তারার মেলার বঞ্চিত তারা

চামড়ার বলের খেলা ফুটবল তো অনেক দেশ খেলে তবে ফুটবলের সবচেয়ে বড় আসর বিশ্বকাপে সুযোগ পায় মাত্র বত্রিশ দল। তবে সব সময়ই যে সেরা বত্রিশ দল সুযোগ পায় তা কিন্তু নয়। বাছাইপর্বে মহাদেশীয় বিভাজন থাকায় প্রায় সময়ই সেরা বত্রিশ দল নির্বাচিত হয় না বিশ্বকাপে।

অনেক অপ্রত্যাশিত আর নাটকীয় ঘটনায় কখনো কখনো সেরা দলও বাদ পড়ে যায়, শুধু তাই নয় পুরো চার বছর ক্লাব ফুটবলে দাপিয়ে বেড়ানো অনেক সেরা ফুটবলারও ভাগ্যের প্রহসনে বিশ্বমঞ্চে খেলার সুযোগ পান না। এবারের কাতার বিশ্বকাপে সুযোগ না পাওয়া কয়েকজন বড় মাপের ফুটবলারকে নিয়ে আজকের আয়োজন।

  • মোহামেদ সালাহ (মিশর)

ফুটবল বিশ্বকাপ মিস করা তারকাদের মধ্যে নি:সন্দেহে উপরের দিকে থাকবেন মিশরের অধিনায়ক সালাহ। লিভারপুল ক্লাবের হয়ে খেলা এই ফুটবলারের ভক্ত সারা বিশ্ব জুড়েই। কিন্তু সেনেগালের বিপক্ষে হেরে মিশর এবার বাদ পড়েছে বিশ্বকাপ বাছাই থেকে। পেনাল্টি মিস করা সালাহ অবশ্য হারের দায় এড়াতে পারেন না।

গত বিশ্বকাপে শেষ মূহুর্তে পেনাল্টি গোল করে দলকে বিশ্বকাপে নিতে পারলেও ইনজুরির কারণে খেলতে পারেননি পুরোপুরি। এবার বিশ্বকাপেই অংশ নেয়া হলো না তার। লিভারপুলের হয়ে দূর্দান্ত ফর্মে থাকা এই উইঙ্গারকে বিশ্বকাপ দেখতে না পারা দর্শকদের জন্য হতাশাজনকই বটে।

  • মার্কো ভেরাত্তি (ইতালি)

আজ থেকে এক মাস আগেও কেউ যদি বলতো ইতালি এবার বিশ্বকাপে সুযোগ পাবে না, তাহলে নিশ্চয়ই সেটাকে পাগলের প্রলাপ ধরে নিতেন। তবে সবাইকে অবাক করে দিয়ে ইতালি ঠিকই বাদ পড়েছে কাতার বিশ্বকাপের বাছাই পর্ব থেকে। আর তারই সাথে বিশ্বকাপে মার্কো ভেরাত্তি এর মত একজন ‘মিডফিল্ড মায়েস্ত্রো’র নিপুণতা দেখার সম্ভাবনা শেষ হয়ে গিয়েছে।

 পিএসজি’র এই খেলোয়াড় ইউরো কিংবা বাছাইপর্ব সর্বত্রই ইতালির হয়ে পারফর্ম করেছিলেন কিন্তু শেষ অবধি মাঠ ছাড়তে হয়েছে মাথা নিচু করেই।

  • জ্লাতান ইব্রাহিমোভিচ (সুইডেন)

যত গর্জে তত বর্ষে না – প্রবাদের চাক্ষুষ মানব মূর্তি হয়তো এই সুইডিশ স্ট্রাইকার। সাক্ষাৎকারে যতটা আগ্রাসী ততটা আগ্রাসী মাঠে হতে পারেননি তিনি। তাই লেওয়ানডস্কি’র পোলান্ডের বিপক্ষে হেরে বিশ্বকাপ বাছাই থেকে বাদ পড়েছে সুইডেন। তবে তার মত একজন বিনোদন দাতা বিশ্বকাপে না থাকাটা মেনে নেওয়া শক্ত। কি জানি, বিশ্বের সেরা খেলোয়াড় বিশ্বকাপে নেই, এমন অজুহাতে হয়তো ইব্রাহিমোভিচ নিজেই খেলা দেখবেন না এবার।

