ইয়োহান ক্রুইফ আজীবন নিজের বাড়ি মনে করে এসেছেন আয়াক্স অ্যামস্টারডামকে। ফুটবল ক্যারিয়ারের শুরু হয়েছিল তাদের হাত ধরে। তাঁদের হাত ধরে শুরু করেছেন নেদারল্যান্ড জয়, সেখান থেকে পুরো ইউরোপ। আস্তে আস্তে বড় হতে হতে একদিন ছোটবেলার ঘর ছাড়তে হয়, উচ্চশিক্ষার জন্য ঘর ছেড়ে পাড়ি দিতে হয় বাইরে। ক্রুইফও দিয়েছিলেন, আয়াক্স ছেটে ধরেছিলেন বার্সার পথ। বার্সাকেও জিতিয়েছেন, বার্সাকে করেছেন নিজের দ্বিতীয় ঘরে। বার্সা জয় করে যখন আবার ঘরে ফিরলেন, ঘরের ছেলেকে ঘরে আপন করে নিয়েছিল আয়াক্স। কিন্তু এ গল্পের সূচনা ঘরের ছেলে পর হওয়া থেকে।
ইয়োহান ক্রুইফ স্পেন-আমেরিকা ঘুরে আবার নিজের জন্মভূমিতে ফিরেছিলেন ৩৪ বছর বয়সে। আয়াক্সও তাকে সাদরে বরণ করে নিয়েছিল। দিয়েছিল দুই বছরের চুক্তি। ক্রুইফের ভাবনাও ছিল সে রকমই, নিজের মাটিতে নিজের ক্যারিয়ারের ইতি টানবেন আনন্দের সাথে।
সময়টা ১৯৮৩, আস্তে আস্তে শিরোপার দিকে এগুচ্ছে আয়াক্স। বলতে গেলে এক প্রকার শিরোপা তুলে ধরা নিশ্চিতই তাদের। এমন সময় ক্রুইফ আবিষ্কার করলেন, আয়াক্স বোর্ডের মাথায় তাকে বিদায় দেওয়ার ভাবনা। সত্যি বলতে এমনটাই ভাবনা ছিল সকলের। ভাবনা অমূলক নয়। মাঠে থেকেও মাঠের তারকা থেকে কোচের ভূমিকায় চলে যেতেন তিনি। কাগজে-কলমে কোচ না হলেও সকলে জানত মাঠের খেলোয়ারদের তিনিই সামলান। সদ্য টিনএজে পা দেওয়া মার্কো ভ্যান বাস্তেনের মতে, ‘ক্রুইফ ছিল আমাদের সবার ছোটবেলার গুরু। কিন্তু মাঠে তাকে পাশে পেয়ে আমরা যেন সত্যিকারের শিষ্য হয়ে উঠেছিলাম তাঁর।’
কিন্তু ক্রুইফ তার ক্যারিয়ারের ইতি এখানেই টানতে চাননি। গত দুই মৌসুমের ফর্ম তাকে যেন বলছিল, ‘খেলাটা চালিয়ে যাও বাছা’। ক্রুইফও নিজের মনের কথাই শুনলেন। কিন্তু বেঁকে বসলো আয়াক্স বোর্ড, ‘হতে পারেন ক্রুইফ আমাদের লিজেন্ড। কিন্তু সব তারকারই একটা বয়স থাকে, সে বয়সের পর তাদের নেমে যেতে হয়। ক্রুইফেরও তেমনটা হয়েছে।’ এমনটাই ছিল তাদের ভাবনা। ফলে ৩৬ বছর বয়সী ক্রুইফ আবদার করা সত্ত্বেও এক মৌসুমের জন্য তার চুক্তি বৃদ্ধি করল না আয়াক্স। তাদের মতে, এই বয়সে ক্রুইফকে এত খরচ করে রাখা হবে বোকামি। বরং প্রস্তাব দিল জাঁকজমক করে তাঁকে বিদায় দেওয়ার।
