দুই পৃথিবী, এক রিভার্স সুইং

ইমরান খানের একটা স্বভাব খুব চেনা ছিল সবার কাছে। প্রেস কনফারেন্সে ইমরান কোনো মন্তব্য করার আগে দুবার ভাবতেন না। রিচি বেনো একবার বলেছিলেন ইমরানের মাথায় যা আসে তা একেবারে দাঁড়ি-কমা সহ আসে, দ্বিতীয়বার এডিটের ঝামেলা নেই, যা বলবে একেবারে অঙ্ক কষে মিলিয়ে নেবেন ৷

এহেন ইমরান গেছেন সিডনিতে। অজি ক্রিকেট তীর্থে প্রেস কনফারেন্সে বলে বসলেন পাকিস্তান ক্রিকেটে একটা ছেলে এসেছে, ও কিন্তু পরবর্তী অ্যালান ডেভিডসন! বাঁ-হাতি পেস বোলিং-এ ডেভিডসন সাহেবের সাথে কোনো উপমহাদেশীয় বোলারের তুলনা চলে?

গোঁড়া অজিমিডিয়ার হিংস্র বাঘের সামনে একেবারে সাজিয়ে দেওয়া হরিণ শাবক। ইমরান কিছু বলেননি, বলেছে পরিসংখ্যান। ডেভিডসন সাহেব শেষ করেছিলেন ১৮৬ উইকেটে, আর সেদিনের তরুণ ওয়াসিম যাকে ছিঁড়ে খেয়েছিল অজি মিডিয়া সে শেষ করল ৪১৪ টেস্ট উইকেটে!

ইমরান ভুল বলেন নি। তবে ৯০-এর দশকের শুরু অবধি যদি ভারতীয় ক্রিকেটে গাভাস্কার নামক বিষ্ময় ছাড়া সুইং খেলার রাজা বলা হয় কাউকে তার নাম দিলীপ ভেঙ্গসরকার, সাথে কিছুটা সঞ্জয় মাঞ্জরেকার৷ দু’জনের সামনে ওয়াসিম আকরামের নাম নিলে আজও কোথাও যেন চেয়ারটাতে হেলান দেওয়া পিঠদুটো সোজা হয়ে বসে।

৮৯’ লাহোর কিংবা করাচি টেস্ট হবে, ওয়াসিম আকরাম বল করছেন আগুনে গতিতে ৷ মাঞ্জরেকার কোনোমতে সামলাচ্ছেন, এদিকে ননস্ট্রাইকারে সিধু যেন পায়ে পেরেক গেঁথে নিয়েছেন। মাঝে তো ঝগড়াই হয়ে গেল দুজনের, ওয়াসিমের সামনে রান তো দূরস্ত সামান্য ব্যাট হাতে দাঁড়ানোর কথা ভেবেই দুঁদে ব্যাটসম্যানরা সরে যাচ্ছে নন স্ট্রাইকারের দিকে। স্যার রিচার্ড হ্যাডলি নয়, এমন কি কিছুটা বাদে কার্টলি অ্যামব্রোসও নয়- এই দুঃসহ বিভীষিকা যাকে শুধু ফেস করার জন্য ব্যাটসম্যানের মধ্যে ঝগড়া আগে হয়েছে?

শচীন টেন্ডুলকার তখন সদ্য ১৬। একটু লড়লেন। ক্যারিয়ারের শেষে বলেছিলেন ১৬ থেকে ৪০ অবধি ওয়াসিমকে যে কটা শট মারতে পেরেছি সেগুলোর সাথে কারও তুলনা করবো না।

এদিকে পেস বোলিং খেলার যে তিন গাভাস্কারীয় ফর্মূলা তাকে চ্যালেঞ্জ করে ফেলেছেন ওয়াসিম। লাগাতার অফ স্টাম্পের বাইরে বল করে ব্যাটসম্যানকে অসহ্য করে যাবার স্ট্র্যাটেজি গাভাস্কারের মতো ঠান্ডা মাথার মানুষ পেনিট্রেট করে দেবেন, স্বয়ং ম্যাকগ্রাও কিন্তু এই ফর্মূলা ভাঙতে পারেন নি, এখানেই ওয়াসিম বিশ্বের বোলিং প্রজন্মকে দুভাগ করে চিড়ে দৌড় শুরু করেন।

