৩৭০০ কিলোমিটার মাত্র

এক

বাদলের আজ ভীষণ অস্থির লাগছে। খুব ভোরে ঘুম ভেঙ্গেছে ওর। সাধারণত এত সকালে ও উঠতে পারেনা। কিন্তু আজ বেলা অব্দি ঘুমাতে পারেনি, মনটা সায় দেয়নি। ঘুম থেকে উঠে মাথার মধ্যে কেমন যেন ধক করে উঠল, ‘আজকে কী দিন?’

দিনের তারিখ আর তারিখের সাথে যোগসূত্র থাকা ম্যাচটার কথা মনে করেই তড়িঘড়ি করে উঠে গেল বাদল!

বাড়ির উঠানে এখন দাঁত ব্রাশ করছে । ওর বন্ধু নাহিদ পাশের পাড়া থেকে চলে এসেছে। নাহিদের হাতে একটা রেডিও দেখা যাচ্ছে।  সবার মধ্যেই কেমন উৎসব উৎসব ভাব, একটু চাপা উত্তেজনাও কি দেখা যাচ্ছেনা?

‘সজল এর সাইথ দেখা হইসে?’- বাম পাশের মাড়িতে ব্রাশ ডলতে ডলতে জিজ্ঞেস করে ফেলল বাদল।

‘না রে, ঘুম থিকা উঠিসে কিনা কিডা জানে’-হেঁয়ালি ভঙ্গিতে জবাব দিল নাহিদ।

‘আইজকার দিনিও ওর মরণের ঘুম লাগিসে’-কপট রাগের ভঙ্গিতে বলল বাদল।

দাঁত ব্রাশ করা শেষ করে কুলকুচি করার জন্যে কলপাড়ের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে বাদল। আনমনে মাথা নাড়ছে, কীসব হিসেবও কষছে মনে মনে। তবে সজলের জন্যে তেমন দুশ্চিন্তাগ্রস্থ হতে দেখা গেল না বাদলকে। নাহিদ একবার জিজ্ঞেস করেছিল সজলকে ডেকে আনবে কিনা। এপাশ-ওপাশ মাথা দুলিয়ে না-সূচক উত্তর দিয়েছে বাদল। যেন জানেই, ঠিক সময়েই পাওয়া যাবে সজলকে।

ক্লাস নাইন পড়ুয়া এই দুই যুবকের চাপা উৎকণ্ঠার ভেতর দিয়ে শুরু হল একটি সকালের, যে উৎকণ্ঠা দুই যুবকের প্রতীকি রূপে আসলে গোটা একটি জাতির। সময়টা ১৯৯৭, তারিখ ১৩ এপ্রিল। দেশ ছাপিয়ে দেশের লোকের মন যেদিন পড়ে আছে ৩৭০০ কিলোমিটার দূরে, জায়গাটির নাম কুয়ালালামপুর স্টেডিয়াম, মালয়েশিয়া।

দুই

ঝকঝকে আকাশ, তবু কিনা বৃষ্টি নিয়ে চিন্তা।

বাদলদের বাড়ির উঠানে বসে আছে সজল, নাহিদ, মাসুদ, নোমান আর আবির। জটলাটার সামনে একটা রেডিও দেখা যাচ্ছে, সকালে যেটা নাহিদ এনেছিল। রেডিওটা গত জন্মদিনে বাবা ওকে দিয়েছে। প্রকৃতির বেখেয়াল না হলে এতক্ষণে ওটাতে গমগমে ধারাভাষ্য বেজে চলার কথা ছিল, আইসিসি ট্রফির ধারাভাষ্য।

এমনিতে বাংলাদেশে তখন ক্রিকেটের মাতামাতিটা কেবল ভারত-পাকিস্তান ঘিরেই আবর্তিত হত। কারো ঘরে শচীন তো কারো ঘরে ওয়াসিমের বড় করে টাঙানো ছবি। ভারত-পাকিস্তান ম্যাচ মানে তখন উৎসবের আমেজ। সবার মাঝেই কেমন চ্যালেঞ্জ ছোঁড়ার ভাব। কিন্তু সেদিন, সব ভুলে সবাই হয়ে গেল একাট্টা। আজকে আর কেউ ভারত কিংবা পাকিস্তান নয়, আজকে সবাই বাংলাদেশ।

