টি-টোয়েন্টির ম্যাচজয়ী ‘টিম ম্যান’ কি শুধুই মিথ?

পরীক্ষিত পারফর্মার নাকি দলগত সাফল্যে মোড়ানো একজন ক্রিকেটার? এই দুই-এর মধ্যে আপনি কাকে দলে ভেড়াতে চাইবেন? বেশ ধন্দে ফেলে দেওয়ার মতোই একটা প্রশ্ন। কারণ পরীক্ষিত পারফর্মারদের বদৌলতেই তো দলের সফলতা আসে। আবার ‘টিমম্যান’ তকমায় অনেকে একটি দলের জন্য ‘লাকি ম্যান’ বনেও যান।

এই যেমন স্যাম কারেন। ইংলিশ এ পেসারকে নিয়ে তো এবারের আইপিএলে দলগুলোর মাঝে নিলামের টেবিলে রীতিমত কাড়াকাড়ি শুরু হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত সাড়ে আঠারো কোটি রূপিতে তাঁকে দলে ভেড়াতে সক্ষম হয় পাঞ্জাব কিংস। ইংলিশদের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ জয়ের পথযাত্রায় ম্যান অব দ্য ফাইনাল আর টুর্নামেন্ট সেরা- দুই পুরস্কার একাই বাগিয়ে নিয়েছিলেন এই স্যাম কারেন। আর এরপর থেকেই সবার নজরে পড়তে শুরু করেন তিনি।

তবে স্যাম কারেন শুধু যে নিজের পারফরম্যান্স গুণেই বিশ্ব ক্রিকেটে নজরের কারণ হয়েছেন তা কিন্তু নয়। এখন পর্যন্ত, ইংলিশ ক্রিকেটে তাঁর ক্যারিয়ার বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ইংল্যান্ড ক্রিকেটের জন্য বেশ পয়া এক নাম স্যাম কারেন। কিভাবে সেটা?  টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে তাঁর অভিষেকের পর ইংল্যান্ড ৬২.৯০ শতাংশ ম্যাচেই জয়ের মুখ দেখেছে।

স্যাম কারেন বাদে সেই হারটা প্রায় ১০ শতাংশ কমে ৫৩.৮০%। আবার টেস্ট ক্রিকেটে স্যাম কারেনের অভিষেকের পর তাঁর খেলা ২৪ ম্যাচের ১৬ টিতেই জয় পেয়েছে ইংলিশরা। যেখানে তাঁর না খেলা ৩৪ টি টেস্টে ইংল্যান্ড জয়ের মুখ দেখেছে মাত্র ১৩ টি ম্যাচে। পরিসংখ্যানেই স্পষ্ট, ইংলিশ শিবিরে স্যাম কারেনের উপস্থিতি ইংল্যান্ডের জন্য কতটা সৌভাগ্যজনক।

তবে এমন সব পরিসংখ্যানের আড়ালেও তো কিছু ফাঁকফোকর থেকে যায়। ইংল্যান্ডের হয়ে ‘পয়া’ স্যাম কারেন আবার আইপিএলে অপয়া এক নাম। আইপিএলে এখন পর্যন্ত খেলেছেন ৩২ টি ম্যাচ। কিন্তু তার অর্ধেক ম্যাচই হেরেছেন তিনি। এখানে ‘তিনি’ বলাটাতে অবশ্য ভুল হলো। কারণ ক্রিকেট কোনো একক খেলা নয়। এটা দলগত খেলা। তাই দিনশেষে একটা প্রশ্নের উদ্ভব স্বয়ংক্রিয়ভাবেই হয়ে যায়। ম্যাচ জেতা ক্রিকেটার কি দলের জন্য সবসময়ই ভাল নাকি এটা শুধু একটা মিথ? আপাতত এই প্রশ্নকে কেন্দ্র করেই এই লেখার ডালপালা বাড়ানো যাক।

২০২০ এর মার্চ থেকে পরিসংখ্যান যদি কপচানো যায় তাহলে দেখা যায়, এই সময়কালে প্রায় ২০০ জন ক্রিকেটার অন্তত ৫০ টা করে স্বীকৃত টি-টোয়েন্টি ম্যাচ খেলেছেন। তো এদের মাঝে জয়-হারের অনুপাত বিবেচনায় সবচেয়ে সফল ক্রিকেটার হলেন ইংল্যান্ডের লরি ইভানস।

এই তালিকায় ফিন অ্যালেন, হার্দিক পান্ডিয়া, সুরিয়াকুমার যাদবের পাশাপাশি স্যাম কারেনও আছেন। সেরা দশের এই তালিকায় কৌতুহলদ্দীপক ব্যাপারটা হলো, দশ জনের মধ্যে ছয় জনই হচ্ছেন বাঁহাতি ক্রিকেটার। অর্থাৎ ম্যাচ জয়ের দিক দিয়ে সফলতার বিবেচনায় এগিয়ে বাঁহাতিরা।

