গত বিশ্বকাপের সময়ের কথা।
একটা স্পন্সর প্রতিষ্ঠানের হয়ে বিশ্বকাপে খেলা দেখতে এসেছেন। তাকে পেয়েই হুমড়ি খেয়ে পড়লেন সাংবাদিকরা। ফিফার ওয়েবসাইটে সাক্ষাতকার প্রকাশ হলো। সেখানে জিজ্ঞেস করা হলো,‘স্পন্সরদের এই প্রস্তাবে রাজি হলেন কেনো?’
তিনি হো হো করে হাসলেন,‘আমার রাজি না হয়ে উপায় আছে। জ্লাতানকে ছাড়া কী পৃথিবীর বুকে বিশ্বকাপ হয়! বিশ্বকাপকে সফল করতে জার্মানি এসেছি।’
এই হলেন জ্লাতান ইব্রাহিমোভিচ।
কারো কাছে তিনি সুপারম্যান, কারো কাছে তিনি চাক নরিস, কারো কাছে তিনি রজনীকান্ত। আর ফুটবলের হিসেবে এক আন্ডাররেটেড জীবন্ত কিংবদন্তী।
আবার আলোচনায় এসেছেন ইব্রা।
রেকর্ড ইব্রার অনেক আছে। কিন্তু এখন যা করছেন, তাতে সুপারম্যান বলেই মানতে হচ্ছে।
বয়স হয়ে গেছে ৩৯। এই বয়সে লোকেরা অবসর নিয়ে বাচ্চাদের সাথে সময় কাটায়। আর এই বয়সে ইব্রা একটার পর একটা নজর কাড়া গোল করছেন; অ্যাসিস্ট করছেন। এই উদিনেসের বিপক্ষে ম্যাচটার কথাই ধরুন। ম্যাচের শুরুতেই অসাধারণ এক এসিস্ট করলেন। আর শেষ দিকে এসে দলকে জয় এনে দিলেন এক বাইসাইকেল কিকের গোল করে। বুড়ো হাড়েও এ কী ভেল্কি!
এহ। এটা জ্লাতানকে বলতে যাবেন না। তিনি চটে উঠে বলবেন, ‘বুড়ো! বয়স! সেটা আবার কী? সুপারম্যানের কী বয়স বাড়ে?’
ইব্রার এই সুপারম্যান হয়ে ওঠার শুরু সুইডেনের মালামো শহর থেকে। ১৯৮১ সালের ৩ অক্টোবর এখানে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা সেফিক ইব্রাহিমোভিচ একজন ইসলাম ধর্মালম্বী বসনিয়ান। আর মা জুরকা গ্রাভিচ আলবেনিয়ান বংশোদ্ভুত ক্যাথোলিক ক্রিশ্চিয়ান।
শুরুতে মালমোর আশেপাশে বিভিন্ন ক্লাবে খেলতেন। পেশাদার ফুটবলার হওয়ার স্বপ্ন ছেড়েই দিয়েছিলেন। ১৫ বছর বয়সে ফুটবল ছেড়ে ডকে কাজ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। কিন্তু বুঝিয়ে শুনিয়ে আবার ফুটবলে নিয়ে আসা হয়। সুপারম্যানকে ছাড়া ফুটবল চলে নাকি!