‘২৪২ করতি পারবানি তো?’ -সজল কেমন ভয়ধরা কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল, কাকে জিজ্ঞেস করল কেউ জানেনা।

রেডিওতে শোনা যাচ্ছে কুয়ালালামপুরে তখনও হানা দিয়ে যাচ্ছে বৃষ্টি। প্রকৃতির আশীর্বাদ তখন হয়ে এসেছে বাংলাদেশের চিন্তা হয়ে। আর্জেন্টিনা, ডেনমার্ক, আরব আমিরাতকে হারানো আর কেনিয়াকে হারানো যে এক কথা নয়। আগের দিন গোটা এক ইনিংস খেলা হয়ে গেছে। বৃষ্টিতে হতে পারেনি পরেরটা। আকরাম খান টসে জিতে নিয়েছিলেন ফিল্ডিং। ধারাভাষ্য থেকে ততক্ষণে জানা গেছে শান্তর নিয়ন্ত্রিত বোলিং, রফিক-সুজনের তোলা উইকেট আর কেনিয়ান টিকোলোর একা হাতে দলের ইনিংস এগিয়ে নেওয়ার গল্প।

‘অই যে টাক্লা না কি জানি নাম, ওইতিই তো টেশ টা মাইরে দিল’ গালে হাত দিয়ে অভিযোগের সুরে বলছে সজল।

‘টিকোলো’, নামের উচ্চারণ ঠিক করে দিল বাদল।

আজকে কি বাংলাদেশ জিতবে? কেউ জানেনা!

তিন

উদাস ভঙ্গিতে বসে আছে আবির। এক হাত উঠিয়ে নোমানের ঘাড়ে রাখল, শরীরের পুরো ভর নোমানের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে হেলে পড়ল একপাশে, তাকিয়ে আছে আকাশে। আকাশে একটা কাক দেখা যাচ্ছে। উঠোনের বড় আমগাছটার একটা ডাল থেকে আরেকটা ডালে উড়ে বেড়াচ্ছে। মানুষের আবেগ কি পাখিকেও স্পর্শ করে? এক ডাল ছেড়ে উঠতে আরেকটি ডালে বসতে কি তার পাখা ঝাপটানি, যে ঝাপটানির দোলা যেন আমডাল থেকে প্রতিরূপ হচ্ছে প্রত্যেকের হৃদয়ে।

পাশের বাড়ি থেকে আমজাদ চাচা চলে এলেন, ‘এ মণি, কি হচ্ছে এট্টু ক দিনি’।

‘খেলা বন্ধ চাচা, বিস্টি হচ্ছে ম্যালা’, আমজাদ চাচার জবাব দিল মাসুদ। আমজাদ চাচাকেও কি আজ একটু অন্যরকম লাগছে? মাথার টুপিটা খুলে মাথার অল্প কয়েকটি চুলে হাত বুলালেন তিনি, ভাবগম্ভীর আমজাদ চাচা পর্যন্ত আজ চিন্তিত, যে চিন্তা তার লেবাস ভেদ করে আজ অকপট স্বীকারোক্তি জানাচ্ছে আমগাছের নিচে সমচিন্তিত পাঁচ কিশোরকেও।

আমজাদ চাচার পাশে এসে দাঁড়ালেন মণি ভাই। মণি ভাইয়ের চিন্তাটা অন্যদের চেয়ে একটু বেশি। কয়েকটা বর্ণের রঙ কিনে মজুদ করে রেখেছেন তিনি। আজ জিতলে রাতে পাড়ায় খিচুড়ি রান্না হবে। ডেকোরেটরদের আগেই বলে রাখা আছে, বড় বড় দুটো হাঁড়ি দেবে তারা। আর না জিতলে? সেসব জানেনা মণি ভাই। তার ভাষায়, ‘এইবার জিতেই যাবানি’

মণি ভাই চলে গেলেন, চলে গেলেন আমজাদ চাচাও। পাঁচ কিশোরকেও উঠতে হবে। খেলা হচ্ছে না, স্কুলে যেতে হবে। একে একে সবাই উঠল, বই খাতা নিয়ে সেই আমতলাতেই এসে দাঁড়াল কিছুক্ষণ পর, একসাথে রওনা হবে স্কুলের দিকে।

