বয়কটের অবজ্ঞা, হটনের প্রতিশোধ

ব্যাট হাতে অমন বাজে পারফরম্যান্সের পর জিম্বাবুয়ের ক্রিকেটাররা বোধহয় আরও একটা লজ্জাজনক পরাজয় বরণের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। কিন্তু মধ্যাহ্ন বিরতিতে বয়কটের কাছ থেকে অবজ্ঞাসূচক ‘উপদেশবাণী’ পেয়ে রীতিমতো জেদ চেপে গিয়েছিল ডেভ হটনের। জয়ের জন্য মাঠে নামবেন, অতদূর হয়তো কল্পনা করতে পারেননি। কিন্তু কিছু যে একটা করে দেখাতে হবে, সে ব্যাপারে ছিলেন দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। মধ্যাহ্ন বিরতি শেষে মাঠে নামার আগে তাই সতীর্থদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, ‘ফলাফল নিয়ে ভেবো না। আজ আমাদের হারানোর কিছুই নেই। নিজেদের শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে লড়াই করব আমরা।’

‘অ্যামেচার দলগুলোর একটা পুরনো সমস্যা। তারা জানে না কিভাবে স্ট্রাইক রোটেট করতে হয়।লাঞ্চ থেকে বের হয়ে দেখো, পেশাদাররা কিভাবে খেলে। তাঁরা শুধু ফাঁকে ফাঁকে বলগুলো ঠেলে দিয়ে এক দুই রান বের করবে আর সহজেই ম্যাচটা জিতে যাবে।’ – জিম্বাবুয়ের অধিনায়ক ডেভ হটনের উদ্দেশ্যে ভীষণ অবজ্ঞার সুরে কথাগুলো বলছিলেন সাবেক ইংলিশ ক্রিকেটার জিওফ্রে বয়কট।

১৯৯২ বিশ্বকাপের ইংল্যান্ড-জিম্বাবুয়ে ম্যাচের মধ্যাহ্ন বিরতির ঘটনা। সেমিফাইনালের আগে গ্রুপ পর্বে নিজেদের শেষ ম্যাচে জিম্বাবুয়ে অলআউট হয়েছিল মাত্র ১৩৪ রানে। তারই প্রেক্ষিতে কথাগুলো বলেছিলেন বয়কট। কিন্তু তিনি কি ঘুণাক্ষরেও ভাবতে পেরেছিলেন যে শেষ পর্যন্ত কী নিদারুণভাবেই না লুটিয়ে পড়তে যাচ্ছে এই আভিজাত্য, এই দম্ভ!

১৯৯২ বিশ্বকাপের অন্যতম ‘হট ফেবারিট’ ছিল ইংল্যান্ড। সবশেষ ছয় ম্যাচের পাঁচটিতেই তারা জিতেছিল দাপট দেখিয়ে। অন্যদিকে, তখনো ‘টেস্ট স্ট্যাটাস’ না পাওয়া জিম্বাবুয়ে প্রায় সবকটিতেই হেরেছিল শোচনীয়ভাবে। ইংল্যান্ডের মত শক্তিশালী দলের বিপক্ষে তাই অন্যরকম কিছু ঘটবে এরকমটা ভাবার মতো কোনো পরিস্থিতিই তখন ছিল না। কিন্তু এই তথাকথিত ‘চুনোপুঁটি’ জিম্বাবুয়েই সেদিন প্রমাণ করেছিল, ক্রিকেট গৌরবময় অনিশ্চয়তার খেলা। এখানে অনেক কিছু অনুমান করা গেলেও শেষ পর্যন্ত ফলাফল কী দাঁড়াবে সেটা কিছুতেই আগেভাগে বলা সম্ভব না।

