তোমার হাতে গড়া সে বাগান

ফুটবল ক্লাব বার্সেলোনার জন্যে সময়টা ভাল যাচ্ছে না। কোচ বদল, রিফর্মিং পিরিয়ড, সবকিছু মিলিয়ে আবারও একটা ট্রফিলেস মৌসুমের আশঙ্কা করছে কাতালানরা। এদিকে শেষ মৌসুমে ট্রেবল জিতেছে ইউরোপের জায়ান্ট এফসি বায়ার্ন মিউনিখ। বায়ার্নের সেই ট্রেবল জয়ে বার্সা একটু পেছন ফিরে যেতেই পারে, সুখস্মৃতি রোমন্থন করে হাতড়ে ফিরতে পারে সেই দিনগুলি যখন গার্দিওলা ছিলেন, লা মাসিয়ার তাঁরায় ভরা একাদশ ছিল – বার্সেলোনা ছিল ইউরোপের অপ্রতিরোধ্য, অন্য সব দলগুলির জন্যে অজেয়।

পেপ গার্দিওলার সেই বসন্ত বার্সার ক্যাম্প ন্যু তে ছিল মাত্র চার মৌসুম, এই চার বসন্তেই পেপ জিতিয়েছিলেন সেই আরাধ্য ট্রফি যা জেতার জন্যে হাহাকারের মত হাতড়ে ফিরছে মেসি অ্যান্ড কোং – উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগ! ২০০৮-২০০৯ মৌসুম যাকে বলে স্বর্ণাক্ষরে লিখে রাখার মত। মেসি-জাভি-ইনিয়েস্তা ত্রয়ী মিলে সে মৌসুমে বার্সাকে জিতিয়েছিলেন এক মৌসুমের সম্ভাব্য সব ট্রফি। এমন বসন্তের ছোঁয়া এরপর আর বার্সার শিবিরে  কোনদিন আসেনি।

তবে এই বসন্ত আসার আগের মৌসুমটাও কিন্তু বার্সার জন্যে ছিল লড়াই করার মৌসুম। ২০০৭-০৮ এর সেই সময়টায় বার্সার ডাগআউটে ছিলেন ফ্রাঙ্ক রাইকার্ড। নিজের দ্বিতীয় মৌসুমে তিনি বার্সায় শেষ করেছিলেন একেবারে কোন ধরণের ট্রফি ছাড়াই, অথচ এই মৌসুমের কয়েক মৌসুম আগেই ২০০৫-০৬ এ বার্সা জিতেছিল ইউরোপের বহু আরাধ্য সেই ট্রফিটা- চ্যাম্পিয়ন্স লিগ।

ফ্রাঙ্ক রাইকার্ডের সেই ট্রফিলেস মৌসুমের পরই বার্সা রূপকথায় আগমণ পেপ গার্দিওলার। নিজে তখন ছিলেন বার্সা বি দলের ম্যানেজার, সাথে গার্দিওলার ভান্ডারে বড় কোন প্রথম সারির দল সামলানোর অভিজ্ঞতাও ছিল না। তাই হুয়ান লাপোর্তার বার্সা যখন পেপকে নিয়োগ দিল, খুব বেশি আশা মনে হয় কেউ করেনি।

পেপ গার্দিওলা তো বার্সেলোনায় আসলেন, সাথে নিয়ে এলেন লা মাসিয়ার জেরার্ড পিকে, সার্জি বুসকেটসসহ তরুণ কিছু প্রতিভা। লা মাসিয়ার খেলোয়াড় মূল দলে আসা তখন খুব বেশি চমকের ব্যাপার নয়, পেপের এই ‘লা মাসিয়া প্রমোশন’কে তাই চমক বলার উপায় নেই। মূল চমক যেটা তিনি দিয়েছিলেন সেটাকেও ঠিক চমক না বলে সাহস বলাই ভাল। সেটা কী? মূল দলের দায়িত্ব নিয়েই তিনি ছাঁটাই করে দিলেন রোনালদিনহো, ডিকো দের মত তারকাদের। বি টিমের একজন ম্যানেজার মূল দলের দায়িত্ব নিয়ে দলের কিংবদন্তিদের বের করে দিচ্ছেন – পেপ গার্দিওলার ‘হ্যাডম’-এর প্রশংসা করতেই হয়।

তবে পেপের সাহস দেখানো সেই প্রজেক্ট শুরুতেই দিনের আলো দেখল না। মৌসুমের প্রথম ম্যাচে নতুন আসা নুমানসিয়া আর এরপর ঘরের মাঠে রেসিং স্যান্টানডারের মত ক্লাবের কাছে হার আবারও প্রশ্ন তুলে দিচ্ছিল- বার্সেলোনা কি এবারও আরেকটা বাজে মৌসুম দেখতে যাচ্ছে?