চার

পিঠে ব্যাগ ঝুলিয়ে স্কুলের দিকে হাঁটছে ওরা। রেডিওটা নিতে ভুল করেনি নাহিদ। সকাল এগারোটা বাজে। তাড়াতাড়ি গিয়ে ক্লাস ধরতে হবে।

‘রেডিওডা লুকায়ে রাখতি হবে নাহিদ, আরমান স্যারের চোখে পড়লি আর রক্ষি নেই’, সতর্ক করার ভঙ্গিতে বলল নোমান।

পিঠে হাত দিয়ে ব্যাগে রাখা রেডিওটা একবার নিশ্চিত করে নিল যেন নাহিদ। নাহ, ঠিক আছে। স্যার তো আর ব্যাগ ঘেটে দেখবেননা , রেডিওটা পাওয়ার সুযোগ নেই।

‘নেদারল্যান্ডরে যেরাম করে হারালাম, মনে হচ্ছে কেনিয়ারেও হারায় দিবানি’, ক্রিকেট ছাড়া এ মুহুর্তে যেন আর কিছুতে আগ্রহ পাচ্ছে না বাদল।

আস্তে আস্তে হেঁটে যাচ্ছে পাঁচ কিশোর। নর্দমা দেখলে লাফিয়ে যাচ্ছে, সমান রাস্তায় গতি বাড়াচ্ছে। এগিয়ে যাচ্ছে ওদের আজকের স্বপ্নটাও, এগিয়ে যাচ্ছে আশাটিও – প্রতিকূলতা দেখলে আজ লাফিয়ে পার হবে ব্যাটসম্যানেরা, বাজে বলগুলোতে রানের চাকা ছুটবে- ২৪২ তো আর সোজা কথা নয়!

পাখিরা ডাকছে, সেই পাখির ডাক কেউ বুঝছে না, কেউ বুঝছে না গোটা একটি জাতির জন্যে কি পরশপাথরের মত সন্ধ্যা অপেক্ষা করছে, যে সন্ধ্যাতে বুক ভরে শুধুই নেবার আছে, হারাবার কিছুই নেই। যে সন্ধ্যাতে মায়া আছে, আনন্দ আছে, এমন আনন্দে বহুদিন মেতে ওঠেনি ওরা।

কেউ জানেনা, না ভোলার মত একটি রাতও তাদের হাতছানি দিয়ে ডাকছে।

পাঁচ

মাজেদা ম্যাডাম ক্লাস নিতে ঢুকেছেন। আজ যেন ম্যাডামকেও একটু অন্যরকম লাগছে। নাহ, তা কি করে হয়। ম্যাডাম তো ক্রিকেট দেখেননা, বোঝেনওনা খুব সম্ভবত।

রোল কল করে ক্লাস নিতে শুরু করেছেন মাজেদা ম্যাডাম। বারবার বোর্ডের উপরে লাগানো স্পিকারের দিকে তাকাচ্ছেন। এই স্পিকারটি সরাসরি প্রধান শিক্ষকের রুমের সাথে তারের মাধ্যমে যুক্ত। যেকোন ঘোষণা প্রধান শিক্ষক দিতে চাইলে তার রুমের মাইক্রোফোনের মাধ্যমে ঘোষণা দিয়ে দিলেই হল। মাজেদা ম্যাডাম কোন একটি ঘোষণার অপেক্ষা করছেন কি? আজকে স্কুল ছুটি দেওয়া যায় কিনা সেরকম একটি আলোচনা নানা জায়গায় শোনা গেলেও তাদের স্কুলের হেড স্যার বলেছেন রীতিমত পুরো রুটিনের ক্লাস হবে। মাজেদা ম্যাডাম মনে হয় আশা করছেন, হঠাৎ করেই ক্লাস ছুটি দিয়ে দেওয়া হবে।

বেশ ধীরে রোলকল শেষ করবার পরও যখন কোনরকম ঘোষণা আসল না, মাজেদা ম্যাডাম এক রকম অসহায়ের ভঙ্গিতে তার ক্লাস নেওয়া শুরু করে দিলেন।

মাজেদা ম্যাডামের ক্লাস চলছে। পেছনের বেঞ্চে বসা নাহিদ সামনে বসা বাদলের জামা টানছে। পেছনে তাকাল বাদল। চোখে জিজ্ঞাসা। গলা যথাসম্ভব নামিয়ে মাত্র রেডিওতে শোনা কথাটা বাদলকে বলল নাহিদ, ‘দেড়ডায় খেলা শুরু হবে বাদল। ২৫ ওভারে খেলা হবে। ১৬৬ টার্গেট দিছে।’

