ক্যানডিস ওয়ার্নার। সাবেক অস্ট্রেলিয়ান সার্ফার। তিনি টুইট করেছেন, ‘ফর্ম নেই, বেশি বুড়ো, গায়ের জোর কমে গেছে। অভিনন্দন ডেভিড ওয়ার্নার।’ ওয়ার্নারের স্ত্রীর খেদটা বোঝা যায় সহজেই। এই ওয়ার্নারই তো ক’দিন আগে ফর্মহীনতার জের ধরে বসে থেকেছেন ডাগ আউটে। ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগে (আইপিএল) দলের জায়গা হারিয়েছেন, হারিয়েছেন অধিনায়কত্বও।
প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে কোনো ম্যাচ না খেলেই আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে সুযোগ পেয়েছিলেন ডেভিড ওয়ার্নার। ক্রিকেট দুনিয়ার জন্য এমনিতেই এক বিস্ময় তিনি। প্রথম ম্যাচ থেকেই প্রমাণ করেছিলেন তিনি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পাড়ি দিবেন লম্বা পথ। বিধ্বংসী ব্যাটিংয়ে প্রতিপক্ষের জন্য রূপ নিয়েছিলেন আতংকে। মারকাটারি ব্যাটিং আর ধারাবাহিক পারফরম্যান্সে অল্প সময়েই বনে গেলেন সময়ের সেরা ওপেনার।
এরপর ২০১৮ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার মাটিতে ‘স্যান্ডপেপার’ কাণ্ডের সেই কলঙ্কিত ঘটনা। কলঙ্ক গায়ে মেখেই ফিরেছিলেন ২২ গজে। সমালোচনা-ট্রল, ভৎসনা – সব মাথা পেতে নিয়ে নতুন করে শুরু করেছিলেন। সবকিছু পাশ কাটিয়ে আবারো চিরচেনা সেই রূপে ফিরেছিলেন তিনি।
তবে গেলো এক বছর ধরেই ওয়ার্নারের ব্যাটের সেই ধারটা আর দেখা যাচ্ছিলো না। হটাৎ করেই যেনো নিজেকে আবদ্ধ করে নিলেন ব্যর্থতার বেড়াজালে। আইপিএলের প্রতি আসরেই যিনি সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহকদের একজন ছিলেন, তিনিই কিনা চলতি বছর জায়গা হারান একাদশে! গেলো আসরের আইপিএলে খেলেছিলেন মাত্র ৮ ম্যাচ। এই ৮ ম্যাচে ২ ফিফটিতে মাত্র ২৪ গড়ে ১৯৫ রান। এর চেয়েও অবাক করা বিষয় পুরো আসরে ওয়ার্নারের স্ট্রাইক রেট মাত্র ১০৭!
প্রতিপক্ষের বোলারদের জন্য ২২ গজে ‘রুদ্রমূর্তি’ ধারণ করা ওয়ার্নারের এ যেনো এক অচেনা রূপই দেখেছে ক্রিকেট ভক্তরা। বাজে পারফরম্যান্সে বাদও পড়লেন দল থেকে! আগের আসর গুলোতে দলের হয়ে সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক ওয়ার্নারই কি’না একাদশের বাইরে! স্ট্রাইক রেটও যে যাচ্ছেতাই।
বাদ পড়ার আগের দুই ম্যাচে করেছিলেন ০ ও ২ রান। এই মরুর বুকেই কিছুদিন পর বিশ্বকাপের পর্দা উঠবে। ওয়ার্নারের এমন ফর্ম যেনো অজিদের জন্য চিন্তার সবচেয়ে বড় কারণ! টানা পাঁচ টি-টোয়েন্টি সিরিজ হারের পর এমনিতেই ধুঁকছিলো অজিরা। তার উপর ওয়ার্নারের হতাশাজনক ফর্ম। সব মিলিয়ে বিশ্বকাপের আগে অনেকটাই ব্যাকফুটে ছিলো অস্ট্রেলিয়া দল।
