স্মৃতি যে সততই সুখের!

দরজায় কড়া নাড়ছে আবারও একটা বোর্ডার-গাভাস্কার ট্রফি, গুটি গুটি পায়ে অবশেষে চলেই এল সে। আবারও সেই ভোর পাঁচটায় অ্যালার্ম দিয়ে রাখার দিন, আর ঐ অ্যালার্ম এর ঘন্টি শুনে ঘুম জড়ানো চোখে কম্বল-মশারি সরিয়ে টিভির পর্দায় চোখ রাখার পালা, ততক্ষণে দেখা টসের পালা সাঙ্গ আর তার সাথে হয়ত অস্ট্রেলিয়ার দুই ওপেনার ব্যাট বগলে নামছেন আর নতুন চকচকে লাল বলটা হাতে সেটাকে কথা বলানোর জন্য তৈরী হচ্ছেন কোনো এক জাসপ্রিত বুমরাহ বা মোহাম্মদ শামি। ক্রিকেট রোম্যান্টিকতার সেই দিন এল বলে।

প্রায় বছর কুড়ি ধরে নিয়মিত ক্রিকেট দেখার মধ্যে মোটামুটি চার বছর অন্তরই শীতের ভোরে এই কাজ একেবারে বাঁধা ধরা। তার মধ্যে এর আগে গোটা ছয়েক অস্ট্রেলিয়া সফরের টেস্ট সিরিজ দেখার সৌভাগ্য হয়েছে। জয়ে রোমাঞ্চিত হওয়া, হারে ব্যথিত হওয়া কিংবা ড্রএ আফসোস হওয়ার মত অনেক ঘটনা ঘটেছে, কিন্তু কোথাও গিয়ে যেন ২০০৩-০৪ সালের অস্ট্রেলিয়া সফরের ঐ চারটে টেস্ট বারবার মনে ভাসে। মনে হয় এই তো সেদিন হল।

এই তো সেদিন গ্যাবায় সৌরভ ছড়ানো ১৪৪ এল, কিংবা অ্যাডিলেডে রাম লক্ষ্মণ জুটির (পড়ুন দ্রাবিড় – লক্ষ্মণ) অমর জুটি হয়ে গেল, তারপর আবার আগারকারের দুর্দান্ত বোলিং। আগারকার যে টেস্টে অমন বোলিং করতে পারেন ঐ অ্যাডিলেড টেস্টের আগে বিশ্বাসই করতে পারতাম না। তারপর মেলবোর্নে বক্সিং ডে টেস্টে বীরুর ১৯৫ তে আউট হওয়ার পরে পন্টিং হেইডেনের ঐ মারাত্মক ইনিংস সেই যে মনে কষ্ট দিয়েছিল, সেটাও যেন এখনো জ্বালা ধরায়। আর নতুন বছরে স্টিভের বিদায়ী টেস্টে শচীনের অমর ইনিংস বা স্টিভের শেষ ইনিংসটায় চোয়াল চাপা ৮০, এটাও তো বোধহয় সেদিনই হল।

সেবারে অস্ট্রেলিয়া যাওয়ার আগে ইডেনে ত্রিদেশীয় সিরিজের ফাইনালে হারের করুণ কাহিনীর পরে ডনের দেশে গিয়ে প্রস্তুতি ম্যাচগুলোতেও যখন বেশ খারাপ খেলল ভারত তখন মনে হচ্ছিল এবারেও সেই একই গল্প হতে যাচ্ছে। যদ্দুর মনে পড়ে একটা প্রস্তুতি ম্যাচে ব্র্যাড হজ বোধহয় ২৬৪ করেছিলেন, তারপর ম্যাথু নিকোলসন বেশ জ্বালিয়েছিলেন ভারতের ব্যাটিং লাইন আপকে।

সে যাই হোক উলুন গাব্বায় যখন প্রথম টেস্টে টসে জিতে ফিল্ডিং নিলেন সৌরভ আর জাস্টিন ল্যাঙ্গার একটা দুর্ধর্ষ সেঞ্চুরি করে দিলেন তখন মনে হচ্ছিল ডাঁটা দিয়ে কি আর বিরিয়ানি রান্না হয়! কিন্তু পরের দিন জাহিরের বাঁ-হাত সে হিসেব উল্টে দিল, পরপর পাঁচটা উইকেট যখন ঐ ঘুম জড়ানো চোখে অস্ট্রেলিয়ার পড়তে দেখা গেল, তখন চোখ কঁচলে দেখতে হচ্ছিল।

