২৫ শে জুলাই, ২০০৭।
বাংলাদেশ-শ্রীলঙ্কার মধ্যকার ৩ ম্যাচ ওয়ানডে সিরিজের শেষ ম্যাচ। প্রথম দুই ম্যাচে বাংলাদেশ বাজেভাবে হারায় শেষ ম্যাচে হোয়াইটওয়াশ এড়ানোর লক্ষ্যে দলে বদল আনা হয়। অভিষেক হয় নতুন এক খেলোয়াড়ের।
সাত নম্বরে নেমে ৫৪ বলে করেন ৩৬। তামিম ইকবালের ৫৪ রানের পর দলের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রান। মিডল অর্ডার যখন হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়ছে শ্রীলঙ্কার পেস তান্ডবে এবং সনাথ জয়াসুরিয়ার স্পিনে যখন চোখে সর্ষেফুল দেখার অবস্থা, তখন স্থিতধী ব্যাটিং এ তিনি একটু একটু করে দলের রান বাড়ালেন। সেদিন ব্যাটিং বিপর্যয়ে দলের ২২.৯৬% রান আসে তার ব্যাট থেকে। তবুও যেন নির্বাচক দের মন ভরানো গেল না। নিউজিল্যান্ড সফরে মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ নেই!
নাহ! কোন অভিযোগ করেননি তিনি। সে বছর আরো চার খানা টি-টোয়েন্টি খেলেন। ৪ ম্যাচে করেছিলেন মাত্র ২৮। রাজকীয় কোন শুরু নয়। মানা হয়নি বাংলাদেশ ক্রিকেটের চিরাচরিত ‘অভিষেক রীতি’।
ওহ ভাল কথা! বহু স্মৃতির ২০০৭ ওয়ানডে বিশ্বকাপেও কিন্তু মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ নেই!
২০০৮ এর ঘরের মাঠের দক্ষিণ আফ্রিকা সিরিজেও ওয়ানডে দলে রিয়াদ নাই। ফেরানো হল আয়ারল্যান্ডের সাথে হোম সিরিজে। সিরিজের শেষ ম্যাচে ভাল শুরুর পর যখন বাংলাদেশ দলের মিডল অর্ডার আবারও হুড়মুড়িয়ে ভেঙে যাচ্ছে, নিজের কাজটি সেদিন প্রথমবারের মত করে ফেললেন মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ। ৪৪ বলে ৪৯ রানের ইনিংসের সৌজন্যে বাংলাদেশ পার করে ফেলে ২৯০ এর কোটা।
রিয়াদ কি সেদিন হেলমেট হাতে হাতের কবজি দিয়ে কপালে জমে থাকা ঘাম মুছতে মুছতে ড্রেসিং রুমে ফেরার পথে জানতেন, এই কাজটি তাকে আগামী দিনে করতে হবে বারবার? যতবার বাংলাদেশ ক্রিকেটের ব্যাটিং লাইন আপ এ কলাপ্স ঘটবে, ততবারই ডাক পড়বে একজন মাহমুদুল্লাহর!
মাহমুদুল্লাহ তখন নিজেকে চেনানো শুরু করেছেন। সে বছরই পাকিস্তান সফরের দ্বিতীয় ওয়ানডে।
ইকবাল স্টেডিয়াম। তামিম ইকবালের ৬০ রানের পর দলের পরের চার ব্যাটসম্যানের মোট রান ৩১। পেস স্পিনে মেশানো পাকিস্তানী বোলিং লাইনআপ এর বিপক্ষে বাংলাদেশ ব্যাটিং লাইন আপ যখন ভেঙে যাচ্ছে, যাওয়া আসার মিছিলে তখন ছয় নম্বরে নামা মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ এপাশে ঠায় দাঁড়িয়ে আছেন। আস্তে আস্তে সিংগেল নিচ্ছেন, লুজ বলে বাউন্ডারি মারছেন, সাবধানী শটে দলের রান বাড়ানোর প্রয়াস দেখাচ্ছেন। সে ইনিংস দেখতে ভাল লাগে না, ৭৪ বলে ৫৮ রানের সে ইনিংস চোখের তৃষ্ণা মেটায় না; মেটায় কেবল দলের প্রয়োজন!