কারো মতে চিরচেনা সেই আগ্রাসী ওয়ার্নার ফুরিয়ে গেছেন, আবার কারো মতে বিশ্বমঞ্চে ওয়ার্নার ঘুরে দাঁড়াবেন। কিন্তু আইপিএলের বাজে ফর্ম পিছু ছাড়েনি বিশ্বমঞ্চেও। বিশ্বকাপের দুই অফিসিয়াল প্রস্তুতি ম্যাচে করেছিলেন ০ ও ১ রান! এরপর বিশ্বকাপের মূল পর্বে নিজেদের প্রথম ম্যাচে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে করেছিলেন মাত্র ১৪ রান।
সমালোচনার কেন্দ্রে তখন ওয়ার্নার। বয়সটাও যে ৩৫! বয়সের ভারেই কি নেতিয়ে পড়েছেন এই অজি ওপেনার? – বাজে ফর্ম, মন্থর ব্যাটিং, বয়স – সব মিলিয়ে ওয়ার্নার যে এই বিশ্বকাপে অজিদের জন্য হতাশার অন্যতম কারণ হতে যাচ্ছেন এটিই ছিলো অনেকের ধারনা।
কিন্তু ওয়ার্নার জানিয়েছিলেন ভিন্ন কথা। ফর্ম নিয়ে হাসি-ট্রল হলেও তিনি অফ ফর্মে আছেন এমনটা মানতে নারাজ ছিলেন। জানিয়েছিলেন ফর্মে ফিরতে মাত্র একটি বাউন্ডারি থেকে দূরে আছেন তিনি! আইপিএলের পারফরম্যান্স, প্রস্তুতি ম্যাচের ভরাডুবির পরেও ওয়ার্নারের বিশ্বাস ছিলো তিনি পারবেন ঘুরে দাঁড়াতে।
পরের গল্পটা সবারই জানা। সমালোচনার খাতাটায় ইতি টেনে ওয়ার্নার বনে গেলেন এবারের আসরের সেরা খেলোয়াড়! ৭ ম্যাচে ৩ ফিফটিতে ৪৮ গড়ে ২৮৯ রান, স্ট্রাইক রেট ১৪৭! চিরচেনা ওয়ার্নার যেনো স্বরূপে ফিরেছেন। ফর্মেই শুধু ফিরেননি দুর্দান্ত পারফরম্যান্সে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপটাও তুলেছেন অজিদের কেবিনেটে।
আরব আমিরাতের মাটিতে যিনি ছন্দ হারিয়ে ধুঁকছিলেন, সেই মাটিতেই ফিরলেন সেরা ছন্দে। বয়সের ভার কিংবা চেহারায় ক্লান্তির ছাপ – হটাৎ সবকিছু অদৃশ্য! টুর্নামেন্টের আগে যিনি ছিলেন সমালোচনার বৃত্তে, যাকে নিয়ে ছিলো কোনো প্রত্যাশা; সেই ওয়ার্নারই কিনা টুর্নামেন্ট সেরা!
‘ফর্ম ইজ টেম্পোরারি, ক্লাস ইজ পার্মানেন্ট’ – ক্রিকেট পাড়ার জনপ্রিয় এই উদ্ধৃতিটা শিরোপা হাতে আরেকবার প্রমাণ করলেন ওয়ার্নার। তিন বছর আগে কলঙ্ক গায়ে নিয়ে দল থেকে বাদ পড়া সেই মানুষটিই মরুর বুকে বিশ্বকাপ উঁচিয়ে ধরলেন। অজিদের জন্য টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের প্রথম শিরোপা। আর এই শিরোপা জয়ের পেছনে অন্যতম কারিগর ছিলেন ওয়ার্নার।
নিজের প্রতি আত্মবিশ্বাসটা মাত্র দুই সপ্তাহের ব্যবধানে ওয়ার্নারকে নিয়ে গেলেন সাফল্যের চূড়ায়। মন্থর ব্যাটিং, বাজে ফর্ম, বয়সের ভার – এই সবকিছুই মাটি চাপা দিয়েছেন দুই সপ্তাহের ব্যবধানে। মরুর বুকে নিজের নামটা খোদাই করে গেলেন, আর অফ ফর্ম, মন্থর ব্যাটিং, সমালোচনা – সব মাটি চাপা দিয়ে নিজ দেশে উড়াল দিচ্ছেন বিশ্বসেরা হয়েই।