  • আর্লিং হাল্যান্ড (নরওয়ে)

নরওয়েজিয়ান সুদর্শন এই তরুণ-কে আগামী বিশ্বের অন্যতম প্রতিভাবান ফুটবলার ভাবা হয়। বহুশিয়া ডর্টমুন্ডের হয়ে খেলা হালান্ড ইতোমধ্যে ইউরোপীয় ফুটবলে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। তবে ফুটবলের শক্তিতে অপেক্ষাকৃত দুর্বল দল নরওয়ে’র সদস্য হওয়ায় বিশ্বকাপ খেলা হয়ে ওঠেনি এই তরুণের।

ফ্রান্স সুপারস্টার কিলিয়ান এমবাপ্পে’র প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে হালান্ডকে বিশ্বকাপ দেখতে অনেকেই নিশ্চয়ই অপেক্ষায় ছিলেন। তবে আপাতত অপেক্ষা দীর্ঘ হচ্ছে।

  • রিয়াদ মাহরেজ (আলজেরিয়া)

ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ অনুসরণ করা যেকোনো ফুটবল ভক্তের কাছে পরিচিত এক নাম রিয়াদ মাহরেজ। ম্যানচেস্টার সিটি’র এই ফুটবলারের দেশ আলজেরিয়া আফ্রিকা মহাদেশ থেকে বিশ্বকাপে কোয়ালিফাই করবে সেটি অনুমেয় ছিল।

কিন্তু, প্লে-অফ ফাইনালে ক্যামেরনের বিপক্ষে একেবারে অন্তিম মূহুর্তে গোল হজম করে ম্যাচ হেরে যায় তারা, পাশাপাশি বাদ পড়ে বিশ্বকাপ বাছাই থেকেও ৷ আর তাই ‘ডেজার্ট ফক্স’ অধিনায়ক রিয়াদ মাহরেজকে দেখা যাবে না কাতারে।

  • ইয়ান অবলাক (স্লোভেনিয়া)

অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদের অধিনায়কের আর্মব্যান্ড যার বাহুতে থাকে, ইউরোপের বর্তমান সেরা পাঁচজন গোলরক্ষকের তালিকায় যার নাম থাকবে নি:সন্দেহে সে ইয়ান অবলাক এর আন্তজার্তিক ঠিকানা অনেকেই জানে না।

অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদের এই গোলরক্ষক স্লোভেনিয়া জাতীয় দলের সদস্য; অবশ্য জাতীয় দলে তার ভাগ্য খুব একটা ভাল নয়। স্লোভেনিয়া ফুটবলের পরাশক্তি নয়, কোন অঘটনও ঘটাতে পারে নি। তাই প্রজন্মের অন্যতম সেরা গোলরক্ষক ইয়ান অবলাকের খেলা হবে না ২০২২ কাতার বিশ্বকাপে।

  • ডেভিড আলাবা (অস্ট্রিয়া)

ইউরোপ ফুটবলের টুকটাক খবর রাখলেও এতদিনে নিশ্চয়ই ডেবিড আলাবা’কে চেনা হয়ে গিয়েছে। সাবেক বায়ার্ন মিউনিখের ফুটবলার আলাবা বর্তমানে খেলেন রিয়াল মাদ্রিদে। অস্ট্রিয়া জাতীয় দলের অধিনায়কত্ব করেন তবে লড়াই করেও এবার নিজ দেশের বিশ্বকাপে খেলার স্বপ্ন পূরণ করতে পারেননি তিনি। তারই ক্লাব সতীর্থ গ্যারেথের বেলের নৈপুণ্যে ওয়ালশের বিপক্ষে হেরে স্বপ্ন ভঙ্গ হয়েছে এই অস্ট্রিয়ানের।