সে বছর আর কোন ম্যাচে ৪০ পেরুনো গেল না! তবে দলের প্রয়োজনে তিনি ছোটখাট ইনিংস খেলেছেন। ধীরে ধীরে রান করেছেন, কখনও হাঁকিয়েছেন বাউন্ডারি। তারপর চলে গেছেন পর্দার আড়ালে!
শুরুটা হয়েছিল এভাবেই। সাকিব, তামিম, আশরাফুল, মাশরাফির সে দলে ৬ -৭ নম্বরে ব্যাটিংয়ে নামা একজন মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ শুরুর থেকেই পর্দার আড়ালের নায়ক।
রিয়াদ থাকবেন নিদাহাসের সেই ছক্কায়,
রিয়াদ থাকবেন কার্ডিফের আঙিনায়,
রিয়াদ থাকবেন পঞ্চপান্ডব পাতায়,
রিয়াদ থাকবেন বিপদের ত্রাণকর্তায়!
একজন মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ এদেশের ক্রিকেটে তেমনই এক ঋষি।
সারাবছর পাদপ্রদীপে থাকার সৌভাগ্য তার নেই। বিরাট বিরাট সমর্থকগোষ্ঠী থেকে তার গেট টুগেদার হয় না, ‘সকল কাজই ঠিক’ বলা ইয়ান-বিয়ান তিনি পাননি । তবু বিপদের সময়ে ধ্যান ভেঙে সবার আগে এগিয়ে গেছেন মাহমুদুল্লাহ। কখনও পেরেছেন, কখনও বা পারেননি। যখন পেরেছেন আমরা তাকে মাথায় তুলে নেচেছি, যখন পারেননি মাথা থেকে নামিয়েই ক্ষ্যান্ত হইনি, ছুঁড়েও ফেলেছি।
শুধুই দলের প্রয়োজনে ব্যাটিং বিপর্যয়ে নয়। মাহমুদুল্লাহ রিয়াদের ডাক পড়ে যেকোন বিপদে। তিনি হাসিমুখে এগিয়ে আসেন। কোন অভিযোগ করেননা।
২০১৫ সালে টপ অর্ডারে ৪ নম্বরে একজন ব্যাটসম্যান সেট করার প্রয়োজন হল। শুরুর থেকেই লোয়ার অর্ডারে খেলতে নামা মাহমুদুল্লাহ রিয়াদকে নামিয়েও দেওয়া হল। ২০১৪ তে পুরো দলের খারাপ পারফর্ম্যান্সের পর সবচেয়ে বেশি ঝড়টা গেছিল মাহমুদুল্লাহ আর তামিমের ওপর দিয়ে। সেই রিয়াদকে চারে খেলানো নিয়ে কত তাচ্ছিল্যই না শুনেছি। অথচ ত্রাতা সবসময়ই তিনি। সাকিব আর তখন অধারাবাহিক তামিমের দলে একমাত্র ডিপেন্ডেবল ছিলেন মুশফিক। কিন্তু একা তিনি কি আর ম্যাচ জেতাবেন? এগিয়ে এলেন সেই রিয়াদ।
১৯৯৯ থেকে যা হয়নি, তামিম ইকবাল, জাভেদ ওমর, হাবিবুল বাশার, খালেদ মাহমুদ, শাহরিয়ার নাফিস, অলক কাপালি, আফতাব আহমেদ, মোহাম্মদ আশরাফুল, খালেদ মাসুদ রা পারেননি, বাঘের দেশে সেঞ্চুরিটা সেই মাহমুদুল্লাহ রিয়াদই এনেছিলেন প্রথম। শুধু তাই নয়; রোহিত শর্মা, মহেন্দ্র সিং ধোনি, গ্রায়েম স্মিথ, মাইক হাসি, বিরাট কোহলি, শিখর ধাওয়ান, ক্রিস গেইল, ব্রায়ান লারা রা যা পারেননি। বিশ্বকাপে পর পর দুই ম্যাচে ২ সেঞ্চুরি করে রিয়াদ তাই ই করে দেখালেন। তখন আর তিনি ‘কোটার প্লেয়ার ‘ নন, তখন তিনি কারো ‘ভায়রা ভাই’ নন। বহুরূপি বাংলাদেশ ক্রিকেটের সাপোর্টারদের কাছে তখন রিয়াদ কেবল এক রূপকথা!