১৯৯২ সালের ১৮ মার্চ। ল্যাভিংটন স্পোর্টস ওভালে টসে জিতে প্রথমে ফিল্ডিং করার সিদ্ধান্ত নেন ইংলিশ অধিনায়ক গ্রাহাম গুচ। ব্যাট করতে নেমে ইয়ান বোথাম, রিচার্ড ইলিংওয়ার্থদের দুর্দান্ত বোলিংয়ের সামনে শুরুতেই দুই ওপেনারকে হারিয়ে চাপের মুখে পড়ে যায় জিম্বাবুইয়ানরা। নিয়মিত বিরতিতে উইকেট হারাতে হারাতে একটা সময় তাদের সংগ্রহ দাঁড়ায় ৬ উইকেটে ৭৭ রান। ব্যাটসম্যানদের আসা যাওয়ার মিছিলে একমাত্র ব্যতিক্রম ছিলেন অধিনায়ক ডেভ হটন। দীর্ঘক্ষণ সংগ্রামের পর ব্যক্তিগত ২৯ রানের মাথায় অবশেষে হার মানেন তিনি।

দলীয় সর্বোচ্চ ২৯ রানের এই ‘ছোট্ট’ ইনিংসটা তিনি খেলেছিলেন ৭২ বলে। মাত্র ৯৬ রানে ৭ উইকেট হারানোর পর ‘দুই পেসার’ বুচার্ট (২৪) আর ব্রান্ডেজ (১৪) মিলে অষ্টম উইকেট জুটিতে যোগ করেন মূল্যবান ৩১ রান। ৪৬.১ ওভারে গুটিয়ে যাওয়ার আগে জিম্বাবুয়ে পেয়ে যায় ১৩৪ রানের লড়াকু পুঁজি! ইংলিশদের পক্ষে ইয়ান বোথাম ও রিচার্ড ইলিংওয়ার্থ নেন ৩টি করে উইকেট।

ব্যাট হাতে অমন বাজে পারফরম্যান্সের পর জিম্বাবুয়ের ক্রিকেটাররা বোধহয় আরও একটা লজ্জজনক পরাজয় বরণের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। কিন্তু মধ্যাহ্ন বিরতিতে বয়কটের কাছ থেকে অবজ্ঞাসূচক ‘উপদেশবাণী’ পেয়ে রীতিমতো জেদ চেপে গিয়েছিল ডেভ হটনের। জয়ের জন্য মাঠে নামবেন, অতদূর হয়তো কল্পনা করতে পারেননি। কিন্তু কিছু যে একটা করে দেখাতে হবে, সে ব্যাপারে ছিলেন দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। মধ্যাহ্ন বিরতি শেষে মাঠে নামার আগে তাই সতীর্থদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, ‘ফলাফল নিয়ে ভেবো না। আজ আমাদের হারানোর কিছুই নেই। নিজেদের শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে লড়াই করব আমরা।’

ডেভ হটনের কথাগুলো বোধহয় সত্যি সত্যিই অনুপ্রাণিত করেছিল জিম্বাবুয়ের বোলার-ফিল্ডারদের। বিশেষ করে এডো ব্রান্ডেজকে; যিনি পেশায় ছিলেন একজন ‘মুরগির খামারি’। ক্রিকেটটা খেলতেন নিছকই শখের বশে। ইংলিশরা যদি ভেবে থাকে যে এই ম্যাচ তারা আগেই জিতে বসে আছে, তাদের সেই ধারণাকে ‘ভুল’ প্রমাণ করতেই যেন মাঠে নেমেছিলেন জিম্বাবুয়ের সাবেক এই উদ্বোধনী বোলার। ইনিংসের প্রথম বলেই তিনি ফিরিয়ে দেন অধিনায়ক গ্রাহাম গুচকে (০)। তারপর একে একে ব্রান্ডেজের শিকারে পরিণত হন অ্যালান ল্যাম্ব (১৭), রবিন স্মিথ (২) ও গ্রায়েম হিক (০)। ডানহাতি এই পেসারের মাপা লেন্থ ও নিয়ন্ত্রিত সুইং বোলিংয়ের সামনে ইংলিশ ব্যাটিং লাইন আপ হয়ে পড়েছিলেন নিতান্তই অসহায়।

