অফ স্ট্যাম্পের সামান্য বাইরে গুড লেন্থ বল। ব্যাটসম্যান তার বাঁ পা অফ স্ট্যাম্পের আরও বেশ কিছুটা বাইরে রেখে কব্জির মোচড়ে স্কয়ার লেগের ওপর দিয়ে বলটা উড়িয়ে দিলেন। কিছুক্ষন পর আবার, একই বল, একই শট। এবং একই ফল।
আম্পায়ারের পাশ দিয়ে হেঁটে বোলিং মার্কের দিকে ফিরে যাওয়ার সময় কপিলদেব ডিকি বার্ডকে বললেন, ‘বড্ড রিস্ক নিচ্ছে! এবার যাবে, কী বলেন?’ নড করলেন বার্ড, ‘ঠিকই। তবে এরকম রিস্ক ও গত দশ বছর ধরে নিয়ে আসছে।’
সেদিন কাজ শেষ করে আসতে পারেন নি ভিভ। ম্যাচের পর বিশ্বজয়ী অধিনায়ককে বলতে শোনা গেল, ‘ভিভের ব্যাটিং দেখে মনে হচ্ছিল ম্যাচটা ষাট নয়, তিরিশ ওভারের।’
ঠিকই। ধীরে সুস্থে ইনিংস তৈরি করলে ম্যাচটা ওয়েস্ট ইন্ডিজ অনায়াসেই জিততে পারত। কিন্তু ভিভ সেই মানসিকতার ব্যাটসম্যান হলে তার রান ও গড় অনেকটাই বেশি হলেও, ক্রিকেট ইতিহাসে তার জন্যে আলাদা একটা পাতা নির্দিষ্ট থাকত না। যতক্ষণ আমি ক্রিজে থাকব, ততক্ষণ পর্যন্ত মাঠের সম্পূর্ণ আধিপত্য আমার হাতে থাকবে – এই যার ক্রিকেটের মূলমন্ত্র তার কাছ থেকে নিছক একটা বিশ্বকাপ জয়ের জন্যে ধীরে-সুস্থে ব্যাটিং আশা করাটা বাড়াবাড়ি।
অবশ্য বিশ্বজয়ী অধিনায়কের সেই ম্যাচে খেলা ছোট্ট ইনিংসের স্ট্রাইক রেট দেখে মনে হতে বাধ্য যে তিনি নিজেও ভিভের আদর্শেই বিশ্বাস করতেন।
আমরা, যাদের বয়স পঞ্চাশের আশে পাশে ঘোরাফেরা করছে, তাদের সৌভাগ্য যে ভিভের কিছু সেরা ইনিংস ইউ টিউবে সহজলভ্য। নইলে নিছক সংখ্যা দিয়ে তাকে নিয়ে মাতামাতির যৌক্তিকতার প্রশ্ন উঠত। উঠতই। পরিসংখ্যানের দিক দিয়ে টেস্টে তার চেয়ে অনেকটাই এগিয়ে সাঙ্গা, স্মিথ, শচীন, ক্যালিসরা। এক দিনের ম্যাচে এবি এবং বিরাট।
কিন্তু, এদের মধ্যে কেউই ফাস্ট – স্পিন নির্বিশেষে, স্বদেশে হোক বা বিদেশে, বোলারদের মধ্যে এতটা আতঙ্ক সৃষ্টি করতে পারে নি। ব্র্যাডম্যান? তিনি পারতেন নি:সন্দেহে কিন্তু তার সৃষ্ট আতঙ্কের ধরন আলাদা। তিনি ক্রিজে সেটল হয়ে যাওয়া মানে সেঞ্চুরি – ডাবল সেঞ্চুরি – ট্রিপল সেঞ্চুরি – ঠিক কোথায় গিয়ে তিনি থামবেন, সেই আতঙ্কে ভুগত প্রত্যেকটা বোলার, ফিল্ডার ও ক্যাপ্টেন।
ভিভ অতক্ষণ সময় নিতেন না। অনেক সময় একটা ওভারই যথেষ্ট ছিল বোলারদের আত্মবিশ্বাস গুঁড়িয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে। টমসনের বলে সামনের পায়ে হুক বা উইলিসকে লেগ স্ট্যাম্পের দুই ফুট বাইরে দাঁড়িয়ে লং অফের ওপর দিয়ে গ্যালারীতে ফেলে দেওয়া – এ কাজ তিনি হামেশাই করতেন তাচ্ছিল্যের সঙ্গে। মাঝে মধ্যে ফরওয়ার্ড ডিফেন্সিভ শটও খেলতেন কিন্তু তা দেখে মনে হওয়া স্বাভাবিক যে ভিভ বোলারকে সম্মান নয়, বিদ্রুপ করছেন।