এদের ছাড়াও আরো বেশকিছু নাম রয়েছে যারা মিস করবে বিশ্ব আসর অথবা বলা যায় তাদেরকেই মিস করবে বিশ্ব ফুটবল। দক্ষিণ আমেরিকার অ্যালেক্সিস সানচেজ, আর্তুরো ভিদাল, লুইস দিয়াস, হামেস রদ্রিগেজ এর মত তারকা ফুটবলার’রা রয়েছেন বাদ পড়া দের তালিকায়।

তাছাড়া ইতালির মত দল বাদ পড়ায় ডোনারুম্মা, জর্জিনহো, ফেদেরিকো কিয়েজা, লিওনার্দো বনুচ্চি, জর্জিও কিয়েলিনি, ইম্মোবিলের মত খেলোয়াড়দের বিশ্বকাপে অংশগ্রহন করা হচ্ছে না। তুরস্কের বুরাক ইলমাজের মত অভিজ্ঞ স্ট্রাইকারও ব্যর্থ হয়েছেন দলকে বিশ্বকাপের টিকেট এনে দিতে।

বার্সেলোনা’র পিয়েরি-এমেরিক আউবামেয়াং, আর্সেনালের মার্টিন ওডেগার্ড, আয়াক্সের সেবাস্টিন হালার, এসি মিলানের ফ্রাঙ্ক কেসি, লিভারপুলের নাবি কেইতাদের মত ক্লাব ফুটবলে দাপিয়ে বেড়ানো অনেক ফুটবলারকেও কাতারে অনুষ্ঠিত এই বিশ্বকাপে খুঁজে পাবে না সমর্থকরা।

প্যাটট্রিক শিক, এমিল ফর্সবার্গ’রা মুগ্ধতা ছড়িয়েছিলেন ইউরো-২০২০ টুর্নামেন্টে তবে বিশ্বকাপের বড় মঞ্চে মাঠে নামার সুযোগ বিধাতা দেয়নি তাদের। গ্যারেথ বেল, কেইলর নাভাস’দের ভাগ্যও এখনো দোদুল্যমান, নিশ্চিত হয়নি বিশ্বকাপযাত্রা।

‘দ্য গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ’ খ্যাত ফুটবল খেলা নির্মমই বটে, আপনি চাইলেও অনেক কিছু করতে পারবেন না। এই যেমন ইতালিকে বিশ্বকাপে খেলার সুযোগ দিলে ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো’র পর্তুগালকে বাদ দিতে হবে। কিংবা ইব্রাহিমোভিচ’কে বিশ্বকাপ খেলার সুযোগ দিতে হলে সরে যেতে হবে লেওয়ানডস্কিকে। মোহামেদ সালাহ’কে বিশ্বকাপে দেখতে চাইলে তারই ক্লাব সতীর্থ সাদিও মানে’কে দেখতে পাবেন না।

ক্লাব ফুটবলের কিংবদন্তি এরিক ক্যান্টোনা, জর্জ উয়েয়াহ, রায়ান গিগস, জর্জ বেস্ট, আলফ্রেডো ডি স্টেফানোর মতো অনেককে তো অবসরে যেতে হয়েছে বিশ্বকাপ অংশ নিতে না পারার দুঃখ নিয়ে। এই তালিকায় প্রতি আসরেই যোগ হয় নতুন নতুন নাম। প্রকৃতির এমন হেঁয়ালিপূর্ণ আচরন থামানো যায় না, বাদ পড়াও যে বিশ্বকাপের অংশ। প্রিয় দলের কিংবা খেলোয়াড়ের এমন বিদায় হয়তো পূর্নতা দেয় ‘গ্রেটেস্ট শো’-টিকে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link