‘আমিই কেবল নিজের জীবন পাল্টাতে পারি, অন্য কেউ নয়!’ – আমেরিকান অভিনেত্রী ক্যারোল বারনেটের এই একটি উক্তির মহিমা কতটা তাৎপর্যময় সেটি আমরা নিজেরাই অনুধাবন করতে পারি৷ কিন্তু – যাদের পারার কথা তারা পারে কি?
নিজ জীবন পরিবর্তন করতে তাড়না দরকার হয়। আর স্বেচ্ছা এই তাড়না সবথেকে জরুরী, ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। তা সেটি জীবনে হোক, রাষ্ট্রে হোক কিংবা হোক হালের ক্রিকেটে।
বাংলাদেশ ক্রিকেটে অন্ধকার সব ম্যাচ এসেছে এর আগে। হংকংয়ের সাথে টি-টোয়েন্টি হারতে হয়েছে, নবাগত আফগানিস্তানের সাথে টেস্ট হারতে হয়েছে। হারতেই পারে, অনিশ্চয়তার খেলাতে হারজিত থাকবেই। সেটি নিয়ে প্রশ্ন উঠবে না। প্রশ্ন উঠবে ধরণে, মানসিক এপ্রোচে, ভুল পরিকল্পনাতে।
এসবকেও যদি মূলতবি রাখি, তারপরেও বড় প্রশ্নটা ওঠে, যাদের নিয়ে আগামীর বাংলাদেশ ক্রিকেটের স্বপ্ন তারা তো আউটপুট টা দিচ্ছেন না! উল্টো আমরাই বারবার ঢাল হয়ে তাদের সমালোচনার আড়াল করছি। সময় দিতে বলছি। কিন্তু শতবর্ষী বৃক্ষও তো একদিন মুড়িয়ে যায়, এদের সময় আর হবেটা কবে? বেলায় বেলায় তো কম পেরোয়নি সময়!
সৌম্য সরকারের আগমন এ দেশের ক্রিকেটে ঝড়ের মত। বিশ্বকাপ ২০১৫-তে একজন পেস বোলিং অলরাউন্ডারের খোঁজে সৌম্যকে পরখ করা হয় জিম্বাবুয়ের সাথে হোম ম্যাচে। সেই ওয়ানডেতে মাত্র বিশোর্ধ্ব একটি ইনিংস খেলেই সাজঘরে ফেরা সৌম্যকে বিশ্বকাপে নিয়ে যাওয়া হয় বড় স্বপ্ন চোখে রেখেই।
বিশ্বকাপের পর পেস বোলিং অলরাউন্ডার সৌম্য সরকার বনে যান পুরোদস্তুর ওপেনিং ব্যাটসম্যান। ব্যাটিং করার ধরণ, জায়গায় দাঁড়িয়ে লং অন দিয়ে উড়িয়ে মারা ছয়, দুর্বল ফুটওয়ার্ক কে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে শক্ত প্রতিপক্ষকে দুমড়ে মুচড়ে দেওয়া সবই মনে করাচ্ছিল বীরেন্দর শেবাগকে৷ কিন্তু আমরা দেখলেও নিজেকে বোধহয় অতটা উচুতে দেখতে চাননি সৌম্য নিজেই। নইলে জেনেবুঝেই উদাসীন কেন হবেন তিনি?
ধারাগতভাবে সৌম্য সরকার পিঞ্চ হিটিং ওপেনার৷ ব্যাটিং এর সময় ক্রিকেটের ব্যাকরণ তিনি মানেন না৷ সেটি অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু মুশকিল হল, প্রযুক্তির এই যুগে পিঞ্চ হিটারদের দুর্বলতা খুঁজে বের করা সবচেয়ে সোজা। পিঞ্চ হিটারদের তাই নিয়মিতই কৌশলে বদল আনতে হয়৷ নেটে প্রচুর প্রাকটিস করতে হয়। ব্যাকরণ মানেন না বলে অন্য সবার চেয়ে নিজেকে নিয়ে পিঞ্চ হিটারদের ভাবতে হয় বেশি! কিন্তু সৌম্য কি আর অতটা সময় দেবেন?