ভারতের ব্যাটিংয়ের আবার একটা খারাপ শুরুর পরে সৌরভ আর লক্ষ্মণ পাল্টা আঘাত হেনে দুজনে যে ইনিংস খেললেন তা জীবনেও ভোলা যাবে বলে মনে হয় না। অস্ট্রেলিয়ানরা তাঁদের দেশে টেস্ট সিরিজে বরাবরই তাক করে বিপক্ষ অধিনায়ককে আর সেখানেই সৌরভের কাউন্টার এটাকিং ১৪৪ যেন সিরিজের টোনটাই সেট করে দিয়েছিল সেবার। বৃষ্টিতে টেস্টটা শেষ পর্যন্ত ড্র হলেও মনোবলের দিক থেকে অ্যাডিলেডে এগিয়ে থেকেই নামলো ভারত।

অ্যাডিলেডে দ্বিতীয় টেস্টে প্রথম দিন পন্টিংয়ের দুর্ধর্ষ সেঞ্চুরিতেই ৪০০ তুলে ফেললো যখন অসিরা তখন মন খারাপের গল্পরা যেন ফিরে আসবে আসবে করছিল। কুম্বলের বোলিংয়ে পন্টিংরা থামলো ৫৫৬তে, ভারত আবারও খারাপ শুরু করল। মনে মনে তখন প্রমাদ গোনার পালা ফলো অনটা বাঁচলে হয়, এখান থেকেই দ্রাবিড় লক্ষ্মণ জুটি আবারও একটা অমর পার্টনারশিপ করে গেলেন, যেন বছর তিনেক আগের ইডেন গার্ডেন্স ফিরে এল।

দ্রাবিড়ের কভার ড্রাইভ আর লক্ষ্মণের কব্জির মোচড়ে ততক্ষনে সম্মোহিত স্টিভের বাহিনী। ভারত ও শেষ করল ৫২৩এ, এরপরে আগারকারের একটা দুরন্ত স্পেল ছয়টা উইকেট নিয়েছিলেন ৪১ রান দিয়ে, সচিনও মহাগুরুত্বপূর্ণ দুটো উইকেট তুলে নিয়েছিলেন স্টিভের আর মার্টিনের, দুজনেই জাঁকিয়ে বসতে যাচ্ছিলেন ম্যাচে তখন। অস্ট্রেলিয়া ২০০র কমেই শেষ, আর ভারত ২৩০ করলেই জিতবে।

পরের দিন দ্রাবিড়ীয় সভ্যতা মেনে আবারও ম্যাচ জেতানো ৭২* এ যখন ভারত জিতল চিমটি কেটে দেখতে ইচ্ছে করছিল ঠিক দেখলাম! সত্যিই অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে অস্ট্রেলিয়াকে হারালো ভারত? জীবনে তো এ জিনিস দেখিনি, ঘোর ছিল অনেক দিন।

মেলবোর্নে বক্সিং ডে টেস্টের শুরুর দিনটা একেবারে শেহবাগময় হয়ে উঠল, তার সাথে আফসোস বাড়ালো বীরুর ডাবল সেঞ্চুরি না হওয়া, এখনো মনে হয় কেন যে সাইমন কাটিচের লোপ্পা বলটা তুলে মারলেন বীরু, তাঁর যদিও আফসোস ছিল কেন সেটা ছক্কা হলো না!! সে যাই হোক দ্বিতীয় দিন ভারতের ব্যাটিং আবার মুখ থুবড়ে পড়ার পর ভারতীয় বোলারদের ওপর যেন স্ট্রিমরোলার চালালো অসি ব্যাটিং লাইন আপ। ভারত সমর্থক হয়ে সাত সকালে উঠে ওসব দেখা বড়োই কষ্টকর।