বিদ্যুৎগতিতে এ তথ্য পাচার হয়ে গেল অন্য সবার কাছেও।

ছয়

আরমান স্যার ক্লাস নিচ্ছেন। কেউ শব্দ করতে পারছে না। স্যারের হাতে রাখা বেতটা নতুন বলে মনে হচ্ছে। আগেরদিনের বেতটা সুমনকে পেটানোর পর ভেঙ্গে গেছিল, সবাই নিজ চোখে দেখেছে। দিন পার না হতেই স্যার নতুন বেত যোগাড় করে ফেলবেন, এটা কেউ ভাবেনি। কিন্তু দেখা যাচ্ছে না ভাবা ব্যাপারটাই ঘটে গেছে।

ছাত্ররা উশখুশ করছে। আর কিছুক্ষণ পরই খেলা শুরু হবে। প্রধান শিক্ষক স্কুল ছুটি দেননি। আরমান স্যারও কি একটু অস্বস্তিতে ভুগছেন?

‘আইজকে খেলা আছে জানিস তোরা?’ গলা খাঁকারি দিয়ে আরমান স্যার ছাত্রদের উদ্দেশ্যে জিজ্ঞেস করলেন।

সবাই নিশ্চুপ হয়ে আছে। তারা আরমান স্যারের আরো কিছু বলবার অপেক্ষাতে আছে। তারা জানে, আরমান স্যারের বক্তব্য শেষ হয়নি।

‘আইজকার দিনি স্কুলডা ছুটি দিলি কি এমন ক্ষতি হয়ে যাইতো কিডা জানে, এরাম দিনি কেলাসে মন বসে কারো?’

আরমান স্যারকে অন্যরকম লাগছে না, তিনি আসলেই অন্যরকম হয়ে গেছেন আজ। এতটা আন্তরিক, এতটা বন্ধুসুলভ আরমান স্যারকে কি কেউ দেখেছে কখনো?

‘কি কইরে যে খেলাডা শুনবানি….’

এমন সময় সাহস করে কথাটা বলেই ফেলল বাদল, ‘স্যার আমার কাছে এট্টা বুদ্ধি আছে। আপনি অনুমতি দিলি এই স্পিকারে রেডিও লাগাতি পারি। ‘

আরমান স্যার খানিকটা ভড়কে গেলেন। স্পিকারটি সরাসরি প্রধান শিক্ষকের রুমের সাথে যুক্ত। সেই স্পিকারে কিভাবে রেডিও বাজবে তিনি ভাবনাচিন্তা করেও উত্তর পেলেননা। তার চেয়েও বড় যে প্রশ্নটি তার মনে উঁকি দিল, এই মুহুর্তে রেডিও পাওয়া যাবে কোথায়?

তিনি ফ্যালফ্যাল করে বাদলের দিকে তাকিয়ে রইলেন। বাদল খানিকটা সাহস পেল। মিনমিন করে পরের কথাটা বলেই ফেলল, ‘স্যার সুমায় বেশি নেই, কাজ শুরু কইরে দি?’

আরমান স্যার মোহগ্রস্তের মত ‘কর’ বলে নিজের চেয়ারে গিয়ে বসে পড়লেন। ছেলেদের কাজ দেখার অপেক্ষা করছেন। আরমান স্যারকে এভাবে বদলে দিল কে , নাকি প্রশ্নটা হবে ‘কী’?

আরমান স্যার দেখলেন পেছনের বেঞ্চে নাহিদের ব্যাগ থেকে একটা বেশ শক্তিশালী রেডিও বের হল। আরমান স্যার বুঝতে পারলেননা এসব পূর্ব পরিকল্পিত কিনা। কিন্তু তিনি কোনরকম বাঁধাও দিলেন না, কিছু জিজ্ঞেসও করলেন না। এই মুহুর্তে খেলাটি শোনার জন্যে তিনি যেকোন কিছুর অনুমতি দিতে পারেন।