কারণ, একটু আগেই হয়ত এর চেয়ে বহু ভালো একটা বলকে থেঁতলে দিয়েছেন। একটু পরেও দেবেন। সেরা ফর্মের ভিভের বিরুদ্ধে বল করার মূল আতঙ্ক এটাই – অপমানিত হওয়ার আতঙ্ক, তাদের সেরা বলগুলিকে বুলেটের গতিতে বাউন্ডারির দিকে ছুটে যেতে দেখার আতঙ্ক।
তিনি ঘণ্টা দুয়েক ক্রিজে থাকা মানেই সবাইকে বুঝিয়ে দেওয়া যে যতই অন্যরা তার চেয়ে বেশি রান করুন বা ইনিংসে পাঁচ বা ততোধিক উইকেট নিন, সম্রাট তিনিই। এবং সেটা বোঝার জন্য স্কোরবোর্ড নামের বস্তুটার দিকে তাকানোর প্রয়োজন নেই।
এবং ঠিক এই কারনেই যারা ভিভকে কিছুক্ষনের জন্যও পিক ফর্মে ব্যাট করতে দেখেছেন তারা সব সময়ই তাকে একটা আলাদা জায়গায় রাখেন। তাদের তৈরি সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বিশ্ব একাদশে তিন নাম্বার স্থানে কে ব্যাট হাতে নামবেন এই নিয়ে তারা বেশি সময় অতিবাহিত করেন না।
ভিভের দর্পের সঙ্গে ক্রিজের দিকে হেঁটে যাওয়া, চ্যুইং গাম চিবোনো, বোলারদের দিকে শীতল দৃষ্টিতে তাকানো – এ সব নিয়ে বহু সাহিত্য আছে। কিন্তু এই সবকিছু যোগ করলেও ক্রিকেট মাঠে একটা রানও করা যায় না। ভিভের মতো ব্যাট করার জন্যে প্রয়োজন ঈশ্বরপ্রদত্ত প্রতিভা এবং নিজের ক্রিকেটের ওপর প্রচন্ড আত্মবিশ্বাস। তোমার হাতে বল আছে, আমার হাতে ব্যাট – এটাই যথেষ্ট। আমার স্থির বিশ্বাস প্যাড বা শরীর বাঁচানোর অন্যান্য সরঞ্জাম না পরেও অনায়াসে লিলি – টমসন – ইমরান – কপিলদের খেলে দিতেন ভিভ।
তিনি যখন আজ বলেন যে আজকের দিনেও তিনি হেলমেট পরতেন না, সেটা বিশ্বাস করতে আমাদের কষ্ট হয় না একটুও। হয়ত কথাটা ঠিক নয়। মানুষ যা চারপাশে দেখে বড় হয়, সে সেটা প্রশ্ন ছাড়াই গ্রহণ করে নেয়। ভিভ – সানি হেলমেট যুগের আগে ক্রিকেট খেলতে আরম্ভ করেছিলেন এবং নিজের দক্ষতা সম্বন্ধে আত্মবিশ্বাস ছিল বলে পরে আর তাদের ও বস্তুর প্রয়োজন পড়ে নি।
ক্রিকেটে ব্র্যাডম্যান – শচীন –ক্যালিস – স্মিথদের যেমন প্রয়োজন আছে, তার চেয়ে হয়ত কিছু বেশিই প্রয়োজন আছে ডাবলু জি গ্রেস, ট্রাম্পার, মিলার, ভিভের মতো চরিত্রের। প্রথম দলের মানুষ রেকর্ড বইয়ে রাজত্ব করেন, নিজের কীর্তিবলে দলকে উপহার দেন বহু স্মরণীয় জয়। দ্বিতীয় দলের মানুষের রাজত্ব মাঠের মধ্যে ও মানুষের হৃদয়ে। তাদের ক্রিকেট দেখে জয় – পরাজয়ের চিন্তা ভুলে অবাক বিস্ময়ে চেয়ে থাকতে ইচ্ছে হয়। এভাবেও ক্রিকেট খেলা যায় – এটাই তো এতদিন জানা ছিল না।