সুন্দরতম বাঘ

ব্রিসবেন টেস্ট থেকে এখন সম্ভাব্য তিনটা ফলই আসতে পারে – হয়তো অস্ট্রেলিয়া হেসেখেলেই জিতে যাবে, কিংবা চতুর্থ দিন বিরাট কোনো বোলিং কারিশমা দেখিয়ে ভারত জিতবে, আবার ম্যাচটা ড্রয়ের দিকেও হাঁটতে পারে। কিন্তু, সে যাই হোক না কেন – ব্রিসবেনের দুই নায়ককে কেউ ভুলবে না! জীবন যুদ্ধে বেঁচে থাকার রসদ হয়ে থাকবে এই লড়াই।

ওয়াশিংটন সুন্দর। তিনি তো নামেই সুন্দর। আরেকজন শার্দুল ঠাকুর। শার্দুল অর্থ বাঘ। দু’জনে মিলে একই সাথে ছিলেন সুন্দর আর বাঘের মত সাহসী। লোয়ার অর্ডারে কিংবা লোয়ার মিডল অর্ডারে এমন প্রতিরোধ আজকাল হরহামেশাই দেখা যায়। কিন্তু, সুন্দর-শার্দুলের মত এতটা সাহস আর নান্দনিকতার সাথে নিশ্চয়ই সাম্প্রতিকালে এই কাজটা আর কোনো জুটি করতে পারেনি।

একে তো ব্রিসবেন টেস্ট। গ্যাবার নামের ভারে আগে থেকেই ম্যাচে ফেবারিটের তকমার ভাগিদার স্বাগতিক অস্ট্রেলিয়া দল। তার ওপর ব্যাট করতে নেমে মাত্র ১৮৬ রানে ছয় জন ব্যাটসম্যান ফিরে গেছেন সাজঘরে। প্রচণ্ড আশাবাদী কেউও এই মঞ্চে দাঁড়িয়ে বিরাট কিছু করার স্বপ্ন বা সাহস – কোনোটাই হয়তো পাবেন না।

বিশেষ করে এমন দুই নবীন টেল এন্ডার তখন ব্যাটিংয়ে যাদের একজন খেলতে নেমেছেন ক্যারিয়ারের দ্বিতীয় টেস্ট, আরেকজনের অভিষেক টেস্ট – সেখান থেকে ফিনিক্স পাখির মত ফিরে আসার অদম্য সাহস স্বয়ং ফিনিক্স পাখিও দেখাবে না।

কিন্তু, এদিন ওয়াশিংটন সুন্দর ও শার্দুল ঠাকুর সব পুরনো ভাবনাকে জলাঞ্জলি দিয়েই নেমেছিলেন মাঠে। ফিনিক্স পাখির চেয়েও বড় কোনো শক্তি ভর করেছিল তাঁদের মাঝে। সেই শক্তিটা আর কিছু না – স্রেফ আত্মবিশ্বাস।

সেই আত্মবিশ্বাস আর কৈশোর থেকে রপ্ত করা কৌশলটাকে কাজে লাগিয়ে দু’জন কেবল উইকেটে টিকেই থাকেননি, করেছেন পাল্টা আক্রমণ। ভারত শেষ করেছে ৩৩৬ রানে। ইনিংসে যে দু’জন ব্যাটসম্যান হাফ সেঞ্চুরি করেছেন তাঁরা আর কেউ নন – এই সুন্দর আর শার্দুল।

সপ্তম উইকেট জুটিতে এই দু’জন মিলে যোগ করেন ১২৩ রান। রানের হিসাবে বিরাট কোনো জুটি নয় – তবে এই জুটিটাই তৃতীয় দিন শেষেও গ্যাবা টেস্টে ভারতের আশা বাঁচিয়ে রেখেছে। একটা রেকর্ড অবশ্য এর মধ্যেও হয়ে গেছে। গ্যাবায় সপ্তম উইকেটে এটাই ভারতের সর্বোচ্চ রানের জুটি। এর আগে কোনো জুটিই শত রান ছুঁতে পারেনি।

শার্দুল করেন ৬৭ রান, নয়টি চার ও দু’টি ছক্কার সৌজন্যে। ব্যাটিংটা তিনি জানেন না এমন নয়। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে তাঁর ছয়টি হাফ সেঞ্চুরি আছে, যার মধ্যে সেরা ইনিংসটা ৮৭ রানের। অন্যদিকে, ঘরোয়া ক্রিকেটে সুন্দর পুরোদস্তর অলরাউন্ডার। ৩০-এর ওপর গড় নিয়ে রান করে প্রথম শ্রেণিতে তিনি একটি সেঞ্চুরি ও দু’টি হাফ সেঞ্চুরি করেছেন মাত্র ১২ ম্যাচের ক্যারিয়ারে। ব্রিসবেনে তিনি সাতটি চার ও একটি ছক্কার সৌজন্যে করেন ৬২ রান।

ঘরোয়া ক্রিকেটে যাই করুন না কেন, সেটা এখানে আলোচ্য নয়। কারণ রঞ্জির সাথে আন্তর্জাতিক ময়দানের আকাশ-পাতাল ফাঁড়াক। তার ওপর গ্যাবার উইকেটে যখন মিশেল স্টার্ক, প্যাট কামিন্স, জশ হ্যাজেলউডরা বোলিং করেন – তখন বড় বড় কুতুব ব্যাটসম্যানদেরও পা কাঁপতে বাধ্য।

কিন্তু, এখানে তো উল্টোটা হল। সুন্দর-শার্দুলদের বিপক্ষেই সংগ্রাম করলো বিখ্যাত অজি পেস লাইন আপ। প্যাট কামিন্স যে ডেলিভারিটায় শার্দুলকে আউট করে জুটি ভাঙলেন – সেটায় যেকোনো দিন যেকোনো ব্যাটসম্যান আউট হতে বাধ্য।

শচীন রমেশ টেন্ডুলকার ঠিকই বলেছেন, টেস্ট ক্রিকেটটা হল জীবনের মত। এখানে ক্ষণে ক্ষণে রং বদলায়। কখনো বিপদ বুঝে এখানে উইকেটে কামড়ে পড়ে থাকতে হবে, কখনো বা পাল্টা আক্রমণ করতে হবে। কখনো সুসময় আসবে, কখনো বা দু:সময়। এখানে কেউ আজ খলনায়ক তো কাল নায়ক।

সুন্দর-শার্দুলের জন্যও কি ব্যাপারটা তা নয়? – সব স্বাভাবিক গতিতে চললে তো এই টেস্টে তাঁদের খেলার কোনো সম্ভাবনা বা যৌক্তিকতাও ছিল না। ভারতের গাদাগাদা ক্রিকেটার এই অস্ট্রেলিয়া সফরে এসে ইনজুরিতে পড়েছেন।

টিম ম্যানেজমেন্ট নেহায়েৎ বাধ্য হয়ে শার্দুল আর সুন্দরকে নামিয়ে দিয়েছিলেন অজি বাঘের সামনে। কিন্তু, বাঘের মুখে পড়ে তাঁরা হরিণ শাবক হয়ে থাকেননি। পাল্টা বিপ্লব করেছেন, সেটাও নান্দনিকতার সাথে। এটাই তো টেস্ট ক্রিকেটের স্বার্থকতা, এটাই তো জীবনের স্বার্থকতা!

লেখক পরিচিতি

সম্পাদক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link