আমরা যখন কলকাতা লিগ খেলতাম তখন ছোটো টিমগুলো রেলিগেশন বাঁচাতে দিল্লী থেকে প্লেয়ার নিয়ে আসত। বড়ো টিমগুলো অবশ্য শুরু থেকেই- এইভাবেই রাজীব শেঠ, ওনি উইলসন, আদিল শেখ, এন পি সিংরা কলকাতা ময়দান কাঁপাত।
কী ছিল দিল্লীর প্লেয়ারদের, যা কলকাতার প্লেয়ারদের ছিল না? আসলে কলকাতার ক্রিকেট অনেক ভালো উইকেটে খেলা হত। দিল্লিতে তখন শুনতাম, পরে দেখেছি যে, প্রায় খাটালে খেলা হয়। অবশ্য মুম্বইয়ের কাঙ্গা লিগের মতো খাটালে নয়। অথবা যারা মাড়োয়ারি লিগ খেলেছে তারা জানে, মাড়োয়ারি লিগে সবাই মুরালিধরন, সবাই শেন ওয়ার্ন। আর পেস বোলার মানেই চেতন শর্মা বা ম্যালকম ডেঞ্জেল মার্শাল। গুড লেন্থ থেকে বল আচমকা তুলে দিতে পারে মুখে। মানে বোলাররা খালি বলটি পিচ বলে যে বস্তুটা ছিল তাতে ফেললেই হল, বাকি বলই করত।
তা এইসব খাটালে টেকনিকের থেকেও যেটা তৈরি বেশি হয়, সেটা হল হ্যান্ড-আই কোঅর্ডিনেশন আর রিফ্লেক্স, ব্যাটটাও অসম্ভব সোজা নামে ও ওঠে। দিল্লির মাটিতে গত কুড়ি বছর বিভিন্ন লেভেলে ক্রিকেট দেখে বুঝেছি যে, দিল্লির ব্যাটসম্যানদের ব্যাট-ফ্লো অসম্ভব সুন্দর ও সোজা।
যাঁর কথা আজ বলতে যাচ্ছি, তিনি ভারতীয় ক্রিকেটে আসার আগে নবাব বলে একটাই লোক পরিচিত ছিলেন। তিনি সাইফ আলী খানের বাবা; প্রেমিকাকে প্রোপোজ করার সময় যিনি পাঁচটা ফ্রিজ উপহার দেবেন বলেছিলেন। সেই পতৌদির নবাব আমার প্রথম ক্রিকেটীয় হিরো। যদিও খেলতে দেখিনি। তবুও।
সেই নবাবের সঙ্গে এই নবাবের আবার কিসসু মিল নেই; স্কুটারে করে সুদূর নজফগড় থেকে আসতেন। কিছু দূর পর থেকে সঙ্গে থাকত আশিস নেহরা। নেহরা আবার স্কুটারে বসেই ঘুমিয়ে নিতেন। সে অন্য গল্প। নজফগড়ের সেই বেঁটেখাটো ছেলেটা ছেলেবেলা থেকেই মারকুটে ব্যাটসম্যান হিসেবে পরিচিত ছিল। যদিও ক্রিকেট খেলার জন্য মার খেয়েছিল বাবার কাছে। সে থাক।
মোদ্দা কথা হল, মিডল অর্ডারের মারকুটে ব্যাটসম্যান হিসাবে জুনিয়র ক্রিকেট, রঞ্জি, দলীপ বেয়ে নজফগড়ের সেই ছেলেটি ভারতীয় দলে সুযোগ পেয়ে গেল। কিন্তু প্রথম ম্যাচেই শোয়েব আখতার। লোকে বলে শোয়েবের পেসে ভয় পেয়ে নাকি ছেলেটি আউট হয়ে গিয়েছিল। সাধারণ অফস্পিনেও কার্যকরী কিছু করে উঠতে পারেনি। পরের সুযোগ আসে আরও কুড়ি মাস পরে; তাও সেবার নয়, প্রথম লোকে হালকা হলেও
নড়েচড়ে বসে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে ৫৮ দেখে। ৬ নম্বরে নেমে মারকাটারি ব্যাটিং আর অফস্পিন করে তিনটে উইকেট। কিন্তু তারপরেও যে-কে-সেই।