এরই মাঝে ১৮ রানের ইনিংস খেলে কিছুটা প্রতিরোধের চেষ্টা করেছিলেন অভিজ্ঞ অলরাউন্ডার ইয়ান বোথাম। কিন্তু তাঁকে ফিরিয়ে দেন আরেক ডানহাতি পেসার ওমর শাহ। টানা ১০ ওভারের স্পেলে মাত্র ২১ রানের বিনিময়ে ব্রান্ডেজ নিয়েছিলেন ৪ উইকেট।

মাত্র ৪৩ রান তুলতেই নেই ৫ উইকেট! জিম্বাবুইয়ানদের চোখে মুখে তখন দৈত্যবধের স্বপ্ন! কিন্তু ষষ্ঠ উইকেট জুটিতে ৫২ রানের ‘বড়’ পার্টনারশিপ গড়ে সেই স্বপ্ন পূরণের পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়ান অ্যালেক স্টুয়ার্ট ও নেইল ফেয়ারব্রাদার। তবে নিখুঁত লাইন লেন্থে বোলিং করে যাওয়া জিম্বাবুইয়ান বোলারদের সামনে রান তুলতে যথেষ্ট বেগ পেতে হচ্ছিল তাদের।

৯৫ রানের মাথায় স্টুয়ার্টকে (২৯) সাজঘরে পাঠিয়ে জিম্বাবুইয়ানদের আবারও ম্যাচে ফেরান ওমর শাহ। এর অল্প কিছুক্ষণ পরেই ফিল ডিফ্রেটাস (৪) আর ফেয়ারব্রাদারের (২০) উইকেট তুলে নিয়ে স্বপ্ন পূরণের পথে দলকে আরও একধাপ এগিয়ে নেন ডানহাতি পেসার ইয়ান বুচার্ট। ভাগ্যও সেদিন হাত বাড়িয়েছিল জিম্বাবুয়ের দিকেই। কারণ গ্লাডস্টোন স্মলকে নিয়ে ১৬ রানের জুটি গড়ে আবারও যখন ম্যাচটা নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে যাচ্ছিলেন ইলিংওয়ার্থ (১১), ঠিক তখনই দুর্ভাগ্যজনক এক রান আউটের শিকার হন তিনি।

৪৯ ওভার শেষে ইংলিশদের স্কোর ৯ উইকেটে ১২৫। জিততে হলে শেষ ওভারে দরকার ১০ রান। বল হাতে দৌড় শুরু করার আগে কাইল জার্ভিসের বাবা সাবেক ফাস্ট বোলার ম্যালকম জার্ভিসকে শুধু একটা কথাই বলেছিলেন অধিনায়ক হটন, ‘ভয় পেয়ো না। আমার বিশ্বাস তুমি পারবে।’ জারভিস অধিনায়কের কথা রেখেছিলেন। প্রথম বলেই বাজিমাত। ইংল্যান্ডের দশ নম্বর ব্যাটসম্যান গ্লাডস্টোন স্মল (৫) ধরা পড়লেন অ্যান্ডি পাইক্রফটের বিশ্বস্ত হাতে। জিম্বাবুয়ে পেল ৯ রানের অবিশ্বাস্য এক জয়! ক্রিকেট বিশ্ব দেখল বিশ্বকাপ ইতিহাসের সবচেয়ে বড় অঘটনগুলোর একটি। আর শেষ পর্যন্ত এই ঐতিহাসিক জয়টাই খুলে দিয়েছিল তাদের টেস্ট স্ট্যাটাস অর্জনের দুয়ার।

একটা কথা জানতে ইচ্ছে করছে নিশ্চয়ই। ম্যাচ শেষে ডেভ হটন কি তাদের ‘মহান পথপ্রদর্শক’ জিওফ্রে বয়কটের সঙ্গে আর দেখা করেননি? আসলে হটন সাহেব সেই সুযোগটাই পাননি। কারণ খেলা শেষ হতেই চোরের মতো নিঃশব্দে স্টেডিয়াম ছেড়ে বেরিয়ে যান বয়কট!

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...