একই সময়কালে ম্যাচ জয়-হারের অনুপাতে সবচেয়ে বাজে অবস্থানে রয়েছেন ক্রিস লিন, রবি বোপারা, নিকোলাস পুরান, রভম্যান পাওয়েল, মোহাম্মদ আমিরদের মতো ক্রিকেটাররা। আবারো বলা শ্রেয়, দলগত খেলা ক্রিকেটে ম্যাচ হারের সংখ্যা দিয়ে একজন ক্রিকেটারকে ‘অপয়া’ তকমা দিয়ে দেওয়াটা বোকামি।

অনেক ক্ষেত্রে সেটা নির্বুদ্ধিতাও। কারণ ম্যাচ জয় কিংবা পরাজয়ের পরিসংখ্যান শুধু একটা সংখ্যা কথা বলে। একজন ক্রিকেটার কোন দলে খেলছেন, কিংবা সে দলের শক্তমত্তা কতটুকু, প্রতিপক্ষ দল কেমন- সে সব সহ আরো অনেক ফ্যাক্টর থাকে। পরিসংখ্যানে সে সব কথা উল্লেখ থাকে না।

এ ক্ষেত্রে উদাহরণ টানা যেতে পারে আফগানিস্তানের মোহাম্মদ নবীর ক্ষেত্রে। ক্যারিয়ারে অসংখ্য টি-টোয়েন্টি খেলেছেন। তবে প্রথমদিকে তাঁর দলগত সাফল্য যতটা ছিল পরে ঠিক তেমনটা আর দেখা যায়নি। এর কারণ হলো, আফগানিস্তান এর আগে বেশিরভাগ ম্যাচ খেলতো সহযোগী দলগুলোর সাথে। পরবর্তীতে তাদের খেলতে হয়েছে ক্রিকেটের শীর্ষ দলগুলোর সাথে। এ কারণে সফলতার ঐ গ্রাফটা আর ঊর্ধ্বমুখী হয়নি।

আইপিএলের ক্ষেত্রে এই জয়-হারের অনুপাত হিসেব করলে একটি দারুণ বিষয় পরিলক্ষিত হয়। এখানে যে খেলোয়াড়রা একটি দলে বেশ ক’বছর ধরে খেলেছে তাদের সফলতার হার অনেক বেশি। কিন্তু যাদের মৌসুমের পর মৌসুম দল পরিবর্তন হয়েছে তাদের সফলতার হার তুলনামূলক কম।

এ ক্ষেত্রে দুই জন ক্রিকেটারকে উদাহরণ হিসেবে টেনে আনা যেতে পারে। শ্রীলঙ্কার সাবেক ব্যাটার তিলকারত্নে দিলশান আইপিএলে জয়-হারের অনুপাতে বেশ সফল। এমনকি সব মিলিয়ে তিনি এই তালিকায় সেরা দশেও আছেন। অপর দিকে অস্ট্রেলিয়ার অ্যারন ফিঞ্চ আবার এই অনুপাতে সবচেয়ে বাজেদের তালিকায় আছেন।

অথচ, ব্যক্তিগত নৈপুণ্যে এই ফিঞ্চই আবার এগিয়ে। কিন্তু তাঁর সেই নিপুণতা দলে তেমন কাজে আসেনি, যতটা আবার এসেছে দিলশানের বেলায়। এই পরিস্থিতিতে একটি কারণই উঠে আসবে। আইপিএলে দিলশানের তেমন দল বদল হয়নি, এক দলের হয়েই তিনি অনেক বছর খেলেছেন। কিন্তু অ্যারন ফিঞ্চ ঠিক কোনো দলেই তেমন থিতু হতে পারেনি।

ঠিক এমন পদ্ধতিই অবলম্বন করে থাকে আইপিএলের সফল দলগুলো। মুম্বাই আর চেন্নাই- এ দুই দলই আইপিএলের সবচেয়ে সফল দুই দল। একটু ঘাঁটাঘাঁটি করলেই দেখা যায়, তাদের সাফল্যের নেপথ্যে ছিল বছরের পর বছর একই খেলোয়াড় দিয়ে দল চালনা করা।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, আইপিএলের দলগুলো কি এভাবে খেলোয়াড়ের জয়-পরাজয়ের অনুপাত বিবেচনা করে দল সাজান? মোটেই না। মূলত প্রত্যেকটা দল বড় ম্যাচ খেলা অভিজ্ঞ খেলোয়াড়দের দলে টানতে চায়। স্বাভাবিক ভাবে তাই ম্যাচ জেতা অভ্যস্ত খেলোয়াড়রাই বিবেচনায় এগিয়ে যান। এখন একজন ক্রিকেটারের যদি ৩৫ শতাংশ ম্যাচ জেতার পরিসংখ্যান থাকে আর আরেকজন ট্রফিলেস থাকে ক্যারিয়ারে, তাহলে ঐ ৩৫% জেতা ক্রিকেটারই নজরে চলে আসেন।  কারণ ঐ ক্রিকেটার ম্যাচ জেতার আবহ, কিংবা ম্যাচের প্রেশার সিচুয়েশন অন্য ক্রিকেটারের চেয়ে ভাল বুঝেন। তাই স্বাভাবিকভাবেই দলে তাঁর অবদান রাখার সম্ভাবনা বেশি।