ঝুলি থেকে বেড়াল বেরোল, যখন শচীন টেন্ডুলকার গোড়ালির চোটের কারণে শ্রীলঙ্কা যেতে পারলেন না। নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধে ওপেন করতে নেমে ৬৯ বলে সেঞ্চুরি। তারপরেও টেস্ট টিমে জায়গা হচ্ছিল না। ২০০১-এ শিকে ছিঁড়ল দক্ষিণ আফ্রিকায়। নজফগড়ের সেই ছেলেটি তখন দ্বিতীয় শচীন টেন্ডুলকার। একইভাবে ব্যাট নামে বলের দিকে, ব্যাট ওঠে না, বল উঠে যায় বাউন্ডারির বাইরে।
বিশেষত বোলার্স ব্যাক ড্রাইভ আর লেগ গ্লান্সে তখন আলাদা করা যায় না। এমনকি, প্রথম টেস্টেই সেঞ্চুরির সময় সচিনের দেখাদেখি অফ স্টাম্পের উপর বাউন্সারকেও আপার কাট করে ফেললেন, নজফগড়ের বীরেন্দ্র শেবাগ। তারপর? ২০০২-এ দীপ দাশগুপ্ত মেকশিফট ওপেনার হিসাবে কার্যকরী হলেন না। ইংল্যান্ড সিরিজে ওপেন করতে এলেন বীরেন্দ্র শেহবাগ। নজফগড়ের সাধারণ ব্যবসায়ীর ছেলের নবাব হবার প্রথম পদক্ষেপ।
পরবর্তীকালে শেবাগ বলেনও যে, গাঙ্গুলি তাঁকে বলেছিলেন, ওপেন করলে অন্তত তিনটে থেকে চারটে সুযোগ পাবেন এবং ফেল করলে ড্রপড হবার আগেও মিডল অর্ডারের সুযোগ পাবেন বীরেন্দ্র শেহবাগ। তা প্রথম টেস্টেই ১০টা চার মেরে ৮৪। পরের টেস্টে সেঞ্চুরি। পরবর্তী ১০ বছরে তাঁকে আর বসানোর সুযোগ দেননি।
তারপরের ইতিহাস? সে তো সবাই জানে। একমাত্র ভারতীয় হিসাবে দুটি ত্রিশত রান। ছ’টি দ্বিশত রান। সুনীল গাভাস্কারের সঙ্গে সর্বকালের সেরা ভারতীয় দলের ওপেনার হিসাবে মনোনয়ন। নবাব শিরোপা। বস্তুত এগুলো নিয়ে গল্প করে লাভ নেই। লাভ নেই ওই দশ বছর ধরে ভারতীয় ক্রিকেটের এক নম্বর এন্টারটেইনারের জায়গাটা নিজস্ব সম্পত্তি কী উপায়ে করে ফেললেন, তা নিয়ে আলোচনা করেও। লাভ নেই কীভাবে ধ্বংসলীলা চালাতেন, যাতে ম্যাথু হেডেনের মতো বিধ্বংসী ব্যাটসম্যানও তাঁকে নিজের দেখা সেরা এগারোয় সুযোগ দিতে বাধ্য হন।
আমরা বরং শেবাগের পাগলামোর পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা করি, ‘মেথড ইন ম্যাডনেস’। অনেক জায়গাতেই দেখেছি শেহবাগ বলেছেন, ‘হ্যাভ ব্যাট, উইল হিট’ মানসিকতা নিয়েই নাকি খেলতেন। প্রতিটি বলকে সবসময় তিনি দেখেছেন ছয় মারার সম্ভাবনা হিসাবে। বলের গুণমানের উপর নির্ভর করে তারপর সেটা কমেছে বা একই থেকেছে। কখনই ভাবেননি উলটোদিকের বোলারটি কে। গ্লেন ম্যাকগ্রা, শেন ওয়র্ন, মুথাইয়া মুরলিধরন, শ্যন পোলক, অ্যান্ড্রু ফ্লিন্টফ নয়, ডিউক অথবা কোকাবুরা অথবা এসজি টেস্ট বলটি কী হয়ে ব্যাটের কাছে আসছে সেটাই গুরুত্ব দিয়েছেন। এসব সবাই জানে। এসব থাক।
বরং ভাবি, শেবাগ আদৌ বল দেখে বুঝে মারতেন, নাকি ব্যাট চালিয়ে দিতেন! আকাশ চোপড়া একটা ম্যাচের কথা বলেছেন; বারাবাটি কটকে খুব খুব খারাপ উইকেট, উড়িষ্যার বিপক্ষে ম্যাচ। বল যা-তা হচ্ছে। শেহবাগ তার মধ্যেই বার দু-এক পেসারকে স্টেপ আউট করে আনতাবড়ি চালিয়েছেন। আকাশ নন-স্ট্রাইকিং এন্ড থেকে শান্ত করতে গেছেন। শেহবাগ ওঁকে বোঝালেন, বোলারকে কনফিউজ করার জন্যই এই আগ বাড়ানো। বোলার অবধারিত ভাবে লাইন লেন্থ ভুলে পরের দুটি বল শর্ট অব লেন্থ; আর শেহবাগ দুটি বলকেই চাঁদের পাশে মুসুরির ডাল করে দিলেন। বলার দরকার নেই সে ম্যাচে সেঞ্চুরি এসেছিল।
