ক্রিকেটের জন্য মরে যেতে হবে!

সজিবুল ইসলাম সজীব।

এই নামটা সাকিব-তামিমের মতো পরিচিত কারো নয়। এমনকি আকবর আলী বা মাহমুদুল হাসানের মতোও চেনা নাম নয়। তারপরও এই নামটা আমাকে মাথা ঠাণ্ডা করতে দিচ্ছে না। আমি কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছি না, এই নামের ২২ বছর বয়সী এক ক্রিকেটার আত্মহত্যা করেছেন!

সজীব যুব বিশ্বকাপের দলের স্ট্যান্ড বাই খেলোয়াড় ছিলেন। বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমের রাজশাহী অফিস জানাচ্ছে, এবারের বঙ্গবন্ধু টি-টোয়েন্টি কাপে কোনো দল না পেয়ে তিনি আত্মহত্যা করেছেন।

কী ভয়ানক! কী ভয়ানক!

জীবনটা এতো সস্তা হয়ে গেলো রে, ভাই সজীব। ক্রিকেটের দাম এতো বেশি যে, এর জন্য মরে যেতে হবে! এটা অবিশ্বাস্য!

২০১৬ সালের কথা মনে পড়ছে।

আবুল হোসেন নামে এক ভদ্রলোক ভারত-বাংলাদেশ ম্যাচ দেখতে গিয়ে শেষ সময়ের উত্তেজনায় হার্ট অ্যাটাক করে মারা গেলেন।

ভদ্রলোকের একেবারে শিশু তিনটি সন্তান। এখন তার স্ত্রী এই তিন সন্তান নিয়ে অথৈ সাগরে পড়েছেন। সে সময় বলা হচ্ছিলো, আবুল হোসেনের এই মৃত্যুর দায় ক্রিকেটারদের। মানে, তার কথা বাংলাদেশ না হারলে তো ভদ্রলোক মারা যেতেন না। মানে, মৃত্যুর দায় দিচ্ছেন ক্রিকেটারদের!

কী বিভৎস কথা!

প্রথম কথা, স্থুল কথা হলো, বাংলাদেশ জিতলেও কী ওই ভদ্রলোক বাঁচতেন?

মৃত্যুর প্রধাণ কারণ যদি উত্তেজনাপ্রসূত হার্ট অ্যাটাক হয়, তার সাথে জয়-পরাজয়ের সম্পর্ক কম। শেষ তিন বলের যে উত্তেজনা, তাতে জয় এলেও একইরকম প্রভাব পড়তে পারতো হৃদযন্ত্রে। মানে, পরাজয় নয়, আসলে এই ব্লগের ভাষ্য অনুযায়ী খেলায় উত্তেজনা তৈরী করাই আসলে খেলোয়াড়দের ‘হত্যা কাণ্ডের’ মতো অপরাধ!

মানে, সমর্থকদের জীবন বাচাতে খেলোয়াড়দের প্রতিটি ম্যাচ শেষ হওয়ার বেশ আগে জয় বা পরাজয় নিশ্চিত করতে হবে। নইলে এই ধরণের মৃত্যুর দায়ে পড়তে হবে!

এ পর্যন্ত অবশ্যই স্থুল আলোচনা করলাম।

আসল ব্যাপার হলো, খেলাকে এই জায়গাটায় কে নিয়ে গেলো আবুল হোসেন বা সজীবের কাছে?

ক্রিকেট তো কখনোই বলেনি যে, আপনারা খেলার জন্য জীবন দিন। বরং বৈশ্বিক খেলার সুরই হলো, খেলাটা কখনোই এতো সিরিয়াস কোনো ব্যাপার নয়।

বিশ্ব জুড়ে খেলাধুলার মূল সুরও তাই। খেলা একটা পারফরমিং আর্ট। সেটাকে আরও গৌরবোজ্জল করে বলা হয়, এই আর্ট বাকীদের চেয়েও আলাদা; কারণ এটা সাফল্য-ব্যর্থতার মতো ছোট বাক্সে আটকে থাকার ব্যাপার নয়। খেলার কাজ মানুষকে বিনোদিত করা। মানুষ খেলায় আনন্দ পাবে, দুঃখ পাবে, কিন্তু কখনোই এতোটা সিরিয়াস হবে না।

এই ব্যাপারগুলো বোঝানোর জন্য অলিম্পিক কমিটি থেকে শুরু করে সবাই চেষ্টা করে। খেলোয়াড়রা বারবার বলতে চেষ্টা করেন, তারা খেলেন; যুদ্ধ করেন না।

তাহলে খেলা কেনো আবুল হোসেন বা সজীবের কাছে জীবন-মরণ ব্যাপারে পরিণত হলো?

