৬, ৬, ৬ এবং ৬!

কার্লোস ব্রাথওয়েট, কার্লোস ব্রাথওয়েট – রিমেম্বার দ্য নেইম!

কমেন্ট্রি ইয়ান বিশপের বজ্রকন্ঠে বিশ্বকাপ জয়ের উল্লাস। মাঠের ভিতর দৌড়ে ছুটে চলেছেন ডেরেন স্যামি, ক্রিস গেইলরা। একপ্রান্তে ব্রাথওয়েট, স্যামুয়েলসদের বাধ ভাঙ্গা উল্লাস আর অপরদিকে, বোলিং প্রান্তে মুখে হাত দিয়ে মাথা নিচু করে বসে আছেন বেন স্টোকস! তাকে সান্ত্বনা দিতে পাশে দাঁড়িয়ে ইংলিশ অধিনায়ক ইয়ন মরগ্যান। দ্বিতীয় বারের মতো টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ট্রফি ঘরে তোলে ক্যারিবিয়ানরা। মাত্র চার বল আগেও ম্যাচে ছিল ইংলিশদের দাপট আর আধিপত্য! চার বলের ব্যবধানে পাল্টে গেল ইডেন গার্ডেন্সের চিত্র।

ইংলিশদের দেওয়া ১৫৬ রানের টার্গেটে ব্যাট করতে নেমে শেষ ওভারে প্রয়োজন ছিল ১৯ রানের! শেষ ওভারে বল হাতে তরুণ বেন স্টোকস, অপর প্রান্তে আরেক অনভিজ্ঞ কার্লোস ব্রাথওয়েট। স্টোকসের করা প্রথম চার বলের চারটি তেই ছক্কা হাঁকিয়ে নাটকীয় এক জয় তুলে নেয় ব্রাথওয়েট! স্টোকস যেন বিশ্বাসই করতে পারছিলেন না, কি হচ্ছে! ইডেন গার্ডেন্সে শেষ ওভারে ব্রাথওয়েটের ছক্কা বৃষ্টিতে স্বপ্ন ধূলিসাৎ হয় ইংলিশদের।

এই চার ছক্কার পর তো তিনি ক্রিকেট বিশ্বে হিরো বনে যান। আচ্ছা, এর আগে কার্লোস ব্রাথওয়েটকে চিনতেন কয় জন?

২০১১ সালে বাংলাদেশের বিপক্ষে তার অভিষেক হয়। এরপর ২০১৬ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের আগ পর্যন্ত মোটে ৭ ম্যাচ খেলার সুযোগ পান তিনি। তাও কিনা অভিষেকের পর প্রথম দুই ম্যাচে দুই রান করার পর চার বছর আর দলেই সুযোগ পাননি তিনি! চার বছর পর বিশ্বকাপ দিয়েই দলে ফেরেন ব্রাথওয়েট। ফাইনালের আগে সেই টুর্নামেন্টে পাঁচ  ম্যাচে দলে সুযোগ পান তিনি। যার মধ্যে দুই ম্যাচে ব্যাটিংয়ে নেমে করেন ১৮ বলে ২৩ রান!

এরকম পারফরম্যান্স দেওয়া একটা খেলোয়াড় থেকে শেষ ওভারে চাপের মুখে চার বলে চার ছক্কার কথা কেউ কি কল্পনাতেও ভেবেছিলেন সেদিন? শেষ ওভারের আগের ওভারে যেভাবে ক্রিস জর্ডান বল করেছিলেন মনে হচ্ছিল ইংলিশরাই শেষ পর্যন্ত ম্যাচটি জিতবে! শেষ ২ ওভারে ম্যাচ জিততে প্রয়োজন ছিল ২৭ রান। ১৯ তম ওভারের প্রথম বলে চার রান নিলেও বাকি ৫ বল থেকে মাত্র ৪ রান দেন জর্ডান। এতে শেষ ওভারে ক্যারিবিয়ানদের সামনে ৬ বলে ১৯ রানের কঠিন সমীকরণ দাঁড়ায়! এরপর কার্লোস ব্রাথওয়েটের সেই অবিশ্বাস্য চার ছয়ের তান্ডব – দুই বল বাকি থাকতেই বিশ্বকাপ ছিনিয়ে নেয় ক্যারিবিয়ানরা।