বাদল বারান্দায় গিয়ে দেওয়ালের সাথে লাগানো স্পিকারের তারটি তার ব্যাগে রাখা আম কাটার ছুরির সাহায্যে কেটে ফেলল। তারটির এক প্রান্ত এখন ক্লাসরুমে, আরেক প্রান্ত দেওয়াল বেয়ে চলে গেছে নিচ তলার প্রধান শিক্ষকের কক্ষে। এরপর সে মাসুদের ব্যাগে রাখা টর্চের চার্জারের গোড়ার পিনটি কেটে নিয়ে খানিকটা তার বের করল। এরপর সেই তার জুড়ে দিল স্পিকারের ছেঁড়া তারটির সাথে। স্পিকারের ছেঁড়া তারটির প্রান্তে এখন পিনের মত দেখা যাচ্ছে। এরপর সেই পিনটি সে লাগিয়ে দিল রেডিওর ‘স্পিকার’ লেখা সকেটে।

রেডিওটি অন করা মাত্র স্পিকার গমগম করে উঠল, তবে সেখানে প্রধান শিক্ষকের রাশভারী কণ্ঠের বদলে শোনা গেল টেনে টেনে দেওয়া ক্রিকেটের ধারাভাষ্য। নাইমুর রহমান আর মোহাম্মদ রফিক ব্যাট করতে নামছে….

আজ স্কুলে কোন টিফিন পিরিয়ড হল না। আর কোন পিরিয়ডে ক্লাসও হল না। সেসব ক্লাস নিতে যে শিক্ষকেরা এলেন না তা কিন্তু নয়, শিক্ষকেরা এলেন কিন্তু তারা বসে গেলেন পেছনের বেঞ্চে। দৃশ্যহীন, গন্ধহীন এক জগতে ওরা ডুবে গেল স্রেফ ধারাভষ্যকারের সাথে মাঠের কল্পনায়, নিজের ভাবনাতে দেখতে শুরু করল কল্পনায় আঁকা এক ম্যাচ।

সাত

দুপুর গড়িয়েছে অনেক্ষণ। সূর্য মনে হয় পশ্চিম দিকে ঢলেও পড়েছে। তবে সেসব আর দেখার সময় নেই কারো। ধারাভাষ্যকার বলেছেন আর এক ওভার বাকি আছে , বাংলাদেশের জিততে হলে লাগবে আরো ১১ রান!

হায় খোদা, শেষটায় তবে কি এই হার নিয়েই বাড়ি ফিরে যেতে হবে? দেয়ালে লাগানো স্পিকারে বেজে যাচ্ছে-

‘কেনিয়ান মার্টিন সুজি বল করতে আসছেন। চারপাশে খানিকটা দেখে নিয়ে তিনি বল করবার জন্যে প্রস্তুত হলেন। ব্যাটিং ক্রিজে আছেন খালেদ মাসুদ পাইলট, দৌড় শুরু করলেন মার্টিন সুজি …’

সেকেন্ডের জন্যে যেন হৃদপিণ্ডটা থেমে আসছিল নোমানের। হাতজোড়া মুখের সাথে লেপ্টে আছে অনেক্ষণ। কান খাড়া করে পুরো ক্লাসরুম তাকিয়ে আছে দেয়ালে লাগানো স্পিকারটির দিকে।

‘ফুল টস এবং সামনের বাউন্ডারি দিয়ে ছক্কা হাঁকালেন পাইলট……’

পরেরটুকু শোনবার অপেক্ষায় তখন আর কেউ বসে নেই। নোমান উঠে দাঁড়িয়ে পাশে বসা আবিরকে জড়িয়ে ধরে ফেলল। আর একটু, আর একটুখানি। নবীন একটি দলের, নবীন এই সমর্থকদের স্বপ্নটা হাতছোঁয়া দূরত্বে, আর একটু বাকি যেটি ছুঁতে।

‘৫ বলে এই মুহুর্তে জিততে বাংলাদেশের লাগবে ৫ রান। পরের বল করতে দৌড় শুরু করেছেন মার্টিন সুজি…..একইভাবে ব্যাট চালালেন পাইলট কিন্তু ব্যাটে বলে হল না, বল জমা পড়েছে কিপারের গ্লাভসে..’

চাপা একটি শব্দে পুরো ক্লাসরুম যেন থমকে গেল। আরমান স্যার তার চেয়ারে বসে আছেন। তিনি রেডিওর দিকে তাকাচ্ছেন না। টেবিলের দিকে মুখ রেখে তিনি কান খাড়া করে আছেন রেডিওর দিকে।

জিতবে তো বাংলাদেশ?