দ্বিতীয় ইনিংসেও ভালো খেললো না ভারত, কিন্তু মনে থাকবে ঐ পড়ন্ত বিকেলে ব্রেট লি – ব্র্যাড উইলিয়ামসের বল হেলমেটে আর গায়ে খেয়েও সৌরভের চোয়াল চাপা ৭৩, বাঙালির কলজের জোরটা আবারও সেদিন প্রমান হয়ে গেল যখন ভেতরে ভেতরে বাঙালি হিসেবে একটা প্রচ্ছন্ন গর্ব যে হচ্ছিল একথা বললে পাপ হবে না ! শেষ পর্যন্ত বাস্তবের রুক্ষ জমিতে ফিরে হেরে গেল ভারত।

এরপর সেই সিডনির নিউ ইয়ার টেস্ট, স্টিভের বিদায়ী টেস্ট ও বটে। স্টিভ ওয়ার বিদায়ী টেস্ট ঘিরে গোটা অস্ট্রেলিয়া জুড়েই যে আবেগের বাতাবরণ তৈরী হয়েছিল তাও ক্রিকেট রোম্যান্টিক মনে এখনো গেঁথে আছে। অস্ট্রেলিয়া বোলিংও সেই আবেগে ভেসে যেতে ভারত ৭০৫ খাড়া করল। সচিন গোটা সফরে রান না পাওয়ার জ্বালা জুড়োলেন ২৪১* দিয়ে আর লক্ষ্মণের আবারও একটা ভেরি ভেরি স্পেশাল সেঞ্চুরি এলো।

শচীনের ইনিংসটা ছিল এক এমন অমর ইনিংস যেখানে ভদ্রলোক ডাবল সেঞ্চুরি পূর্ণ হবার আগে অবধি একটাও কভার ড্রাইভ খেলেননি, কারণ সিরিজে বারংবার অজিদের ফাঁদে পা দিয়ে উইকেটের পেছনে আউট হচ্ছিলেন, নিজের শটের ওপর কতোটা নিয়ন্ত্রণ আর ধৈর্য থাকলে ঐ ইনিংসটা খেলা যায় তার ভিডিওটা যেকোনো ক্রিকেট শিক্ষার্থীর অবশ্য দেখার বিষয় হওয়া উচিত।

কুম্বলে আট উইকেট নিলেন অজিদের প্রথম ইনিংসে, কিন্তু ক্যাটিচ আর ল্যাঙ্গারের সেঞ্চুরিতে ভালোই ব্যাট করলো অস্ট্রেলিয়া, ফলো অন করানোর সুযোগ থাকলেও সৌরভ কিন্তু স্টিভের শেষ ম্যাচে আর সেই লজ্জা দিলেন না। শেষ পর্যন্ত ৪৪৩ টার্গেটের সামনে দাঁড়িয়ে যখন মনে হচ্ছে নতুন বছরে সিরিজ জয় হচ্ছেই ভারতের, তখনই সেখানে প্রাচীর হয়ে দাঁড়িয়ে গেলেন স্টিভ ওয়াহ, ঐ ৮০ রানের অমর ইনিংস ও বোধহয় জীবনে ভোলার নয়, শেষ বেলায় সিডনি রাঙিয়ে দিয়ে স্টিভ যখন কান ফাটানো হাত তালির মধ্যে দিয়ে ড্রেসিংরুমে ফিরলেন ম্যাচের তখন একটাই ফল হতে পারে – ড্র।

সৌরভ যখন ভরা সিডনিতে বোর্ডার-গাভাস্কার ট্রফিটা হাতে তুলে নিচ্ছিলেন তখন যে গর্ব অনুভব হয়েছিল সেদিন থেকে প্রায় ২০ বছর কাটলেও আজও সেটা যেন একই আছে, ২৩ মার্চ ২০০৩ এর বেদনাতেও প্রলেপ পড়লো অনেকটা। মনে হচ্ছিল বাঙালি অধিনায়কের হাতে বিশ্বকাপটা না থাক অস্ট্রেলিয়া থেকে অপরাজিত হয়ে বোর্ডার-গাভাস্কার ট্রফিটাতো এসেছে। তখন স্কুলজীবন, তাও ঐ ভোরে উঠে স্টার স্পোর্টস খোলার যে আমেজ তার সাথে অন্য কিছু মেলানো দুস্কর। এখনো যেন মনে হয় এই তো সেদিনই হল। স্মৃতি যে সততই সুখের!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link