লিটন কুমার দাস এসেছিলেন অমিত সম্ভাবনার দুয়ার খুলে৷ মাশরাফি বিন মর্তুজা, সাকিব আল হাসান সবাই বলেছিলেন লিটন দাস এদেশের অন্যতম ক্লাসিক ব্যাটসম্যান। নিখুত টেকনিকের সাথে লিটনের মেধা আর প্রজ্ঞাও নাকি সীমাহীন৷ তার ছিটেফোটা মাঝেমধ্যে দেখা গেলেও বেশিরভাগই রয়ে গেছে পর্দার আড়ালে।
ঘরোয়া ক্রিকেটে নিয়মিত সেঞ্চুরি করা লিটন আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে এক অঙ্ক পেরোতেই হাপিয়ে ওঠেন, সাঝঘরে ফেরেন। একটা ম্যাচে অতিমানবীয় পারফর্ম্যান্স করে পরের ম্যাচে আর পেরে ওঠেন না। ঘরোয়াতে হিসাবটা বদলালেও বড় দলগুলির সাথে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে চিত্র বদলায়নি। সমস্যা টা কোথায়? আত্মবিশ্বাসে। শট সিলেকশনে।
লিটন দাস কোন একটি ওভার বাউন্ডারি মারার জন্যে যে গতিতে ব্যাট চালান সেটিই প্রমাণ করে তিনি শটটি খেলতে কতটা দ্বিধান্বিত। ইএসপিএন ক্রিকইনফোর একটি সাক্ষাৎকারে তামিম ইকবাল কে একবার জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, ‘ছয় মারার প্রধান শর্ত কি?’ তামিম বলেছিলেন, ‘এটা নিশ্চিত থাকা যে আমি ছয়ই মারব।’
মূলত, লিটন দাস কখনই নিশ্চিত নন। কখনও ডাউন দ্যা উইকেটে এসে অনসাইডে ব্যাট চালিয়ে টোকা দেন, কখনও স্ট্রেইট ড্রাইভ খেলতে গিয়ে হঠাৎ লফটেড করে ফেলেন, আবার কখনও হুক আর পুলের মাঝে অজানা কোন শটে উইকেট বিলিয়ে আসেন৷ একটা ম্যাচে শিল্পীর তুলির আঁচড় কেটে পরের ম্যাচে সেই ক্যানভাসটাই ভাসিয়ে দেওয়া থেকে লিটনকে বেরিয়ে আসতে হবে। লিটন দাসের সামর্থ্য আছে, সেই সামর্থ্য শুধু এদেশের ক্রিকেটে সেরা হবার নয়, বরং আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে রাজ করবার!
আজকে যখন বিরাট কোহলি, কেন উইলিয়ামসনদের নাম উচ্চারিত হয়, লিটন দাস কি আক্ষেপ অনুভব করেন? তিনি তো চাইলেই যেতে পারেন তাঁদের কাতারে! তবে আশার কথা, লিটন তাঁর ভুলগুলো বুঝতে পারছেন, শোধরাতে চাইছেন!
এগারোজন মিলেও এখন প্বার্শবর্তী দেশ ভারতকে হারানো যায়না৷ কিন্তু সেটি একাই করে দেখিয়েছিলেন মুস্তাফিজুর রহমান। মায়াবী কাটার স্লোয়ারে বিভ্রান্ত হয়ে বিশ্বের সেরা ব্যাটসম্যানরাও মুস্তাফিজের বলে অফ সাইডে ক্যাচ তুলে দিতেন৷ সেই ফিজ আজ নিতান্তই সাধারণ বোলার।
দুই এক ম্যাচে দারুণ কিছু করে স্ট্যাটিসটিক্সকে বশে রাখলেও দ্যা ফিজের বল কি অনায়াসেই না সবাই খেলেছে আমরা দেখেছি বিশ্বকাপেই। মূলত, বড় কিছু হতে চাইলে স্বপ্ন থাকাটা জরুরী। মুস্তাফিজের মনে তা এসেছে কিনা জানিনা, কিন্তু নিজের উন্নতির ছিটেফোটাও যে তিনি করেননি তা স্পষ্টই। শুধুমাত্রই কাটার আর স্লোয়ার নিয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে টিকে থাকাটাই দুঃসাহস, রাজ করা তো অন্যায়।
