আরেকজন প্রিয় ছাত্রও ছিলেন। যিনিও ভারতের হয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলেছেন।
তবে, প্রতিভাবান প্রবীন আম্রে ভাগ্যের ফেরে হতে পারেননি সেরাদের একজন। তবে নিজে না পারলেও ভারতকে উপহার দিতে চান নিখুঁত এক ব্যাটসম্যান। শচীনের মত ব্যাটসম্যান হতে না পারলেও প্রবীন আম্রে হয়তো রমাকান্ত আচরেকার মত একজন গুরু হয়ে উঠবেন। এটাই হবে তাঁর গুরুদক্ষিণা।
১৯৬৮ সালের ১৪ আগস্ট মুম্বাই শহরে জনগ্রহণ করেন প্রবীন আম্রে। মুম্বাই শহরের দাদারে অবস্থিত বিখ্যাত শিবাজি পার্ক। এখানেই গুরু রমাকান্ত আচরেকার তৈরি করেছিলেন শচীন টেন্ডুলকারের মত ক্রিকেট রত্ন কে। এছাড়াও এখান থেকে বের হয়েছে অজিত ওয়াদেকার, বিজয় মাঞ্জরেকার কিংবা হালের পৃথ্বীশ’র মত বিখ্যাত ক্রিকেটাররা। এই শিবাজি পার্কেই ছোট বেলা থেকে ক্রিকেট খেলতে যেতেন প্রবীন আম্রে।
তবে ছোট প্রবীন আম্রে ব্যাটিং, বোলিং কোনটাই পেতেন না। শিবাজি পার্কে টানা দুই বছর শুধু ফিল্ডিং করেছেন। তাঁর এই একাগ্রতা থেকে কেউ একজন রমাকান্ত আচরেকারকে অনুরোধ করেছিলেন ছেলেটাকে একটু দেখতে। সেদিন থেকেই ব্যাটসম্যান প্রবীন আম্রের পথচলা শুরু হয় গুরু রমাকান্ত আচরেকারের হাত ধরে।
সেই ছোটবেলা থেকেই বড় ইনিংস খেলতে পছন্দ করতেন প্রবীন আম্রে। তবে প্রথম নজরে আসেন ১৯৮৩ সালে প্রথম যখন মুম্বাই অনুর্ধব-১৫ দলের হয়ে ডাক পেলেন। ১৪ বছরের প্রবীন আম্রে নিজের প্রথম ম্যাচেই খেললেন ১১৫ রানের ইনিংস। পরের বছরই আবার বোম্বে স্কুলের হয়ে ২৫৪ রানের বিশাল এক ইনিংস খেলেছিলেন। তখন থেকে বয়সভিত্তিক ক্রিকেটে এক পরিচিত মুখ হয়ে উঠেছিলেন প্রবীন আম্রে।
রমাকান্ত আচরেকারের কাছে বেড়ে উঠলেও ১৮ বছর বয়সে রেলওয়ে থেকে ডাক আসে এই ব্যাটসম্যানের। তখন মুম্বাইয়ের তারকা বহুল দলে কারো জায়গা পাওয়াটা খুবই কঠিন। সেই সময়ে সুনীল গাভাস্কারও এই মুম্বাইয়ের হয়েই খেলতেন। এছাড়া রেলওয়ের মোটা বেতনও সেই সময় একটা বড় বিষয় ছিল। ফলে রমাকান্ত আচরেকার নিজেই প্রবীন আম্রে উপদেশ দিয়েছিলেন রেলওয়ের হয়ে খেলার জন্য।
রেলওয়ের হয়ে নিজের প্রথম ম্যাচেই ১৮৬ রানের ইনিংস খেলেন। ফলে দ্রুতই ভারতের অনুর্ধব-১৯ দলে ডাক আসে তাঁর। পরের দুই বছর রেলওয়ের হয়ে ১০ টি ম্যাচ খেলে ৮৫ গড়ে ৭৬৫ রান করেছিলেন। এরপর ইরানি ট্রফিতে ২৪৬ রেস্ট অব ইন্ডিয়ার বিপক্ষে তাঁর ২৪৬ রানের ইনিংস আম্রের ক্যারিয়ারের মোড় ঘুড়িয়ে দিয়েছিল।
