মন্থর এবং টার্নিং উইকেট বানিয়ে ঘরের মাঠের সুবিধা পুরোপুরি কাজে লাগিয়ে আসন্ন টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের আগে দারুণ ছন্দে রয়েছে বাংলাদেশ। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে সিরিজ জয়ের পর নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষেও সিরিজ জয়ের পথে স্বাগতিকরা।
তবে দারুণ ছন্দে থাকলেও বিস্তর আলোচনা সমালোচনা হচ্ছে বিশ্বকাপের আগে এরকম উইকেটে খেলার যৌক্তিকতা নিয়ে। এই রকম উইকেটে খেলার পক্ষে যেমন অনেকেই সমর্থন দিয়েছেন তেমনি বিপক্ষেও মতামত কম নেই।
যারা বিপক্ষে আছেন তাদের যুক্তি হলো মন্থর ও টার্নিং উইকেটে খেলে বিশ্বকাপের জন্য আদর্শ প্রস্তুতি হবে না বাংলাদেশের। প্রস্তুতিতে ঘাটতি থেকে যাবে অনেকটাই। এই রকম উইকেটে ম্যাচ খেলে গিয়ে বিশ্বকাপের স্পোর্টসিং উইকেটে খেই হারিয়ে ফেলতে পারে বাংলাদেশ।
আর যারা পক্ষে আছেন তাদের যুক্তি হলো কেমন উইকেটে খেলা হচ্ছে এটা বড় বিষয় নয়, বিশ্বকাপের আগে ম্যাচ জিতে আত্মবিশ্বাস অর্জন করাটাই গুরুত্বপূর্ণ। দেশের মাটিতে টানা জয় পেয়ে আত্মবিশ্বাস নিয়ে বিশ্বকাপে গেলেই ভালো করবে বাংলাদেশ।
তবে ‘আত্মবিশ্বাস’ নিয়ে বিশ্বকাপের যাওয়ার পক্ষেই সবচেয়ে বড় জনমত গড়ে উঠেছে। বর্তমান দলের ক্রিকেটার, কোচিং স্টাফের সদস্য, নির্বাচকরা ও সাবেক ক্রিকেটারদের অধিকাংশই মনে করছেন আত্মবিশ্বাসটাই আসল। বিশ্বকাপের আগে জয়ের ধারায় থাকাটাই গুরুত্বপূর্ণ।
জিতলে আত্মবিশ্বাস বাড়বে, এটা নিয়ে আমারও কোন সন্দেহ নেই। জেতাটাও একটা অভ্যাস। নিয়মিত জেতাতে সাহস ও আস্থা বাড়ছে অবশ্যই। এটা বিশ্বকাপে ভালো করতে অনুপ্রেরণা দেবে এটার সাথে আমিও সম্পূর্ণ একমত।
এই আত্মবিশ্বাস অর্জন করতে ও নিয়মিত জেতার অভ্যাস করতে আমারা যে পরিকল্পনা হাতে নিয়েছি ও বাস্তবায়ন করছি আমার প্রশ্নটা এটা নিয়েই। এই রকম মন্থর ও টার্নিং উইকেটে খেলে বিশ্বকাপে ভুল আত্মবিশ্বাস নিয়ে যাচ্ছে না তো বাংলাদেশ?