দুটো আউট সুইং-এর প্রতিক্রিয়া না এলেই পায়ের গোড়ায় এসে যাবে আগুনে ইনসুইং ইয়র্কার, সেটা কোনো মতে সামলালে চার নম্বর বলটা আসবে পাঁজড়ের দিকে বেঁকে আসা বুলেট, সেটাও উতরে গেলে যদি পুরোনো বল হয় তাহলে তাঁর ব্রহ্মাস্ত্র, রিভার্স সুইং- চৌষট্টি খোপ ছেড়ে বন্দী রাজা থুড়ি ব্যাটসম্যান তখন অসহায়, চেকমেট!

ক্যারিবিয়ান পেস চতুষ্টয় কিংবা ডেভিডসন, ডেনিস লিলি- এজব্যাস্টন-মেলবোর্ন থেকে অ্যান্টিগার যে উইকেটে সুইং সহায়তা পেয়েছেন প্রতিটি ক্ষেত্রে সেখানে ওয়াসিম কী পেলেন? পাকিস্তানের পুরোনো উইকেট ছাড়া উপমহাদেশে পেস স্বর্গ কোথায় আর ওভারসিজের মত? নেই!

ঠিক যেমন ওভারসিজে একটা শেন ওয়ার্ন হয়ে ওঠা যায় না, জন্মাতে হয় ওয়ার্ন হয়ে তেমনই উপমহাদেশে একটা ওয়াসিম আকরামের জন্ম দিয়েছিলেন এক অতিমানবীয় ক্রিকেট গ্রেট!

ভাঙতে ভাঙতে উঠছেন ওয়াসিম, স্ত্রীর চলে যাওয়া, গড়াপেটার দায়ে খুনের হুমকি – ওয়াসিম ছুটছেন। পাঞ্জাবের অমৃতসরের মুসলিম পরিবার দেশভাগের সময় ছুটে গিয়েছিল লাহোরে, এই দৌড় রক্তে নিয়েই জন্ম আকরামের, শচীন নিয়ে প্রশ্ন ওঠার কথা নয় তবু ওঠে যে ক্যারিবিয়ান পেস চতুষ্টয় তাকে খেলতে হয়নি, কিন্তু ওয়াসিম? না! শ্রেষ্ঠ বোলারের বিশ্বব্যাপী সমীক্ষায় ওয়াসিমের ধারেকাছে আর দাঁড়াতে পারলো কে? স্ট্যাটে? জনপ্রিয়তায়? জাস্ট কেউ নেই!

কিন্তু রসায়ন? এই সাফল্যের পিছনে অঙ্কের ফর্মূলা তো খাটে না, খাটে জীবনের ঐকিক নিয়ম। যেভাবে অম্লান মুখে ওয়াসিম বলতে পারেন, ‘আগে ঠিক করো কি হতে চাও, যদি নিজের নামটুকু হয়ে থাকতে চাও তাহলে এই যা করছ যথেষ্ট, আর যদি ইতিহাস হতে চাও তাহলে যেনো আগুনের ভেতর দিয়ে নিজেকে পুড়িয়ে নিখাদ করতে হবে।’

কথাটা শেষ করেই সোফা ছেড়ে উঠে যান জীবন্ত ইতিহাস, ক্ষয়ে যাওয়া লালবলটা রিভার্স সুইং করে চিড়ে দিচ্ছে পৃথিবীকে, দুটো গোলার্ধে ভেঙে যাচ্ছে বাইশ গজের বোলিং লাইন আপ, একদিকে গার্নার থেকে লিলি, ম্যাকগ্রা থেকে অ্যামব্রোস, আর অন্যদিকে, আর কে!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link