চামিন্দা ভাসকে বল স্কিড করে ভেতরে ঢোকানোর ফর্মুলা টিম থেকে শেখানো হয়েছিল না, তিনি শিখেছিলেন নিজে নিজে, বড় কিছুর তাড়নাতে। বড় কিছু তাড়নাতে আউট অফ দ্যা বক্স ট্রাই করতে গিয়েই রিভার্স সুইং আবিষ্কার হয়ে গেল। আমরা ফিজকে কিছু আবিষ্কার করতে বলছিনা।
আমরা বলছি ন্যূনতম তাড়নাতে তিনি তার তূণে নতুন অস্ত্র যোগ করুন৷ যোগ করলে কি হতে পারে তা দেখতে চাইলে বুমরার দিকে তাকাতে হবে। সেই নতুন কিছুর চেষ্টায় বারবার নেটে স্পট বল ফিজকেই করতে হবে, সেটি ল্যাংগাভেল্ট, ওয়ালশ কিংবা স্ট্রিক কেউই করে দেবে না৷ নইলে একজন অজন্তা মেন্ডিস হতে সময় লাগবেনা খুব বেশি।
অন্ধকার কুটিরে আলোর মশালের মত টি-টোয়েন্টির বাংলাদেশ দলে আবির্ভাব সাব্বির রহমান রুম্মনের। এতদিনে এমন একজনকে পাওয়া গেল, যে কিনা ক্লিন হিট করতে পারেন, যে মারলে তা গ্যালারিছাড়া হবেই। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ ২০১৪ তে নিজের প্রতিভার প্রতি সুবিচার না করতে পারলেও এশিয়া কাপ টি-টোয়েন্টি ২০১৬ তে সিরিজসেরা হয়ে নিজের আগমনীবার্তা ঠিক জানিয়েছিলেন তিনি।
কিন্তু বড় কিছু পেতে গেলে ছোট ছোট বাসনাকে তুচ্ছজ্ঞান করতে হয়, আত্মতুষ্টিতে ভোগাকে বিসর্জন দিতে হয়। কিন্তু কেই বা ভেবেছিল, সাব্বির রহমান টি-টোয়েন্টি’র ফেইম না, চাইবেন শুধুই দেশীয় ফেম যাকে পুঁজি করে ঘটাতে পারবেন অনর্থ। নানা কুকীর্তি, নিষেধাজ্ঞার পর ব্যাক্তিজীবনকে স্রোতে ভেড়ালেও ব্যাট তার কথা বলে কালেভদ্রেই। নিয়মিত হওয়ার তাড়না জাগাতে হলে, আর নিতান্তই যদি তা জাগে এরপর নেট সেশনের কষ্টটুকু করতে রুম্মন প্রস্তুত কিনা কে জানে!
মেহেদি হাসান মিরাজের আবার এসব সমস্যা নেই। নিপাট ভদ্র মিরাজ কাজ করেন একদম দলের চাহিদামাহিক। কিন্তু অতিরিক্ত সতীপনাতে যে দাহ হতে হয় তা বুঝি মিরাজ জানেন না। বয়সভিত্তিক দলের ব্যাটিং অলরাউন্ডার মিরাজ জাতীয় দলে পুরোদস্তুর স্পিনার, দলের চাহিদা মেনেই৷ ইতোমধ্যেই বাদ পড়েছেন জাতীয় দলের টি-টোয়েন্টি স্কোয়াড থেকে, নিজের তাড়নাতে অলরাউন্ডার সত্তাকে মনে না করলে আস্তে আস্তে বাদ পড়বেন সব ফরম্যাট থেকেই। আমরাও হারাব আইসিসি ইভেন্টের সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার জয়ী মেহেদি মিরাজকে।
একটা সভ্যতা বেঁচে থাকে কিসে? তরুণদের ভীড়ে! বলা হয়, এই তরুণরাই আসলে নগরের আসল সভ্যতা। যদি আমি বাংলাদেশ ক্রিকেটকে নগর ধরি, তাহলে সৌম্য, লিটন, মুস্তাফিজ, সাব্বির দের ধরতে হবে সভ্যতা। আর এই সভ্যতা যদি নিজেদের মানসিকতাই সেরাদের কাতারে না নিতে পারেন, নগর উন্নত হবে কিভাবে?