কেন কোহলি অধিনায়কত্ব ছাড়লেন!

কাজেই একেবারে নির্মোহ ভাবে, শুধু ক্রিকেট বিজ্ঞান ও যুক্তির নিরিখে দেখা হলে কোহলির টি-টোয়েন্টি অধিনায়কত্ব ছাড়া আমাকে খুব একটা আশ্চর্য্য করেনি। কোহলির মতো একজন খেলোয়াড়, যিনি টেস্ট ক্রিকেট এতো ভালোবাসেন, এবং আরো বেশ কিছু বছর খেলে যেতে চান, তাঁর জন্যে এই টি-টোয়েন্টি অধিনায়কত্ব বোধহয় ততটা জরুরি নয়, যতটা আপাতদৃষ্টিতে মনে হয়। টেস্ট ক্রিকেটে বিদেশ বা স্বদেশের মাঠে খান পাঁচেক সেঞ্চুরির জন্যে বোধহয় কিছু এন্ডোর্সমেন্ট ও ফ্লাড লাইটের আলো বোধহয় কোহলি ছাড়তেই পারেন।

শিরোনামটা দেখে কেউ যদি মনে করেন আমার কাছে ভেতরের খবর আছে, তাহলে ভুল করবেন। আসলে কাল এই খবর সরকারি ভাবে ঘোষিত হবার পর থেকে সমাজ মাধ্যমে আবেগের লাভাস্রোত বইতে দেখছি। কেউ এই সিদ্ধান্তের পিছনে বোর্ডের একটা গোষ্ঠির কালো হাত দেখছেন। কেউ আবার এই সিদ্ধান্তকে সেই কালো হাতের বিরুদ্ধে কোহলির অঘোষিত সফেন সাদা প্রতিবাদ হিসাবে দেখছেন।

কেউ কেউ আবার চরম উল্লসিত, যে ওই উদ্ধত লোকটার সঠিক শিক্ষা হয়েছে।কোহলির জন্যে নির্দ্বিধায় জীবন দিতে পারেন, এমন সমর্থককূল আবার এই সিদ্ধান্তের পর কয়েক গ্যালন অশ্রু বর্ষণ করে ফেলেছে। কিন্তু ক্রিকেট বিজ্ঞান এবং শুধুই ক্রিকেট বিজ্ঞানের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সেরকম কাউকে এখনো অব্দি বিশ্লেষণ করতে দেখিনি। কাজেই সেটাই একটু করার চেষ্টা করলাম।

২০১৯ এর পয়লা জানুয়ারী থেকে ২০২১ এর ১৫ সেপ্টেম্বর অবধি ভারত খেলেছে ২৩ টেস্ট ম্যাচ। তা সেইসকল টেস্ট ম্যাচ মিলিয়ে মোট ৯১ দিনের ক্রিকেট খেলা হয়েছে। পাঠক খেয়াল করুন, আমি কিন্তু কোনো একদিনের খেলায় এক ওভার হলেও সেটাকে নিয়েছি। আবার একটা ড্র হওয়া টেস্ট ম্যাচের একদিন বৃষ্টিতে ভেস্তে গেলে সেই টেস্টে ৪ দিন খেলা হয়েছে বলেই ধরে নিয়েছি। তা কোহলি এই ৯১ দিনের মধ্যে ৭৭ দিন খেলেছেন।

গোটা অস্ট্রেলিয়া দল মিলে এই সময়কালে মাত্র ৭০ দিন টেস্ট ক্রিকেট খেলেছে। রোহিত এই ২৩ টেস্টের মাত্র ১৬টি খেলেছেন এবং সর্বমোট ৬৫ দিনের খেলায় অংশগ্রহণ করেছেন। এই সময়কালে পূজারা ও রাহানে ছাড়া বেশি কোহলির চেয়ে বেশি দিন টেস্ট খেলেছেন একমাত্র ইংল্যান্ডের কিছু মুষ্টিমেয় খেলোয়াড়। ইংল্যান্ড এই সময়কালে ১৪০ দিনের টেস্ট ক্রিকেট খেলেছে। ম্যাচের হিসাবে ধরলে ৩৩।

রুট তাঁর মধ্যে ৩২ টি খেলেছেন এবং অংশগ্রহণ করেছেন ১৩৬ দিনের খেলায়। রুট ছাড়া এই সময়কালে কোহলির চেয়ে বেশিদিন টেস্ট ক্রিকেটে যাঁরা অংশগ্রহণ করেছেন, প্রত্যেকেই টেস্ট ম্যাচ বিশেষজ্ঞ। এবং রুটও শুধু ওয়ানডে খেলেন। টি-টোয়েন্টি নয়। তবে সেই আলোচনায় আসছি পরে।