মালমো থেকে আয়াক্সে আসার ভেতর দিয়ে বড় ফুটবল ক্লাবে যাত্রা শুরু। এরপর জুভেন্টাস, ইন্টার মিলানে বর্ণময় সময় কাটিয়ে আসেন বার্সেলোনায়। জ্লাতান এখানে মাঠের বাইরে, মাঠে একেবারে বিধ্বংসী কথাবার্তায় মেতে ওঠেন। অনুশীলনে ভয়ানক দামী গাড়ি এনে আলোচনার ঝড় তোলেন। পরে নিজেই আত্মজীবনীতে এই সমযটা নিয়ে বিস্ফোরক সব কথাবার্তা লিখেছেন। বিশেষ করে তখনকার বার্সেলোনার নিয়ন্তা পেপ গার্দিওলা ও মেসির সাথে তার বিবাদ খুব জমে ওঠে।
বার্সা থেকে প্রথমে ধারে ও পরে দলবদলে ইন্টার মিলানে যান। এরপর পিএসজিতে কয়েকটা মৌসুম কাটিয়ে আসেন ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে। ২০১৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রে চলে যান। লস অ্যাঞ্জেলস গ্যালাক্সিতে ইব্রা যোগ দেওয়ার পর লোকেরা তার এপিটাফ লিখে ফেলেছিলো।
এপিটাফ লেখারই কথা। ইউরোপিয়ান ফুটবলের অলিখিত নিয়মই এটা। ইউরোপে আয়ু ফুরালে লোকে আমেরিকায় যায়। তাই সবাই ধরে নিয়েছিলেন ৩৭ বছর বয়সী ইব্রাহির সর্বোচ্চ লিগে দিন শেষ। কিন্তু লোকটা ইব্রাহিমোভিচ। তাই সব সমীকরণ পাল্টে দিয়েছেন। পাল্টে দিয়ে ফিরে এসেছেন মিলানে। এবং আবার ইতিহাস রচনা করছেন।
জাতীয় দলেও ইতিহাসটা করে রেখেছেন আগেই। সুইডেন, বসনিয়া-হার্জেগোভিনা ও ক্রোয়েশিয়া; তিন দেশের হয়ে খেলার জন্যই যোগ্য ছিলেন তিনি। তিন দেশই তাকে চাচ্ছিলো। জন্মস্থান সুইডেনকে বেছে নিয়েছেন তিনি। ইব্রা নিজেই নিজের দল ঠিক করে নেন আর কী!
২০০২ সাল থেকে ২০১৬ পর্যন্ত আর্ন্তজাতিক ফুটবল খেলেছেন। এর মধ্যে সুইডেনের সর্বোচ্চ গোলদাতা হয়েছেন। নানারকম রেকর্ড নিজের করে নিয়েছেন।
তাহলে জ্লাতান ইব্রাহিমোভিচকে চিনতে পারলেন?
মোটেও না। এসব রেকর্ড, পরিসংখ্যান, ইতিহাসে ইব্রাকে ধরতে পারবেন না। এমনকি রোজ রাত জেগে তার খেলা দেখেও বুঝে উঠতে পারবেন না যে, এই মানুষটা আসলে কে। এটা বুঝতে হলে তাকে নিত্যদিন অনুসরণ করতে হবে এবং তার মুখ থেকে বেরোনো সব কথা শুনতে হবে।
এই ধরুন একবার বললেন, ‘ক্রুইফ ফুটবল নিয়ে জীবনে যা করেছে, তা আমি কমলা লেবু দিয়েও করতে পারি!’
বোঝেন অবস্থা!
নিজের সম্পর্কে প্রায়ই বলেন-আমি একটা ফেরারী গাড়ি; আমাকে তো ডিজেল দিয়ে চালালে চলবে না।
পিসএসজিতে থাকবেন কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে বলেছিলেন, ‘দল মালিকরা কী আইফেল টাওয়ার সরিয়ে আমার একটা মূর্তি বানাতে পারবে? পারলে থাকতে পারি।’
নিজের খেলার দক্ষতা বলতে গিয়ে বলেছেন, ‘আমি ১১টা পজিশনে খেলে বিশ্বসেরা হতে পারি। কিন্তু আফসোস, আমি একা মানুষ।’
ইন্টারনেট ঘুটলে এমন শত শত কথা পাবেন জ্লাতানের। যে কথা দিয়েই আসলে বুঝতে পারবেন কে এই মানুষটা। স্রেফ ফুটবল, সময় নয়; তিনি এক জীবন্ত ইতিহাস। দিন যাচ্ছে আর সেই ইতিহাস সমৃদ্ধ হচ্ছে। কারণ জ্লাতান নিজেই বলেছেন, ‘আমি হলাম পুরোনো ওয়াইনের মতো। দিন যায়; আর আমার স্বাদ বাড়ে।’
ঠিক। জ্লাতান নামের সুপারম্যানের স্বাদ এখন আরও বেশি!
এক সময় ইন্টারের হয়ে খেলেছেন, মাতিয়েছেন। এসি মিলানের হয়ে খেলছেন, মাতাচ্ছেন। পিএসজির হয়ে মাতিয়েছেন। ইন্টারের সেই দিন নেই, পিএসজিও হয়তো হারিয়ে যাবে। কিন্তু রয়ে যাবেন এক ও অদ্বিতীয় জ্লাতান ইব্রাহিমোভিচ; দ্য সুপার ম্যান।