খেলতে চাওয়া একটা মানুষকে জোর করে অবসরে পাঠানো কী এতটাই সোজা? তাও আবার লোকটার নাম যখন ইয়োহান ক্রুইফ? ক্রুইফ সোজা বেঁকে বসলেন। এক্ষুণি অবসরে যাচ্ছেন না তিনি। বরং তিনি অপেক্ষা করবেন শেষদিন পর্যন্ত। শেষদিনে এসেও যখন আয়াক্স তার টেবিলে এনে প্রস্তাব রাখলো না, গল্পের টুইস্ট শুরু হলো এখান থেকেই।
আগেই বলেছি আয়াক্স ছিল তার ঘর। আয়াক্সে কাটিয়েছেন জীবনের ২০টা বছর। বাবার মৃত্যুর পর আয়াক্সই হয়েছিল তার ধ্যান-জ্ঞান। কিন্তু সেই আয়াক্সই কী না তাঁকে এভাবে বিদায় জানাচ্ছে? রাগ আর নিজের মধ্যে সামলে রাখতে পারলেন না ক্রুইফ। চুক্তি শেষ হওয়ার পরের দিনই খবর এল, নতুন দলের হয়ে সাইন করেছেন ইয়োহান ক্রুইফ। সেই দল আর কোনো দল নয়, আয়াক্সের চিরপ্রতীন্দ্বন্দ্বী ফেয়েনুর্দ। শুরু হলো ক্রুইফের প্রতিশোধ পর্ব।
প্রথমত ক্রুইফকে ফেয়েনুর্দে দেখে পুরো নেদারল্যান্ডবাসী হতভম্ব হয়ে গিয়েছিল। ঘরের ছেলে এভাবে ঘর ছেড়ে অন্য দলে যোগ দিতেই পারে, কিন্তু একেবারে রাইভাল দলে? এমনটা ভাবনাতেও আসেনি তাদের। রাগে অন্ধ হয়ে এমনটাই করেছিলেন ক্রুইফ। জ্যাক ট্রুস্ট ছিলেন ফেয়েনুর্দের ‘ওয়ান ক্লাব ম্যান’। ক্রুইফের ছায়ায় থেকে পরবর্তীতে নেদারল্যান্ড সেরা হওয়া ট্রুস্টের ভাষ্যমতে, কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গিয়েছিল ফেয়েনুর্দের খেলোয়াড়েরাও। ট্রুস্টের ভাষায়, ‘তাঁর ফেয়েনুর্দে আসার একটাই কারণ ছিল, আয়াক্স বোর্ডকে দেখিয়ে দেওয়া। যে তিনি এখনও তাঁর সেরা সময়ে আছেন। ১০ বছর ইরিদিভিস না জেতা ক্লাবকে একমাত্র তিনিই জেতাতে পারেন।’
সত্যি বলতে ৩৭- এ পা দিতে যাওয়া ক্রুইফের কাছ থেকে বেশি কিছু আশাও করেনি ফেয়েনুর্দ। কিন্তু মেডিকেল শেষ হতেই বোঝা গেল, এই দলের অধিকাংশ খেলোয়াড়ের থেকে তার ফিটনেস বহুগুণে এগিয়ে। একদম শুরু থেকেও স্পষ্ট ছিল, ক্রুইফ হেলাফেলা করতে আসেননি। যে চ্যালেঞ্জ নিতে এসেছেন, তা পূরণ করে দেখাবেনই। মৌসুম শুরুর আগের ছুটি কাটিয়েছেন সতীর্থদের সাথে টেনিস খেলে, প্রি-সিজনে দলকে নিয়ে প্রতিদিন দৌঁড়েছেন ৬ কিলোমিটার। নিজের স্বভাবত কোচিং স্বত্বা এখানেও ফলাতে শুরু করেছিলেন। কথায় আছে না, ‘প্রতিভা কখনো চাপা থাকে না।’ বয়সের সাথে সাথে ক্রুইফের কোচিং প্রতিভা থিকরে বের হচ্ছিল। আশেপাশের ইয়াংস্টাররাও তাঁকে দেখে যেন নিজেদের বদলাতে শুরু করল। নিজের লিগ জয়ের মিশন ছড়িয়ে দিলেন সকলের মধ্যে।