ব্রাথওয়েট তো শেষ ওভারের নায়ক, কিন্তু পুরো ইনিংসে যিনি চাপের মুখে একপ্রান্তে রানের চাকা সচল রেখে শেষ পর্যন্ত টিকে ছিলেন তাকে ভুলে গেলেন? সেদিন ফাইনালে ক্যারিবিয়ানদের বিধ্বস্থ ব্যাটিং লাইনআপে ঠায় হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন আরেকজন। হ্যাঁ, মারলন স্যামুয়েলস! যিনি ক্যারিবিয়ানদের দু:সময়ের কান্ডারি। ২০১২ সালে স্যামুয়েলসের করা ব্যাট হাতে ৫৬ বলে ৭৮ আর বল হাতে ৪ ওভারে ১৫ রানে ১ উইকেট নিয়ে ম্যাচ সেরা হয়ে দলকে জিতিয়েছিলেন প্রথম টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ! ৪ বছর আবারো ক্যারিবিয়ান দু:সময়ের ক্রাইসিস ম্যান ৯ চার ও ২ ছক্কায় ৬৬ বলে ৮৫ রানের ইনিংস খেলে দলকে জয়ের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যান স্যামুয়েলস।

ওয়েস্ট ইন্ডিজের জয় পাওয়া দুই টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের নায়কই মারলন স্যামুয়েলস। চরম ব্যাটিং বিপর্যয় আর চাপের মুখে দুই বিশ্বকাপের ফাইনালেই তিনি বুক চিতিয়ে লড়াই করেন। কার্লোস ব্রাথওয়েটের চার ছক্কার আড়ালে পড়ে যাওয়া স্যামুয়েলসের সেই ইনিংসের জন্যই ম্যাচটা শেষ ওভার পর্যন্ত গিয়েছিল!

এবার আসি সেই বিশ্বকাপে ভিলেন বনে যাওয়া বেন স্টোকসের কথায়। বর্তমানে বিশ্বক্রিকেটে সেরা অলরাউন্ডারদের একজন বেন স্টোকস, সেটা নিঃসন্দেহে। কিন্তু ২০১৬ বিশ্বকাপের আগে সেভাবে তিনি পরিচিতি পাননি। ২০১১ সালে অভিষেক হলেও বিশ্বকাপের আগে খেলা কোনো ম্যাচেই বল হাতে তিনি উইকেট পাননি, ব্যাট হাতে দশ বছরের ক্যারিয়ারে এখনো ফিফটিও করতে পারেননি।

তবে, সেবার ফাইনালের আগে ম্যাচে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ২৬ রানে ৩ উইকেট নিয়ে বল হাতে দুর্দান্ত পারফরম্যান্স দেখিয়েছিলেন তিনি। ফাইনালে শেষ ওভারে তাই ইয়ন মরগান তার উপরই ভরসা রেখেছিলেন! অবশ্য এছাড়া অন্য কোনো অপশনও ছিল না। প্রথমে ২ ওভারে দিয়েছিলেন ১৬ রান, সে হিসেবে শেষ ওভারে ভরসা করাই যায়। কিন্তু কার্লোস ব্রাথওয়েটের দানবীয় চার ছক্কায় হিরো হবার সেদিন ইডেন গার্ডেনে ভিলেন বনে গিয়েছিলেন বেন স্টোকস!

তবে, সেই চার ছক্কা ব্রাথওয়েটকে নয়, বেশি পরিণত করে বেন স্টোকসকেই। বেন স্টোকস তিন বছর পর ইংল্যান্ডের হয়ে জেতেন ওয়ানডে বিশ্বকাপের শিরোপা, আর ব্রাথওয়েট অনেক সম্ভাবনা থাকার পরও নিজেকে হারিয়ে খুঁজছেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link