তখন তিনি শুধু আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের অপেক্ষায় আছেন। শেষ পর্যন্ত ১৯৯১ সালে সেই মহেন্দ্রক্ষণ এলো। দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ওয়ানডে দলে ডাক পেলেন। তবে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে তাঁকে খেলানো হবে কিনা সেটা নিয়ে অনেক আলোচনা হয়েছিল। কেননা ধারণা করা হতো প্রবীন আম্রে স্পিনটাই ভালো খেলেন। পেস বোলিং এ তাঁর বেশ দুর্বলতা আছে। যদিও সেই ধারণা নিজের টেস্ট ও ওয়ানডে অভিষেকেই ভুল প্রমান করেছিলেন আম্রে।
১৯৯১ সালে ইডেন গার্ডেন্সে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে নিজের অভিষেক ম্যাচেই ছয় নম্বরে ব্যাট করতে নেমে ৫৫ রানের ইনিংস খেলেন। এরপর দক্ষিণ আফ্রিকা সফরের জন্যও তাঁকে টেস্ট দলে ডাকা হয়। তবে এবারো সেই একই আলোচনা। দক্ষিণ আফ্রিকার পেস বোলিং কন্ডিশনে, আফ্রিকার পেসারদের বিপক্ষে আম্রে কতটুকু কার্যকর হবেন।
১৯৯২ সালের দক্ষিণ আফ্রিকার মাটিতে নিজের টেস্ট অভিষেক ম্যাচেই খেলেন ১০৩ রানের ইনিংস। নিজের টেস্ট অভিষেকেই বিদেশের মাটিতে সেঞ্চুরি করার কীর্তি করেন এই ব্যাটসম্যান। এরপর দেশের মাটিতে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে বেশ ভালো খেলেন তিনি। তবে ১৯৯৪ সালে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে একটি বাজে সিরিজের পরেই তাঁকে দল থেকে বাদ দেয়া হয়।
এরপর ২০০০ সাল পর্যন্ত ঘরোয়া ক্রিকেট খেললে আগের সেই রূপে যেতে পারেননি আম্রে। ফলে মাত্র দুই বছরের শেষ হয়ে যায় তাঁর আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার। এছাড়া ১৯৯৩ সালে এই শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে নিজের শেষ ওয়ানডে ম্যাচ খেলেন।
ভারতের হয়ে ১১ টেস্ট খেলা প্রবীন আম্রে ৪২.৫০ গড়ে করেছেন ৪২৫ রান। টেস্ট ক্রিকেটে ১ টি সেঞ্চুরির পাশাপাশি আছে ৩ টি হাফ সেঞ্চুরিও। ওদিকে ৩৭ ওয়ানডেতে করেছেন ৫১৩ রান। অধিকাংশ সময়েই ৬-৭ এ ব্যাটিং করলেও নিজের সেরাটাই দেয়ার চেষ্টা করেছিলেন ডানহাতি এই ব্যাটসম্যান।
এছাড়া সেই সময় সৌরভ গাঙ্গুলি ও রাহুল দ্রাবিড়ের অভিষেক হওয়ায় ভারতের ব্যাটিং লাইন আপ আরো শক্তিশালি হয়ে ওঠে। ফলে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে আর ফেরা হয়নি। তবে ক্রিকেটকে বিদায় জানানোর পর নিজেই ক্রিকেটার তৈরির ব্রত নিয়েছেন। ভারতের সুরেশ রায়না কিংবা রবিন উথাপ্পার মত ব্যাটসম্যানরা এখনো গুরু মানেন প্রবীন আম্রেকে।
এছাড়া নিজের প্রথম দল্ মুম্বাইয়ের কোচ ছিলেন প্রায় পাঁচ বছর। সেই সময়ে বেশ কয়েকটি শিরোপা জিতেছিল মুম্বাই। এছাড়া ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগ (আইপিএল) এর দল পুনে ওয়ারিয়ার্সের সাথেও কাজ করছেন। ভারতের ঘরোয়া ক্রিকেটে তিনি এখন শ্রদ্ধার এক নাম। অনেক ব্যাটসম্যানই নিজেকে শাণিত করতে যান তাঁদের গুরু প্রবীন আম্রের কাছে। সবাই শচীনের মত গুরুদক্ষিণা দেন না, কেউ কেউ আম্রের মতও দেন।