২০০৬ সালের বিশ্বকাপ ফাইনাল; নির্ধারিত সময় পেরিয়ে যখন অতিরিক্ত সময়ের খেলা চলছিল তখন মাঠে দেখা যায় এক অদ্ভুতুড়ে দৃশ্য। ফ্রান্স তারকা জিনেদিন জিদানের মাথার ঢুস খেয়ে মাঠে গড়াগড়ি খেতে শুরু করেন এক ইতালিয়ান ডিফেন্ডার। সেই দৃশ্যটি আইকনিক মর্যাদা লাভ করেছে জিদানের জন্যই।
জিনেদিন জিদানকে নিয়েই হয়েছে যত আলোচনা হ্যাঁ, এত আলোড়নের সবটুকু এই কিংবদন্তির প্রাপ্য। কিন্তু আজ কথা হবে মুদ্রার আরেকটা পিঠ নিয়ে; সেদিন মাটিতে গড়াগড়ি খাওয়া আজ্জুরি রক্ষণসেনা মার্কো মাতেরাজ্জিকে নিয়ে। অবশ্য শুধু জিদানের ঢুস হজমের জন্য মাতেরাজ্জি মনে রাখলে অবিচার হবে; এই ডিফেন্ডারের জীবনেও রয়েছে মনে রাখার মত একটি ক্যারিয়ার।
বিশ্বকাপ ফাইনালে গোল করেছেন এমন খেলোয়াড়দের মধ্যে মাত্র দুইজন ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগে খেলছেন। সেই দুইজনের একজন হচ্ছেন মার্কো মাতেরাজ্জি। এছাড়া ডিফেন্ডিংয়ের ক্ষেত্রে মাতেরাজ্জির শারীরিক দক্ষতা সবসময় প্রতিপক্ষের মাথা ব্যাথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
মার্কো মাতেরাজ্জি নিজের পেশাদার ফুটবল ক্যারিয়ার শুরু করেন ইতালির নিম্নস্তরের লিগগুলোতে। এরপর ১৯৯৫ সালে তিনি চলে আসেন ‘সিরি বি’ এর ক্লাব পেরুগিয়াতে। কিন্তু এক বছর পর তাকে লোনে পাঠায় ক্লাবটি। ১৯৯৬/৯৭ মৌসুমে সিরি ‘সি’ লিগে খেলেন। এরপর আবার ১৯৯৮/৯৯ মৌসুমে মাতেরাজ্জি প্রিমিয়ার লিগে খেলেন। অবশ্য এভারটনের হয়ে এই এক মৌসুম রাঙিয়ে রাখতে পারেননি তিনি।
১৯৯৯ সালে পুনরায় পেরুগিয়াতে ফেরার পর নিজের ফর্ম খুঁজে পান মার্কো মাতেরাজ্জি। সেই বছরই পেরুগিয়া সিরি ‘এ’-তে উন্নীত হয়েছিল। ২০০০/০১ মৌসুমে ইতালির সর্বোচ্চ লিগে রেকর্ড গড়েন মাতেরাজ্জি। ডিফেন্ডার হয়েও পুরো মৌসুমে ১২ গোল করেন তিনি, যদিও এর মাঝে সাতটিই ছিল পেনাল্টি। তবে একজন ডিফেন্ডার কর্তৃক একটি লিগ আসরে সর্বোচ্চ গোলের রেকর্ড ভাঙ্গতে এটাই যথেষ্ট ছিল।
২০০৪ সালে ইন্টার মিলান তরুণ মার্কো মাতেরাজ্জিকে নিজেদের দলে ভেড়ায়। তারপর থেকেই ইভান কর্দোভার সাথে জুটি গড়ে দলটিকে এগিয়ে নিতে শুরু করেন তিনি। ইন্টারের জার্সিতেই নিজের প্রথম চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জয়ের স্বাদ পান এই ইতালিয়ান। এছাড়া ২০০৬ সালে সিরি ‘এ’ জিতে নেন তিনি।
এই বছরটাই হয়তো মার্কো মাতেরাজ্জির ক্যারিয়ারের সবচেয়ে স্মরণীয় হয়ে আছে। কেননা ২০০৬ সালে সিরি এ জেতার পাশাপাশি জাতীয় দল ইতালিকেও বিশ্বকাপ ট্রফি এনে দিয়েছিলেন তিনি। বিশ্ব আসরে আজ্জুরিওদের হয়ে যৌথভাবে সর্বোচ্চ গোলদাতা ছিলেন এই ডিফেন্ডার, এর মাঝে ফাইনালে তাঁর কাছ থেকেই এসেছিল সমতাসূচক গোলটি। এছাড়া টাইব্রেকারেও নিজের কাজটা ভালভাবে করেছিলেন তিনি।
এরপর পরের বছর থেকে টানা চারবার ঘরোয়া লিগে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করে ইন্টার মিলান। এর পাশাপাশি হোসে মরিনহোর কোচিংয়ে ট্রেবল জয়ের কৃতিত্ব গড়ে তারা। মিলানের ক্লাবটির এমন আধিপত্যে অবদান রেখেছিলেন মাতেরাজ্জি। শেষপর্যন্ত অবশ্য ৩৭ বছর বয়সে ২০১১ সালে ইন্টার মিলানকে বিদায় বলেন তিনি।
এরপরের তিন বছর ফুটবল থেকেই দূরে ছিলেন এই ইতালিয়ান কিংবদন্তি। তবে ২০১৪ সালে অপ্রত্যাশিত একটা অধ্যায়ের সৃষ্টি হয়। বিশ্ব ফুটবলের তুলনামূলক পেছনের সারির দেশ ভারতের লিগ মাতাতে চলে আসেন মার্কো মাতেরাজ্জি। চেন্নাই এফসির খেলোয়াড় ও ম্যানেজার হিসেবে ইন্ডিয়ান সুপার লিগে (আইএসএল) যোগ দেন তিনি।
প্রথম মৌসুমে খেলোয়াড় হিসেবে খুব একটা সফল না হলেও পরের বছর কোচের ভূমিকায় চমৎকার ছিলেন মার্কো মাতেরাজ্জি। তাঁর অধীনে গোয়াকে হারিয়ে সুপার লিগ ফাইনাল জিতে নেয় চেন্নাই। তবে ২০১৬ সালে সন্তোষজনক পারফরম্যান্স করতে ব্যর্থ হওয়ায় চেন্নাই এই ইতালিয়ান ডিফেন্ডারের সাথে চুক্তি সমাপ্তির ঘোষনা দেয়।
রাফ অ্যান্ড টাফ ট্যাকেল, গুরুত্বপূর্ণ সময়ে গোল আর লাল-হলুদ কার্ড মার্কো মাতেরাজ্জির ক্যারিয়ারের সবচেয়ে বড় হাইলাইটস। নেস্তা, ক্যানাভেরো, পিরলো, ডেল পিয়েরো, টট্টি, ইনজাঘিদের মত কিংবদন্তিদের সাথে খেলা মাতেরাজ্জি নিজেও একজন কিংবদন্তি, একজন আইকন।
ইতালিয়ান ফুটবল দলের ইতিহাসে কাব্যে এই দুর্দান্ত ডিফেন্ডারের নাম থাকবে, থাকবে ইন্টার মিলানের গল্পগুলোতেও। আর হ্যাঁ, তিনি থাকবেন রেফারির সেই বুকপকেটের ছোট্ট নোটবুকেও।