টপ অর্ডার এখন শক্ত। তামিম ইকবাল ফর্মে ফিরেছেন। মিডল অর্ডারে সাকিব মুশফিক নিয়মিত রান পাচ্ছেন। কিন্তু লোয়ার অর্ডার টা ঠিক পোক্ত হচ্ছে না। ২০১৬ থেকে লোয়ার অর্ডারের সাব্বির, সৈকত, নাসিররা ঠিকমত কাজ দেখাতে পারছেন না। তলব তখন মাহমুদুল্লাহর।
বিশ্বকাপে টপ অর্ডারে টানা ২ ম্যাচে ২ সেঞ্চুরি করা মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ হাসিমুখে টপ অর্ডার ছেড়ে দিলেন। নেমে পড়লেন লোয়ার অর্ডার মেরামতে, যেভাবে করেছিলেন টপ অর্ডার। একজন মাহমুদুল্লাহর কখনও ব্যাক্তিস্বার্থের চিন্তা মাথায় আসেনি। বড় রান করার মোহ তিনি কখনও স্পর্শ করেননি, কখনও এসব নিয়ে অভিযোগ করেননি।
একজন রিয়াদ যেন গ্রামীণ বাড়ির বড় বৌটি। সকল বিপদ আপদে সামাল দেওয়া যার কাজ, অথচ নিজের সকল স্বাচ্ছন্দ্যের উর্ধ্বে ।
মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ ততদিনে বাংলাদেশ ক্রিকেটে পঞ্চপান্ডবের একজন। অভিষেকের ৯ বছর পর। বাংলাদেশ দলের শততম টেস্ট ম্যাচ। একটা দলের শততম টেস্ট ম্যাচ খেলা সব ক্রিকেটারেরই স্বপ্ন থাকে। আর তিনি যদি হন দলের ‘লিডারশিপ গ্রুপ’, ‘নিউক্লিয়াস’ এর কেউ, তবে তো কথাই নেই। সেই মাহমুদুল্লাহকে শততম টেস্টে নেওয়াই হল না! তবুও তিনি নিশ্চুপ।
ডার্ক নাইটেরা কখনও অভিযোগ করেননা, এ অভ্যাস তাদের ছোঁয় না । এ নিয়ে ডালপালা মেলতে পারত, যদি মাহমুদুল্লাহ মিডিয়ার আগুনে বারুদ ছিটিয়ে দিতেন। কিন্তু তিনি তা করেননি, একটি প্রশ্ন অব্দি তোলেননি ।
বরং এরপরও যখন ডাক পড়েছে, নিজ গুণে খাদ থেকে টেনে তুলেছেন দলকে। এই যেমন সে বছরই চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে। ট্রেন্ট বোল্ট, টিম সাউদি, অ্যাডাম মিলনে র পেস আর সুইংয়ে যখন ২৩ রানেই টপ অর্ডারের চার ব্যাটসম্যান প্যাভিলিয়নে , সেদিন সাকিব আল হাসানের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়ে গেলেন মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ। দুর্দান্ত সেঞ্চুরি দিয়ে দলকে ম্যাচ জেতালেন,তুলে দিলেন দলকে সেমি-ফাইনালে। এই কিছুদিন আগেই যাকে দেশের ‘শততম টেস্ট’ ম্যাচ খেলতে দেওয়া হয়নি।
তবে সে ম্যাচেও রিয়াদ রইলেন পর্দার আড়ালেই। ম্যান অফ দ্যা ম্যাচ অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসান। সেঞ্চুরি তো সাকিবও করেছেন, বোলিং ও করেছেন রান আটকে!
এভাবেই মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ দলকে টেনে তুলেছেন কোন ম্যাচসেরার স্বীকৃতি ছাড়াই। দলের অন্য কারো পারফর্মেন্স হয়ত আড়াল করে দিয়েছে, অথচ ‘ক্যাটালিস্ট’ এর মত, মাহমুদুল্লাহ রিয়াদকে ছাড়াও দলের চলত না!