এবার একটু সাদা বলের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে নজর দেয়া যাক। এই সময় ভারতের খেলা ৪৩ ওয়ানডের ৩৮টি খেলেছেন কোহলি এবং ৩৪ টি রোহিত। অর্থাৎ আরো প্রায় চল্লিশ দিন ধরে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের রগড়ানি। রুট এইসময় ইংল্যান্ডের খেলা ৪০ ওয়ানডের ৩১টি তে খেলেছেন। অবশ্য ইংল্যান্ডের খেলা ৩২ টি-টোয়েন্টি ম্যাচের মধ্যে রুট খেলেছেন মাত্র ৪টি। আর কোহলি ভারতের খেলা ৩৫ টি-টোয়েন্টির মধ্যে খেলেছেন ২৫টি।

রোহিত আরো কম – ২১টি। অর্থাৎ বিগত দু বছরে সবচেয়ে বেশি দিন আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলেছেন রুট-১৭১ দিন। তারপরেই কোহলি-১৪০ দিন। রোহিত এই দুইয়ের চেয়ে বেশ কিছুটা পিছিয়ে-১২০। এই লেখায় রোহিতের পরিসংখ্যান দেখানোর উদ্দেশ্য, এই সময়কালে ভারতে কোহলি ও বুমরা ছাড়া মোটামুটি রোহিতই একমাত্র খেলোয়াড় যিনি তিনটি ফরম্যাটের দলেই নিয়মিত ছিলেন।

এবং রুটকে নিয়ে আলোচনা করা কারণ তিনি এই সময়ে সবচেয়ে বেশি দিন আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলেছেন। এছাড়া বাকি খেলোয়াড়দের ধর্তব্যের মধ্যে আনাও বাহুল্যতা, কারণ ভারত-ইংল্যান্ড-অস্ট্রেলিয়ার মতো কোনো দল আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলেনা। কাজেই উইলিয়ামসন বা স্মিথ বা কামিন্স রা কোহলি বা রুটের তুলনায় অনেক কম ক্রিকেট খেলেছেন।

সংখ্যার বিচারে রুটের চেয়ে কম আন্তর্জাতিক খেললেও, বলবো কোহলিকে ধকল নিতে হয়েছে রুটের চেয়ে বহুগুন বেশি। প্রথমত, আন্তর্জাতিক ছাড়াও কোহলিকে প্রায় অমানুষিক আবহাওয়ায় গাদা গুচ্ছের আই.পি.এল ম্যাচ খেলতে হয়েছে। দ্বিতীয়ত, রুট কোহলির মতো ক্রিকেট পাগল দেশের অধিনায়ক নন। কোহলি যখনই মাঠে নামেন তখন তাঁর টুপি বা হেলমেটের ওপরে একটা অনন্ত প্রত্যাশার অদৃশ্য হেলমেট চাপানো থাকে।

রুটের ক্ষেত্রে এই চাপ তুলনায় কম। যদিও অধুনা ইংল্যান্ডের প্রায় লাইফ-সাপোর্টে চলে যাওয়া ব্যাটিংকে স্যালাইন ও অক্সিজেন একসাথে দিতে গিয়ে রুটের চাপ কিছুটা বাড়ছে। এবং তা বাড়ার সাথে সাথে তিনি ওয়ানডে খেলাও কমিয়ে দিচ্ছেন। খুব জরুরি সিরিজ না হলে আজকাল আর আকাশি জামা পরে বড়ো একটা নামেন না। এছাড়াও ইংল্যান্ডের আবহাওয়া, এক জায়গা থেকে আরেক জায়গা যাওয়ার কম সময় ব্যয় হওয়া (যেসব সুবিধা কোহলি কম পান) তো আছেই।

কাজেই একেবারে নির্মোহ ভাবে, শুধু ক্রিকেট বিজ্ঞান ও যুক্তির নিরিখে দেখা হলে কোহলির টি-টোয়েন্টি অধিনায়কত্ব ছাড়া আমাকে খুব একটা আশ্চর্য্য করেনি। কোহলির মতো একজন খেলোয়াড়, যিনি টেস্ট ক্রিকেট এতো ভালোবাসেন, এবং আরো বেশ কিছু বছর খেলে যেতে চান, তাঁর জন্যে এই টি-টোয়েন্টি অধিনায়কত্ব বোধহয় ততটা জরুরি নয়, যতটা আপাতদৃষ্টিতে মনে হয়। টেস্ট ক্রিকেটে বিদেশ বা স্বদেশের মাঠে খান পাঁচেক সেঞ্চুরির জন্যে বোধহয় কিছু এন্ডোর্সমেন্ট ও ফ্লাড লাইটের আলো বোধহয় কোহলি ছাড়তেই পারেন।

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...