বস্তুত শেবাগ আগের বলটি নিয়ে বেশি ভাবতেন না। পরের বলটির জন্য সাদা মনে তৈরি হতেন। এটা বলা যতটা সহজ, করা ততটা নয়। শেবাগ পেরেছেন। হয়তো রিচার্ডস পারতেন। শেহবাগ পরে গ্রেগ চ্যাপেলকে নিয়ে বলেছেন। চ্যাপেল যতটা ভালো কোচ ছিলেন ততটা ভালো ম্যানেজার নন। ফলে শেবাগের ফুটওয়ার্ক ঠিক করতে গিয়ে ঠকেছেন।
ইরফান পাঠান, মুনাফ প্যাটেলদের প্যাঁচে ফেলা যায়। শেহবাগ অন্য ধাতুতে গড়া। এসব পাত্তা দিতেন না। তা বলে তিনি কি সুপরামর্শ শোনেননি? সানি গাভাসকার যখন ঘাসের পিচে মিডল স্টাম্প গার্ড নিতে বলেন, তিনি শোনেন; কৃশ শ্রীকান্ত যখন ফ্লিন্টফের ইনস্যুইং সামলানোর জন্য বলেন অফ স্টাম্পে স্টান্স নিতে, তিনি শোনেন। এইসব সিলেক্টিভ শোনা থেকেই ননস্ট্রাইকিং প্রান্তে গান গাওয়া আসে। আসে ড্রিংকস ব্রেকে গানের কথা ভুলে গেলে দ্বাদশ ব্যক্তির থেকে জেনে নিয়ে আবার গাওয়া।
রিল্যাক্সেশনের একটা আলাদা মাত্রা আছে, শেহবাগ সেই মাত্রাবৃত্ত সম্পূর্ণ করেন। যে-সিরিজে অজন্তা মেন্ডিস সচিন, দ্রাবিড়, গাঙ্গুলি, লক্ষ্মণকে নাচাচ্ছিলেন, সেখানে শেহবাগ স্বচ্ছন্দে খেলছিলেন। কীভাবে? শেহবাগের নিজেরই কথায়, মেন্ডিসের হাত থেকে অতটা সহজে বোঝা যাচ্ছিল না কোনটা ক্যারম হয়ে লেগ স্পিন করবে আর কোনটা অফ স্পিন। শেহবাগ প্লট করে নিলেন, ক্যারমটা না বুঝতে পারলেও চিন্তা নেই, কম স্পিন, সামলে দেওয়া যাবে, সমস্যা অফ স্পিনটা নিয়ে। সেটা বেশ বড়ো, তাহলে? অফ স্টাম্পের বাইরে পা নিয়ে মিট করো।
বিট হলে ব্যাট ভিতরে, পায়ে লাগলে এলবিডব্লিউ হবে না। অফ স্পিন করলে স্যুইপ বা স্পিনের গতির দিকে হালকা পুশ। শর্ট আর হাফভলিকে এমনিতেই ছাড় নেই। তাহলে বোলার কী করবে? ব্যাটসম্যান যখন কিংকর্তব্যবিমূঢ় হলে ননস্ট্রাইকার হয়, বোলার তেমনই ননস্ট্রাইকারকে খোঁজে।
ঠিক একইভাবে গ্লেন ম্যাকগ্রা। একই জায়গা থেকে ইনস্যুইং-আউটস্যুইং? খেয়াল করে দেখুন, ইনস্যুইং-এর সময় হাত মাথার অনেক বেশি কাছে। আউটস্যুইং স্বাভাবিকভাবেই কানের পাশ থেকে একটু সরে। এগুলো ভিডিও অ্যানালিস্টরা ধরে দেন। শেহবাগের নিজস্ব ভিডিও অ্যানালিস্ট তাঁর মস্তিষ্ক। খুব সহজ বলের লাইনের ইনসাইডে খেলা। বাইরের বলে মনে হবে বিট হচ্ছি, কিন্তু ইনকামিং হলে সেটা ব্যাটের মাঝখানে লাগছে। আর টেস্টে তো কভার এক্সট্রা কভার কভার পয়েন্ট আর মিড অনে নতুন বলে বড়োজোর একটা ফিল্ডার। বল যদি ব্যাটের মাঝখানে লাগে তাহলে আকাশে আর বাতাসে মায়া ছড়িয়েই বা কী হবে!