কিন্তু উদ্দীপনা দিয়েই তো আর শিরোপা জেতা সম্ভব নয়। বরং নিজের আইডিয়াগুলোই খাটাতে শুরু করলেন ফেয়েনুর্দের জার্সিতে। কিন্তু আয়াক্স আর ক্রুইফ ছিল হরিহর আত্মা। আয়াক্সের ইয়াংস্টার কোম্যান-ভ্যান বাস্তেনদের মধ্যে যে বীজ গড়ে দিয়ে এসেছিলেন, তা এতদিনে চারা হয়ে গিয়েছে। অন্যদিকে, ফেয়েনুর্দের খেলোয়াড়দের মধ্যে এখনো বীজ বপনই শেষ করতে পারেননি ক্রুইফ। এর মধ্যেই দরজায় কড়া নাড়তে শুরু করল ক্লাসিকো।
১৮ সেপ্টেম্বর, ১৯৮৩; আয়াক্স বনাম ফেয়েনুর্দ। প্রথমবারের মত রাইভালের জার্সি গায়ে আয়াক্সের বিপক্ষে নামছেন ক্রুইফ। শুধু ক্রুইফ বললে ভুল হবে, প্রতিশোধের আগুনে জ্বলজ্বল করতে থাকা ক্রুইফ। ফলাফল? আয়াক্স ৮-২ ফেয়েনুর্দ!
ক্রুইফের তৈরি করে আসা আয়াক্সের কাছে কোনো পাত্তাই পায়নি ফেয়েনুর্দ। প্রথমেই ২ গোল হজম করে পিছিয়ে গিয়েছিল ফেয়েনুর্দ। ২ গোল দিয়ে সমতাও এনেছিল তারা। কিন্তু এরপর থেকে শুরু হওয়া ধ্বংসযজ্ঞে তাল মেলাতে পারেননি ক্রুইফের নতুন সতীর্থরা। আয়াক্স বোর্ডের মুখে তাচ্ছিল্যের হাসি। তাদের মনে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার গর্ব। ক্রুইফের হাতে গড়া ভ্যান বাস্তেন করেছিলেন হ্যাটট্রিক। আয়াক্স যেন ক্রুইফকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছিল, তারা মুভ অন করে ফেলেছে। ক্রুইফই একমাত্র যে এখনও প্রতিশোধের নেশায় উন্মত্ত।
‘ম্যাচ শেষে ক্রুইফ কী করেছিলেন? আমাদের এসে বলেছিলেন, ১-০ হোক আর ৮-২ হোক; হারিয়েছি ঐ ৩ পয়েন্টই। পেছনে তাকিয়ে থাকা অর্থহীন।’ ট্রুস্টের ভাষ্যমতে ওটুকুই যথেষ্ট ছিল। ক্রুইফ তাঁদের মৌসুমে সবচেয়ে বাজে ম্যাচ থেকে সবচেয়ে ভালো গিফট পেয়েছিলেন। নাম তার রুদ গুলিত।
সামনে পিটার হুটম্যানকে রেখে পেছনে রুদ গুলিতকে নিয়ে এক জুটি গড়েন ক্রুইফ। আয়াক্সে ভ্যান বাস্তেনকে নিয়ে যে ত্রাস গড়েছিলেন, ঠিক তার নতুন রূপ তৈরি করলেন এখানে। এবার শুধু সতীর্থ আরেক তরুণ তারকা, রুদ গুলিত। পরের ১৪ ম্যাচে ৪১ গোলের বিনিময়ে হজম করেছিলেন মাত্র ৮ গোল। ও হ্যাঁ, এই ১৪ ম্যাচ কিন্তু ছিলেন অপরাজিত। পরের ডার্বি আসতে না আসতেই পুরো পাশার দান উল্টে দিয়েছিলেন ক্রুইফ। এবার রোটারডামে আয়াক্স মুখোমুখি এক নতুন ফেয়েনুর্দের। এই দলে বপন করা বীজ থেকে চারাগাছ হয়ে গিয়েছে ইতিমধ্যে। বাকি ছিল শুধু আয়াক্সের বুকে ছোঁড়া প্রবেশ করানোর।
২৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৮৪; ডে কাইপ, রোটারডাম। মুখোমুখি ফেয়েনুর্দ আয়াক্স আর সামনে ৫৮ হাজার দর্শক। ক্রুইফ দেখালেন তার অগ্নিমূর্তি। ১২ মিনিটের মাথায় প্রথম গোল বানিয়ে দিলেন গুলিতকে। ২ মিনিটের মাথায় নিজেই ছোঁড়া বসিয়ে দিলেন আয়াক্সের জালে। এটুকুতে থেমে থাকলে তো হতোই। হাফ টাইমের পর আন্দ্রে হোকস্ট্রা আর ম্যাচ শেষ হওয়ার মিনিট খানেক আগে হ্যাঙ্ক ডুট। পুরো এক হালি সম্পন্ন করে নিজেদের মাটি থেকে বিদায় দিল ফেয়েনুর্দ। আরো স্পষ্ট করে বললে ইয়োহান ক্রুইফ নিজে। যে ক্রুইফকে আর প্রয়োজন নেই ভেবে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন, যাকে হারতে দেখে তাচ্ছিল্যের হাসি হেসেছিলেন; সেই পরিচালকদের মুখের দিকে তাঁকানোর অবস্থা ছিল না কারো।
যে আয়াক্সকে ফেরত এসে নতুন করে গড়েছিলেন ক্রুইফ, সেই আয়াক্সকে চাইলেই যে তুড়ি দিয়ে উড়িয়ে দিতে পারেন সেটাই প্রমাণ করে দিয়েছিলেন সেদিন ডে কাইপে দাঁড়িয়ে।
সেদিনই নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল ফেয়েনুর্দের লিগ শিরোপা। এরপর ২৫ জয় আর মাত্র ২ টি হার নিয়ে ৫৭ পয়েন্ট নিয়ে লিগ শেষ করেছিল ফেয়েনুর্দ। আয়াক্সের থেকে ৬ পয়েন্ট এগিয়ে থেকে। শুধু তাই নয়, আয়াক্সকে ছিটকে ফেলে জিতেছিলেন নেদারল্যান্ডের লিগ কাপ ‘কেএনভিবি কাপ’।
ক্রুইফ যেমন ধুমকেতুর মত এসেছিলেন, ঠিক সেভাবেই হারিয়ে গিয়েছিলেন ফেয়েনুর্দের আকাশ থেকে। তিনি এসেছিলেন প্রতিশোধের নেশায়। প্রতিশোধ নিয়ে আবারও ফেরত গিয়েছেন নিজের পথে। অবসর ছেড়ে নাম লিখিয়েছেন কোচিংয়ে। মাঝে দিয়ে এক দশক ধরে শিরোপার ছোঁয়া না পাওয়া ফেয়েনুর্দকে দিয়ে গিয়েছিলেন শিরোপার ছোঁয়া। ফেয়েনুর্দকে দেখিয়ে গিয়েছিলেন নতুন এক পথ।
আয়াক্সে আবার ফিরেছিলেন ক্রুইফ। নীড় ছাড়া পাখি আবার নীড়ে ফিরেছিল। ১৯৮৭ সালে আয়াক্সকে আবারও ইউরোপ সেরা করিয়েছেন ডাগ-আউটে দাঁড়িয়ে। বার্সেলোনাকে দেখিয়েছেন নতুন পথ। ‘ক্রুইফ টার্ন’, আধুনিক বার্সার রূপকার, টিকিটাকার পিতার অন্য এক রূপ নেদারল্যান্ডবাসী দেখেছিল এক মৌসুমের জন্য।
প্রতিশোধের আগুনে জ্বলা হেনরিক ইয়োহান ক্রুইফ।