ট্রফি নিয়ে যখন কথা উঠলো, তখন একজনের কথা তুলতেই হয়। এ বি ডি ভিলিয়ার্স। দুর্দান্ত ব্যাটার। ক্রিকেট ইতিহাসে যার পরিচিতি মিস্টার ৩৬০ হিসেবে। ক্যারিয়ার জুড়ে চার ছক্কার ফুলঝুরিতে সমর্থকদের আনন্দে ভাসিয়েছেন। কিন্তু এই ক্রিকেটার একটি বারও আইপিএল শিরোপা জেতেননি। এমনকি ক্যারিয়ারে বলার মতো কোনো শিরোপাও তিনি জিততে পারেননি।

এমন সব বৈপরীত্যময় উদাহরণে রয়েছে ক্রিস গেইলেরও নাম। ওয়েস্ট ইন্ডিজের হয়ে দুই বার বিশ্বকাপ জিতেছেন। তবে যে ব্যাটার ফ্রাঞ্চাইজি ক্রিকেটে নিজের আগ্রাসন দেখিয়ে হয়ে উঠেছিলেন টি-টোয়েন্টির ফেরিওয়ালা সেই তিনি প্রথম ফ্রাঞ্চাইজি শিরোপা জিতেছিলেন প্রথম টি-টোয়েন্টি খেলার প্রায় ১৫ বছর পর। ডি ভিলিয়ার্সের মতো তাঁরও নেই কোনো আইপিএল শিরোপা। অথচ একক নৈপুণ্যে আইপিএলের যে কত ম্যাচে প্রতিপক্ষকে স্রেফ উড়িয়ে দিয়েছেন তার ইয়ত্তা নেই।

মোদ্দাকথা হলো, একক নৈপুণ্যে ম্যাচ জেতা যায়। কিন্তু শিরোপা কিংবা ট্রফির জন্য প্রয়োজন টিম পারফরম্যান্স। এ ক্ষেত্রে প্রভাবক হিসেবে ভাগ্যও আসতে পারে। এমন অনেক ক্রিকেটারের বেলাতে হয়েছে যে, ক্যারিয়ারের প্রথম সময়ে বেশ কিছু ট্রফি জিতেছেন কিন্তু পরে একটি ট্রফির জন্য হন্যে হয়ে খুঁজছে। বিরাট কোহলি যেমন ২০১১ তে বিশ্বকাপ আর ২০১৩ সালে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি জিতে সম্ভাব্য সব ট্রফি জেতার দৌড়ে ছিলেন।

কিন্তু, প্রায় এক দশক পেরিয়ে যাচ্ছে, তিনি আর তাঁর অর্জনের তালিকায় আর দলগত ট্রফি যোগ করতে পারেননি। একইভাবে, আন্দ্রে রাসেলও ফ্রাঞ্চাইজি ক্রিকেটে একসময় দলগত শিরোপা জেতার দিক দিয়ে দারুণ সফল ছিলেন। আইপিএল, বিপিএল, বিবিএল থেকে শুরু করে নিজ দেশের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ-সব শিরোপাই জিতেছিলেন। কিন্তু বছর তিনেক  পেরিয়ে যাচ্ছে, আন্দ্রে রাসেল আর কোনো শিরোপা জিততে পারেনি। সেই দরুণে তাঁর ম্যাচ জয়-পরাজয়ের অনুপাতও নিম্নগামী হয়েছে।

দিনশেষে, তাই ম্যাচজয়ী ক্রিকেটাররা দলের জন্য সৌভাগ্যের প্রসূতি, এ ভাবনাটা কোনো মিথ নয়। তবে এটা আবার চিরায়তও নয়। কারণ এই বিবেচনায় আজকের সফল ক্রিকেটাররা বছর খানেক পরেই ব্যর্থতায় মুখ থুবড়ে পড়তে পারেন।

মূলত ম্যাচ জেতার অভ্যস্ততা আর অবশ্যম্ভাবী ভাবে নিজের পারফরম্যান্সের মিশেলেই একটা দলের সফলতা আসে। তবে সেই পারফরম্যান্সগুলো হতে হয় ম্যাচ উইনিং। অর্থাৎ দলের জন্য তা কতটুকু কাজে আসবে সেটিই মূখ্য বিষয়। দলে কাজে না আসা একক পারফর্মারের চেয়ে গড়পড়তা ম্যাচ উইনাররাই দলকে দিনশেষে এগিয়ে নিয়ে যায়। ক্রিকেটীয় পরিসংখ্যান কিংবা ইতিহাস সেই বার্তায় দেয়।

লেখক পরিচিতি

বাইশ গজ ব্যাসার্ধ নিয়ে একটি বৃত্ত অঙ্কন করার চেষ্টা করি...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link