শেবাগ নাকি ১৪৫ কিমিতে গায়ের উপর বলে স্বচ্ছন্দ নন, বেশ কথা। লাইনের ভিতরে ঢুকে যদি বলটা উইকেট কিপারের পাশ দিয়ে ফাইন লেগ বাউন্ডারিতে পাঠানো যায় আর একটু অফ স্টাম্প লাইনে থাকলে আপার কাট করা যায় তাহলে? হুক করার তো দরকার নেই! অফ স্টাম্পের বাইরে হলে টেনিস বলের মতো পুল করলেই তো চলে যায়।
আর অফ স্টাম্পের বাইরের আর্ক? সেখানে ওই ব্যাট ফ্লো! বলের কাছে পা গেল-কি-গেল-না তা গ্রেগ চ্যাপেল গুনুন। শেবাগ বাউন্ডারি গোনেন। সব ভিডিও অ্যানালিসিস, সব প্রতিপক্ষের চালকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে নজফখানের নামের এলাকার নতুন নবাব এন্টারটেইনমেন্ট কোশ্যেন্ট গোনেন। আর শেবাগদের দ্বিতীয় তৃতীয় গিয়ার থাকে না। জিরো থেকে ষাটে উঠতে তাঁরা একটামাত্র বল নেন। দিনের প্রথম বলেই চার মারতে পারেন তিনি, শেষ বলে বাউন্ডারির বাইরে ফেলতে গিয়ে নিশ্চিত দ্বিশত রান হারিয়ে আপশোশ করেন ব্যাটের মাঝখানে লাগল না কেন! ২৯০কে আর-একটি সংখ্যা ভেবে নেন বীরেন্দ্র শেবাগ।
ভিভ রিচার্ডসের কথাই ধরা যাক না কেন। ভিভ, একটা বড়ো পা ফেলতেন চতুর্থ স্টাম্প বরাবর। শেবাগ সেটাও ফেলেননি। কিন্তু দুজনেই বল বাউন্ডারির বাইরে ফেলতেন। তার সঙ্গে বোলারের আত্মবিশ্বাস, বিপক্ষ কোচ ক্যাপ্টেনের পরিকল্পনা এবং এমসিসির কোচিং ম্যানুয়ালও গঙ্গাপারের তালগাছে চড়ে বেহালা বাজাত, যখন বীরেন্দ্র শেহবাগ তলোয়ার চালাচ্ছেন বাইশ গজে।
রোমান্স যাঁরা করতে আসেন, তাঁদের হয়তো বার্ধক্য বলে কিছু থাকে না। তাঁরা সুচিত্রা সেনের মতো হারিয়ে যেতে পছন্দ করেন মঞ্চ থেকে। সহ-অভিনেতা হওয়া তাঁদের সাজে না। ভিভও পারেননি, শেহবাগ নয়। সচিন যেখানে নিজের খেলা আমূল বদলে আবার ফিরে এসে দীর্ঘায়িত করেন ক্রিকেট-জিন্দেগি, শেবাগরা সেখানে রোমান্সকেই জিন্দেগি করে নেন।
তারপর? জেমস ডিনদের তারপর বলে কিছু থাকে না। বাকিটা খেলা-ই। মরণপণ বাজি নেই সেখানে। মঞ্চ শেষ তো খেলা শেষ। টুকুস করে লেজেন্ডস লিগে নাম লিখিয়ে মজা খোঁজার চেষ্টা অথবা ট্যুইটারে নেট কাঁপানো। আপশোশ? বেটা অ্যায়সা হ্যায় কে আপশোশ আম আদমিকে গেহনা হোতা হ্যায়। শেহবাগ যো কিতাব লিখতে হ্যায় ওঁহা পে আপশোশ ডিকশনারি কা পার্ট নহি হোতা।
শেবাগ নিজের ডিকশনারি নিজে লেখেন। কোচিং ম্যানুয়ালও। মনস্তত্ত্বের কথায় আর গেলাম না। সেটার তল পেলে তো ম্যাঙ্গো পিপলও পণ্ডিত রবিশঙ্কর হতেন অথবা মকবুল ফিদা হুসেন। শেবাগের মতো প্রতিভার আপাত-বিশৃঙ্খলা আর শৃঙ্খলা ধারনার বিভ্রমের মাঝে পড়ে শুধু চুপি চুপি বলতে ইচ্ছে করে – একদিন চলে যেতে হবে, সে যাওয়াও না হয় দেখে নেওয়া যাবে। আজ শুধু দেখে নেওয়ার গান বাজছে সারাদিন।।