এই দায় অবশ্যই অনেকটাই আমাদের মিডিয়ার। একটা সময় মিডিয়ার এই হুজুগে হাইপে পা দিয়ে বাংলাদেশে আর্জেন্টিনা-ব্রাজিল ম্যাচেও হার্ট অ্যাটাক করে মানুষ মারা যেতেন, ম্যারাডোনা লাল কার্ড দেখলে কেউ ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করতেন। সে দাপট কমেছে। এখন মিডিয়া আমাদের খাওয়াচ্ছে ক্রিকেটের ক্যাপসুল; সাথে জাতীয়তাবাদ মিশিয়ে।

সাথে হাওয়া দিচ্ছে বহুজাতিক কোম্পানিগুলো।

ভারতীয়, মিশরীয়, আমেরিকান, কোরিয়ান কোম্পানি এসে আমাদের বলছে-ক্রিকেট দ্যাখো, ক্রিকেটে বাঁচো, ক্রিকেটে মরো; নইলে তোমার দেশ বাচবে না। এইসব বেনিয়া ভিনদেশীরা ক্রিকেটের নাম করে আমার পতাকা আমার কাছে বিক্রি করছে!

আর আমরা সারা বিশ্বের কাছে হিংস্র-জাতীয়তাবাদী (জিঙ্গোইস্টিক) এক ক্রিকেট জাতিতে পরিণত হচ্ছি। একদিকে খেলাধুলা তার বন্ধুত্বের বানী শোনাচ্ছেন। বিপরীতে আমরা ঘৃণা ছড়াচ্ছি।

ভারত-পাকিস্তান তো ছিলোই; এখন আমরা আর কাউকে দেখতে পারি না। গেইল, স্মিথ, আমলা, বাটলার, সাউদি; সবাইকে ঘৃণা করি আমরা। আমাদের আর বন্ধু থাকতে নেই। ক্রিকেটাররা ভয়ে আর বন্ধুত্বের কথা বলতে পারেন না।

আমরা ক্রিকেটের বইপত্র পড়তে গিয়ে পড়ি কী চমৎকার সব বন্ধুত্বের গল্প। লারা-টেন্ডুলকার, ওয়ার্ন-মুশতাক, আসিফ ইকবাল-গাভাস্কার, ম্যাক পতৌদি-ক্লাইভ লয়েড; কী সব বন্ধুত্ব। আমরা বন্ধুত্ব করতে দেবো না।

আমরা চাই কেবলই ঘৃণা। আর চাই সাফল্য।

সজীবের গল্পটা আমি জানি না। সংবাদ মাধ্যমে দেখলাম, সেও উঠে এসেছে একটা বেসরকারী অ্যাকাডেমি থেকে। এরকম অনেক সজীবকে আমি রোজ সকালে রাস্তায় দেখি।

কাঁধে নিজের চেয়ে দ্বিগুন ওজনের একটা ক্রিকেট ব্যাগ। সেই নিয়ে মায়ের পাশে পাশে শ্বাস বন্ধ করে মাঠে ছোটে ছেলেগুলো। সেখানে গিয়ে সবাইকে সাকিব, তামিম, মুশফিক হতেই হবে। আনন্দের জন্য ক্রিকেট খেলা, আনন্দের জন্য ফুটবল খেলা এদের জীবন থেকে হারিয়ে গেছে। এখন ক্রিকেট খেলা মানে, আপনার বাচ্চাটিকে সাকিব বানাতেই হবে।

একসময় বাবা-মায়ের ইজ্জত ছিলো ছেলেকে ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার বানানো। এখন সেই জায়গায় একটু জায়গা করে নিয়েছে এই ক্রিকেট। একবার টপ লেভেলে গেলে টাকাই টাকা, নামই নাম। আইপিএল, বিপিএল, জাতীয় দল, টিভিতে দেখানো, পত্রিকায় সাক্ষাৎকার ছাপা হওয়া। ফলে ওই চূড়াটায় পৌছাতেই হবে। না পৌছালে ইজ্জতের একেবারে শেষ যেনো। পাশের বাসার ভাবীর কাছে আর মুখ দেখানো যাবে না।

পাশের বাড়ির ভাবির বোনের ছেলেটা এবার দক্ষিণ আফ্রিকায় সিরিজ খেলে এসেছে। আমার ছেলে এখনও আবাহনীতেই চান্স পাচ্ছে না। মুখ দেখাই কী করে! এর চেয়ে তুই গলায় দড়ি দিয়ে মর।

কেবল বাবা-মা নয়, সমাজ, আশেপাশের লোকেরা, শিক্ষকরা, কোচ, পাশ থেকে হেটে যাওয়া লোকটা অবধি ছেলেগুলোকে এই মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এক গাল হেসে বলছে, ‘কী বাবা, জাতীয় দলে চান্স পাবা তো? তামিম হতে পারবা তো?’

অতোটুকু ছেলের কাঁধে চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে পাহাড়ের সমান প্রত্যাশার চাপ। আমরা বলি বটে, হাতের পাঁচটা আঙুল সমান হয় না। কিন্তু টেনে সবগুলোকে ওই এক সমান করার চেষ্টায় লেগে আছি আমরা। পড়ায় ফার্স্ট হতে হবে, খেলায় হতে হবে বোথামের আপন ভাই। না হলে আর রক্ষে নেই। ইজ্জত শেষ।

অতএব মরাই সেরা সমাধান।

এই মৃত্যুর দায় ক্রিকেট-ব্যবসায়ীদের, এই মৃত্যুর দায় জাতীয়তাবাদ-জীবিদের, এই মৃত্যুর দায় ঘৃণাপ্রজন্মের এবং এই মৃত্যুর দায় ছেলেটাকে নিয়ে প্রতিযোগিতায় নামা পরিবার ও সমাজের।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link