এই দুই সিরিজে বাংলাদেশের জয় গুলোর পিছনে বড় অবদান কিন্তু বোলারদের। আর বোলারদের সফলতার পিছনে বড় নিয়ামক হিসাবে কাজ করেছে মিরপুরের মন্থর ও টার্নিং উইকেট। কন্ডিশনের সুবিধা কাজে লাগিয়ে বল হাতে যেখানে প্রতি ম্যাচেই আগুন ঝড়াচ্ছেন বোলাররা।
আমরাও বোলারদের দুর্দান্ত পারফরম্যান্সের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। তাদের নিয়েও আমাদের প্রত্যাশা বড় হচ্ছে। শুধু আমাদেরই নয়, বোলারদেরও ভালো করার আত্মবিশ্বাস তৈরি হচ্ছে প্রতিনিয়ত। এই যে তাদের প্রত্যাশা বড় হচ্ছে, এটার পিছনে সবচেয়ে বড় কারণ তাঁরা ভাবছেন আমাদের সব কিছুই তো ঠিকঠাক হচ্ছে।
তাঁরা ভাবছেন আমাদের কাটার, স্লোয়ার, ইয়র্কার, টার্ন পাওয়া সবই তো ঠিক আছে। আমার প্রশ্নটা এখানেই। এই যে সব কিছু ঠিকঠাক আছে এটার পরীক্ষা কী তাদের দিতে হয়েছে কোন ম্যাচে। নাকি ঐ সফলতা দেখেই তাঁরা ধরে নিচ্ছে কোন ঘাটতি নেই।
নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে দ্বিতীয় টি-টোয়েন্টি শেষে মোহাম্মদ সাইফউদ্দিন বলেছিলেন এখানকার অভিজ্ঞতা কাজে দেবে না। তবে আত্নবিশ্বাস কাজে দেবে। তাহলে কি শুধু আত্মবিশ্বাসটাই আসল। বিশ্বকাপের আগে খেলা সর্বশেষ দশটা ম্যাচের অভিজ্ঞতা কোন প্রভাবই ফেলবে না।
ঘরের মাঠের এই দুই সিরিজে ওভার প্রতি ছয় রানের উপরে গুনতে হচ্ছে না কোন বোলারকেই। কিন্তু বিশ্বকাপে ওভার প্রতি সাত আট রানের নিচে দেওয়ার চেষ্টা করতে হবে। আর শেষের দিকে দশ রানের নিচে দিলেও সেটাকে ভালো ওভার বলে ধরা হবে।
দেশের মাটিতে ছয় রানের নিচে দেওয়ার কাজটা খুব সহজেই করে যাচ্ছেন বোলাররা। কিন্তু বিশ্বকাপে আট দশ রানের নিচে ইকোনোমি রাখতে রীতিমতো সংগ্রাম করতে হবে বোলারদের। কারণ তাঁরা বিশ্বকাপে গিয়েছেন ভুল একটা ধারণা নিয়ে, ভুল একটা আত্মবিশ্বাস নিয়ে। এরকম পরিস্তিতিতে কোন পরীক্ষা না দিয়েই।
যার কারণেই বিশ্বকাপের ব্যাটিং সহায়ক উইকেটে আমাদের বোলারদের এই আত্মবিশ্বাস হিতে বিপরীত হতে পারে। কারণ দেশের মাটিতে মন্থর ও টার্নিং উইকেটে খেলার কারণে তাদের কিছু ডেলিভারিতে যে ঘাটতি ছিলো সেটা এখন ম্যাচে ধরা পড়ছে না তেমন। তাই সেসব নিয়ে কাজ করে প্রস্তুতিটাও হয়তো নেওয়া হবে না ঠিকঠাক ভাবে।
আমি বলছিনা কন্ডিশনের কারণে তাঁরা তাদের ঘাটতিটা বুঝতে পারবে না। আমি বলছিনা বিশ্বকাপের আগের এক মাস তাঁরা এটা নিয়ে কাজ করবে না। তাঁরা অবশ্যই ঘাটতি বুঝতে পারবে এবং কাজ করবে। কিন্তু ম্যাচে সব ঠিকঠাক হওয়ার পর সেটা নিয়ে কাজ করা, আর খারাপ হওয়ার পর সেটা নিয়ে কাজ করার ভিতর বড় একটা পার্থক্য তো অবশ্যই রয়েছে।
দুই পরিস্তিতিতে কাজ করার প্রসেসটাও হয়তো ভিন্ন। কাজ করার আগ্রহের ভিতরও হয়তো পার্থক্য রয়েছে। যদি এই সবে ঘাটতি থেকেই যায়, দেশের মাটিতে খুব সহজে সাফল্য পাওয়ার পর বিশ্বকাপে কঠিন পরিস্তিতিতে পরলে হঠাৎ করেই কি তখন মানিয়ে নিতে পারবেন বোলাররা?
তখন কী আত্মবিশ্বাসেই কাজ হবে? নাকি দেশের মাটিতে বোলারদের পরীক্ষার সামনে না ফেলে বিশ্বকাপে ভুল আত্মবিশ্বাস নিয়ে যাওয়ার খেসারত দিতে হবে বাংলাদেশকে। প্রশ্নটা থেকেই যায়।