‘এই মুহুর্তে বাংলাদেশের প্রয়োজন ৪ বলে ৫ রান। ১৬৬ রানে বাংলাদেশ ম্যাচ জিতবে, ১৬৫ রানে হেরে যাবে বাংলাদেশ। ডাকওয়ার্থ লুইস মেথডে টাই প্রযোজ্য হয়না…’

আরেকটি চাপা উত্তেজনা। বাদল যেন মূর্তিবৎ পাথর হয়ে গেছে।

‘পরের বল করতে আসছেন মার্টিন সুজি, লেগ সাইডে পেছন দিয়ে মারতে গেলেন পাইলট , ব্যাটে লাগাতে পারলেন না এবং এটি একটি ওয়াইড বল, তার মানে বাংলাদেশের সংগ্রহে যোগ হচ্ছে আরেকটি রান, জেতার জন্যে প্রয়োজন ৪ বলে ৪ রান…’

পুরো ক্লাসরুম যেন আটকে রাখা শ্বাসটুকু ছেড়ে দিল। পেছনের সারি থেকে কে যেন লাফিয়ে উঠে একটি চিৎকার দিয়ে ফেলল। একটি রানের আনন্দ তখন এক পাহাড় সমান। কতটা কাছে আছে তারা? এতটা কাছে থেকেও কি কেউ বিফল হয়? পরাজিত হয়? জানে না কেউ! সবাই জানে শুধু একটি প্রার্থনা- হে খোদা, বাংলাদেশকে আজ জিতিয়ে দিও!

‘কেনিয়ার জেতার জন্যে চাই উইকেট ,বাংলাদেশের রান। পরের বল করছেন মার্টিন সুজি, সোজা করা বলটি ঠেলে দিলেন পাইলট, ডাইরেক্ট থ্রোতে স্ট্যাম্পে লাগাতে পারলেন না, বাংলাদেশের সংগ্রহে যোগ হল এক রান….’

আরো একটি চিৎকার , আরো একবার উদযাপন। ৩৭০০ কিলোমিটার দূরে থেকেও ঐ মাঠের প্রতিটি স্পন্দন যেন টের পাচ্ছে তারা। আর একটুখানি, অল্পই বাকি আছে। সেই অল্পই না আক্ষেপের গল্প হয়ে যায়, কে বলতে পারে।

‘এই মুহুর্তে ব্যাটে আছেন হাসিবুল হোসেন শান্ত, বল করতে আসছেন মার্টিন সুজি, ৩ বলে বাংলাদেশের লাগবে মাত্র ৩ রান। বল পিচে গড়াল স্ট্যাম্পের বেশ খানিকটা সামনে, সোজা তুলে মারতে গেলেন শান্ত, ব্যাটে বলে হল না, বল জমা পড়ল উইকেট কিপারের গ্লাভসে…’

নাহিদ থরথর করে কাঁপছে । এই মুহুর্তে সে আর কিছু ভাবতে চায়না, সে চায় তার জীবনের সবটুকুর বিনিময়েও যেন আজ বাংলাদেশ জিতে যায়। সদ্য কৈশোরে পা দেওয়া নাহিদের সরল আবেগ স্রষ্টাকে স্পর্শ করবে কিনা , তার সরল প্রার্থনা স্রষ্টা মঞ্জুর করবেন কিনা, তখন পর্যন্ত কেউ জানেনা!

‘বাংলাদেশের দরকার ২ বলে ৩ রান। মার্টিন সুজির মুখোমুখি হচ্ছেন শান্ত, প্যাভিলিওনে ছোটাছুটি করছেন গর্ডন গ্রিনিজ…… একই রকম বল করলেন সুজি, লেগ সাইডে হাঁকালেন শান্ত, বল মাটি কামড়ে এগিয়ে যাচ্ছে সীমানার দিকে, কিন্তু শেষ মুহুর্তে বলটি তালুবন্দী করতে ভুল করলেন না ফিল্ডার, বল ছুঁড়ে দিলেন বোলারের উদ্দেশ্যে। স্কোর এখন সমান, বাংলাদেশ দৌড়ে নিয়েছে ২ রান…’