তবে স্বীকৃতিও তিনি কিছু সময়ে পেয়েছেন। এই যেমন গত বছরের সেপ্টেম্বরের ২৩ তারিখ। পুরো টুর্নামেন্টে আহামরি কিছু করতে পারেননি বলে নিন্দা শুনেছেন প্রচুর। সেদিন ছিল আমাদের জন্যে ‘ডু অর ডাই’ ম্যাচ।
আবু ধাবির শেখ জায়েদ স্টেডিয়ামের স্লো পিচের সাথে রশিদ খানের স্পিন, সবচেয়ে বড় ভয়টা আকড়ে ছিল মনে! রশিদের স্পিন জুজু যেন দেরাদুন থেকে উড়ে এসেছে আবু ধাবিতে। তবে সেদিন যদি না পারা যায়, দীর্ঘ সময় থেকে চলে আসা পরিকল্পনা মার খেয়ে যাবে। দেশের ক্রিকেট পিছিয়ে যাবে কয়েক বছর।
সেদিন দলে ছিল না তামিম ইকবাল, পুরো টুর্নামেন্টে দ্যুতি ছড়ানো মুশফিকও ভুল বোঝাবুঝিতে রান আউট, কঠিন ইঞ্জুরি বয়ে দাঁতে দাঁত চেপে খেলতে নামা সাকিব আল হাসানও ফেরত যান শূন্য রানে, সামিউল্লাহ শেনওয়ারির থ্রোতে!
এমন দিনে রিয়াদ কিভাবে বসে থাকতে পারেন। ইমরুল কায়েসকে সঙ্গে নিয়ে নেমে গেলেন, প্রাণপণে লড়লেন। সিঙ্গেল ডাবলস নিয়ে আস্তে আস্তে ইনিংস গড়ে তুলছেন। তখন কত না সমালোচনা তাকে নিয়ে। এখনকার ওয়ানডেতে এমন শুধুই সিঙ্গেল ডাবলস চলে নাকি?
অথচ সেই রিয়াদের ব্যাটই শেষ দিকে তরবারি হয়ে উঠল, আফতাব আলমের বলে রশিদ খানের তালুবন্দি হবার আগে খেলে ফেলেছেন ৮১ বলে ৭৪ রানের মহাকাব্যিক ইনিংস। সে ইনিংসের গুরুত্ব লিখে বোঝানো সম্ভব না । বলা বাহুল্য, গিরগিটির মত রঙ বদলানো সেই সমর্থকেরা ঘন্টা পেরুতেই রিয়াদকে মাথায় তুলে ফেলল!
একজন মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ এভাবেই সবসময় পাশে থেকেছেন। আমার মনে হয়, রবার্ট ব্রুসের হাতে একজন মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ থাকলে যুদ্ধ আর সপ্তম বারে যেত না। একজন মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ থাকলে গোলিয়াথকে মারতে আর ডেভিডকে লাগত না! সত্যি বলতে একজন মাহমুদুল্লাহ রিয়াদকে ধরা যায় না, ছোঁয়া যায় না, শুধুই কুর্নিশ করা যায়।
আজ থেকে ষাট বছর পর শুধুই রান সংখ্যার বিবেচনায় রিয়াদ উপাখ্যান হয়ত সেদিন ঠিক বুঝে ওঠা যাবে না। তবে গুরুত্বপূর্ণ সব ম্যাচের স্কোরকার্ড এর দিকে তাকালে যখনই টপ অর্ডারের সবার নামের পাশে এক অঙ্ক মিলবে, সেদিন লোয়ার অর্ডারে একজনের নামের পাশে অন্তত রানের দেখা মিলবে, তিনি মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ।
মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ থাকবেন আজীবন। মহাগুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে নিদাহাস ট্রফির শ্রীলঙ্কার সাথে শেষ ওভারে মারা ছক্কা যেভাবে হাওয়ায় ভেসেছিল, সেভাবে আমরা আজীবনই রিয়াদ উপাখ্যানে ভেসে থাকব। রিয়াদ থাকবেন নিদাহাসের সেই ছক্কায়,রিয়াদ থাকবেন কার্ডিফের আঙিনায়, রিয়াদ থাকবেন পঞ্চপান্ডব পাতায়, রিয়াদ থাকবেন বিপদের ত্রাণকর্তায়!