৯১৮ দিন।
ইয়াসির আলী চৌধুরী রাব্বি জাতীয় দলে প্রথম ডাক পাওয়ার পর ৯১৮ দিন পার হয়ে গেছে। দীর্ঘ এক অপেক্ষা। কেবল জাতীয় দলের বেঞ্চে বসে থাকার অপেক্ষা বুঝলে ভুল হবে। এর সাথে যোগ করুন সেই তিন বছর বয়স থেকে শুরু হওয়া এক স্বপ্নপূরণের অপেক্ষা। বডি শেমিং, দূর্ঘটনায় শেষ হতে বসা, দিনের পর দিন পানি টেনে চলা; রাব্বির গল্পের আর শেষ নেই।
এই গল্পটার শেষে নতুন শুরুতে একটা রূপকথা হলে মন্দ হতো না।
কিন্তু জীবন তো রূপকথা নয়। গতকালই রাব্বির বাবা বলছিলেন, ‘ওর জীবনটা খুব স্মুথ না। ও সবই পায়। কিন্তু সে জন্য ওকে বাকীদের চেয়ে একটু বেশি পরীক্ষা দিতে হয়।’
তাই সত্যি হলো। মাঠে নেমেই কোনো রূপকথার জন্ম দিতে পারলেন না রাব্বি। চোখ জুড়ানো একটা কাভার ড্রাইভ করেছিলেন বটে। দারুন করে বল ছাড়ছিলেন, দারুন ডিফেন্স করছিলেন। কিন্তু হাসান আলীর একটা ইনকামিং ডেলিভারিতে ছত্রখান হয়ে গেলো স্ট্যাম্প। মাত্র ১৯ বলেই শেষ হলো নতুন শুরুর প্রথম অধ্যায়।
রাব্বির বাবার কথায় ফিরে যাওয়া যাক। আসলে রাব্বির জীবনটা এমন অনেক স্বপ্নভঙ্গের গল্প হয়ে আছে।
এই জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়াম থেকে খুব বেশি দূরে নয় রাব্বির বাসা। চট্টগ্রাম শহরের চকবাজারে মারাত্মক ক্রীড়াপ্রেমী শওকত আলী চৌধুরীর ঘরে জন্ম তার। ছোটবেলা থেকে খুব নাদুস নুদুস ছিলেন রাব্বি। বয়স বছর তিনেক হতেই শওকত আলী একটু আতঙ্কের সাথে খেয়াল করলেন ছেলেটা তার ওভারওয়েট হয়ে যাচ্ছে।
কী করা যায়?
প্রথম কথা ছেলেকে পরিশ্রম করাতে হবে। সেটার জন্য শওকত আলী বেছে নিলেন ক্রিকেটকে। নিজে একসময় ক্রিকেট খেলেছেন। সর্বোচ্চ স্তরে পৌছাতে পারেননি। সেই স্বপ্নটা পূরণের একটা পথও পাওয়া গেলো।
সাড়ে তিন বছরের রাব্বিকে হাতে ধরে নিয়ে গেলেন ব্রাইট অ্যাকাডেমিতে। সেখানে কোচরা কোলে করে তাকে নিয়ে গেলেন মাঠে। কোচ আর বাবার দেখভালে রাব্বির শুরু হলো ক্রিকেটের জীবন। কিন্তু এই পর্যায়ে রাব্বিকে সইতে হয়েছে মারাত্মক গঞ্জনা। একটু স্থুল মানুষদের সারা পৃথিবীতেই সহ্য করতে হয় এই ‘বডি শেমিং’।
রাব্বির ক্ষেত্রে তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। এই ছেলে মোটা, একে দিয়ে হবে না-এমন কথা রাব্বি নিয়মিতই শুনেছেন। এই কথার বিপক্ষে দাড়িয়ে ওই শরীর নিয়েও নিজের ফিটনেস প্রমাণ করেছেন বারবার।
মেদটা ঝরিয়ে ফেলতেই নিজেকে প্রমাণ করে ফেলতে শুরু করলেন।
অনুর্ধ্ব-১৯ স্তরে দারুন পারফরম করেছেন। ঘরোয়া ক্রিকেটেও দারুণ সফল। প্রথম শ্রেনীর ক্রিকেটে রীতিমতো ঝলসায় রাব্বির ব্যাট। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে রাব্বির ৫৭ ম্যাচে ৯ সেঞ্চুরি আর ২৪ ফিফটি আর ৫০.৩৭ গড়।
এভাবে সবকিছু মসৃণভাবে চললে তো গল্পই জমতো না। এর মধ্যে রাব্বির জীবনে এলো এক সড়ক দূর্ঘটনা। ২০১৮ সালে একেবারে ক্যারিয়ার শেষ হয়ে যাওয়া এক দূর্ঘটনায় পড়েন তিনি।
রিকশায় করে যাচ্ছিলেন। পেছন থেকে এক সিএনজি এসে দিলো ধাক্কা। মারাত্মক আহত হয়ে চার মাস রইলেন হাসপাতালে। রাব্বি নিজেই বলেছেন, এই সময় ক্রিকেট ক্যারিয়ার শেষ হয়ে গেছে বলেই ভাবছিলেন। কিন্তু সেখান থেকেই আবার ফিরে এসেছেন।
আবারও বাবা শওকত আলী হাত ধরে হাটিয়েছেন। আবারও ফিরেছেন ক্রিকেটে।
২০১৯-২০ মৌসুমের বিপিএলে চিটাগং ভাইকিংসের হয়ে দূরন্ত একটা মৌসুম কাটান। আর তার পুরষ্কার হিসেবেই জায়গা হয় ২০১৯ সালের আয়ারল্যান্ডগামী ওয়ানডে দলে। আর এখান থেকেই শুরু হয় জাতীয় দলের জার্সি পরে মাঠে নামার অনন্ত এক অপেক্ষা।
সেই অপেক্ষার আজ শেষ হয়েছে। কিন্তু শেষের শুরুটা ভালো হলো না। তারপরও আমরা স্বপ্ন দেখতে পারি। রাব্বির বাবার কথাটা মনে করতে পারি।
শওকত আলী চোয়াল শক্ত করে বলছিলেন, ‘ওর জীবন স্মুথ না। তবে ও লড়াই ছাড়ে না। আমরা লড়াই ছাড়তে শিখিনি। ও সাফল্য পাবেই। হয়তো একটু অপেক্ষা করতে হবে।’
সাফল্য পাওয়ার জন্য একটু অপেক্ষা করতে আমরা রাজী আছি, রাব্বি।