দ্রুতগতিতে বলে গেলেন ধারাভাষ্যকার। স্নায়ু ধরে রাখতে কষ্ট হচ্ছে বোঝা যাচ্ছে।

পুরো ক্লাসরুম এখন নিশ্চুপ। এই নিশ্চুপতার একটি ভাষা আছে। এই ভাষা পেয়েও হারানোর, এই ভাষা আজ রাতের উৎসবের পন্ড হওয়ার আশঙ্কার, এই ভাষা হাতছোঁয়া দূরত্বে থেকেও স্পর্শ করতে না পারার যন্ত্রণার।

‘বাংলাদেশের জেতার জন্যে প্রয়োজন ১ রান। যেকোন কিছুর বিনিময়ে ১ রান হলেই জিতে যাবে বাংলাদেশ, ব্যাটে আছেন হাসিবুল হোসেন শান্ত…. বল করতে দৌড় শুরু করেছেন সুজি… ইয়োর্কার দিলেন, ব্যাট ঠেকিয়ে পেছনে লেগ সাইডে পাঠিয়ে দৌড় শুরু করেছেন শান্ত…

পুরো ক্লাসরুম তখন উঠে দাঁড়িয়েছে ।অথচ কেউ জানেনা মিলিসেকেন্ডের ব্যাবধানে একটি রান পূর্ণ না হলে পন্ড হতে পারে তাদের স্বপ্ন, ডাকওয়ার্থ লুইস মেথডে টাই না থাকায় জিতে যেতে পারে কেনিয়া।

ধারাভাষ্যকারের চিৎকারে জড়তা ভাঙল সবার। একটি রান নিতে পেরেছে বাংলাদেশ।

এরপর আর দেখবার সময় হল না । কোন দিকে তাকাবার ফুরসৎ রইল না। কুয়ালালামপুরের আকরাম খানের সাথেই যেন ক্লাসরুমের সব শিক্ষার্থীরা দৌড় শুরু করল। পাগলের মত চিৎকার করছে তারা। এমন জয় কি কখনও দেখেছে তারা? এমন উদযাপন কি এর আগে কখনও করেছে?

আট

বাদল কাঁদছে। নাহিদকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে নোমানও। কি করবে বুঝে উঠতে পারছে না আবির ও মাসুদ। পাগলের মত ছোটাছুটি করছে তারা। আরমান স্যারও আজ একাকার হয়ে গেছেন সবার সাথে। ঐ একটি রান, ঐ একটি দৌড় যেন বের করে এনেছে আরমান স্যারের নিজের ভেতর লুকিয়ে রাখা স্বত্ত্বাটাকেও।

রাস্তাতেও মানুষের ঢল নেমেছে। তারা পাগলের মত চিৎকার করছে। খুশিতে আত্মহারা হয়ে গেছে। নাহিদ আরমান স্যারের সাথে ক্লাসরুমের বাইরে বের হয়েছে। স্যার বয়সের ভারে আবেগ লুকিয়ে রাখতে চাইছেন। নাহিদ পারছে না। সে চিৎকার করেই যাচ্ছে, ‘ও স্যার শুনিসেন আমরা জিতিসি, ও স্যার আপনি শুনিসেন? আমরা জিতিসি, ও স্যার……।’

নাহিদকে সামলাতে আসা বাদলও নাহিদকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলেছে। রাস্তাতে বিজয় মিছিল বের হয়েছে। কান্নার দমকটা পেরিয়ে গেলে সবাই যোগ দিতে বের হল বিজয় মিছিলে।এরপর কি আর কাঁদবে তারা?

রাস্তাতে রঙখেলা শুরু হয়েছে। মণি ভাইকে দেখা যাচ্ছে দূরে। পকেট থেকে সবুজ রঙের একটা প্যাকেট বার করছেন তিনি। স্লোগানে স্লোগানে রঙ খেলছে মানুষ, প্রত্যেকে আজ নেমে এসেছে রাস্তায়। এমন আনন্দ বহুদিন কেউ করেনি, এমন উপলক্ষ্য বহুদিন আসেনি এই দেশে। মিছিলের ভিড়ে হারিয়ে গেল পাঁচ কিশোর, পূর্ণ হয়েছে তাদের আশা, এখন শুধুই উৎসবের সময়।

লেখক পরিচিতি

আদ্যোপান্ত স্টোরিটেলার!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link