নাহ, বাজে মৌসুম তো দূরের কথা, শেষ অব্দি সেই মৌসুম বেশ ভালভাবেই শেষ করেছিল বার্সেলোনা। লা লিগাতে ১৯ জয় আর এক ড্র নিয়ে পুরো মৌসুমেই লিগের নিয়ন্ত্রণ ছিল ডাগ আউটে থাকা পেপ গার্দিওলার হাতে।

গার্দিওলার সেই বার্সেলোনার প্রতিটা খেলোয়াড়ের নির্দিষ্ট ভূমিকা ছিল। দানি আলভেস আর পিকে ব্যাকলাইনে দেয়াল তুলে দিতেন, সার্জি বুসকেটস মিডফিল্ডে দুর্দান্ত অ্যাংকর রোল ধরে রাখতেন, সাথে ফ্রন্ট লাইনে অ্যাটাকিং লিওনেল মেসি-স্যামুয়েল ইতো- থিয়েরি অঁরি ব্যাস্ত রাখতেন প্রতিপক্ষের ডিফেন্ডারদের। এতে করে যেটা হত দলের প্লেমেকাররা মাঠের মাঝে পর্যাপ্ত জায়গা পেতেন।

ফলাফল? দলের অ্যাটাকিং ত্রয়ী মিলেই সে মৌসুমে করেছিলেন ১০০ গোল আর পেপ গার্দিওলার সেই বার্সা লা লিগার প্রথম দল হিসেবে জিতে নিয়েছিল লা লিগা, কোপা দেল রে আর চ্যাম্পিয়ন্স লিগসহ মৌসুমের সম্ভাব্য সব কয়টা ট্রফিই।

একটা মৌসুমে যখন কোন দল ছয়টা ট্রফির সবকয়টা জিতে ফেলে, পরের মৌসুমেরও দলটার কাছে একটা চাওয়া তৈরি হয়। আর দুই মৌসুমের মাঝে পরিণয় ঘটানো যেকোন ম্যানেজারের জন্যেই একটু কঠিন। তবে গার্দিওলা তো কঠিনেরেই ভালোবাসেন। হেক্সা জয়ের মৌসুমের পরের মৌসুমে তিনি দল থেকে ইতোকে বিক্রি করে দিলেন, আনলেন জ্লাতান ইব্রাহিমোভিচকে। আর এবারও লা লিগাতে একক আধিপত্য বজায় থাকল বার্সেলোনার, ৯৯ পয়েন্ট পেয়ে লা লিগা তো জিতলেনই সাথে গার্দিওলা যুগে সবচাইতে বেশি পয়েন্ট পাওয়াটাও দেখে ফেলল ক্যাম্প ন্যু!

তবে লা লিগা জিতলেও চ্যাম্পিয়ন্স লিগে গিয়ে কিন্তু ঠিকই হোঁচট খেল বার্সেলোনা আর সেটা ঘর বিতাড়িত স্যামুয়েল ইতোর কাছেই। বার্সা থেকে যাওয়ার পর ইতোর ঠিকানা ছিল হোসে মরিনহোর ইন্টার মিলান। সেই ইন্টার মিলানের হয়েই সেমি ফাইনালে বার্সেলোনাকে বিদায় করে দিয়ে আরেকটা চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জয়ের স্বপ্ন ধূলিসাৎ করে দিলেন স্যামুয়েল ইতো!

চ্যাম্পিয়ন্স লিগ থেকে বিদায় নিয়েছেন সেমি ফাইনালে, লা লিগাতে টাইটেল জিতেছেন ইতিহাসগড়া পয়েন্ট নিয়ে , গার্দিওলার খুব বেশি অস্বস্তি হবার কারণ ছিল না। কিন্তু তবুও গার্দিউওলা সন্তুষ্ট হতে পারলেন না, যেমনটা পারলেন না দলে প্রতি মৌসুমে বড় পরিবর্তনের অভ্যাস থেকে নিজেকে বিরত রাখতে। তাই মাত্র এক মৌসুম পরই ইব্রাহিমোভিচকে বিক্রি করে দিলে, ঘরে আনলেন বিশ্বকাপ জেতা গোল্ডেন বুটজয়ী ডেভিড ভিয়াকে আর সাথে ‘দ্য ক্যাপ্টেন উইদাউট আর্মব্যান্ড’ খ্যাত হ্যাভিয়ের মাশচেরানো তো আসছেনই!

গার্দিওলার এই পরিবর্তন সে বছর দুর্দান্ত ফল দেখল। টানা তিন মৌসুম তিনি বার্সেলোনাকে লিগ টাইটেল জেতালেন, সাথে নিজের সময়ে দ্বিতীয়বারের মত ন্যু ক্যাম্পে নিয়ে এলেন চ্যাম্পিয়ন্স লিগের বহু আরাধ্য শিরোপাটাও। লিওনেল মেসির দুর্দান্ত পারফরম্যান্সে বার্সা সে মৌসুমে বাগিয়ে নিল ৯৬ পয়েন্ট!

টানা তিন মৌসুমের বসন্ত বিলাসের পর গার্দিওলার চতুর্থ মৌসুমটা মুদ্রার উল্টোপিঠ দেখে ফেলল। সে মৌসুমের অপ্রতিরোধ্য রিয়াল মাদ্রিদের বাগানো ১০০ পয়েন্টের সামনে বার্সেলোনা আর লিগ টাইটেল জিততে পারল না। লিগে দ্বিতীয় হওয়ার পর চ্যাম্পিয়ন্স লিগেও চেলসির কাছে ধরাশায়ী হয়ে পেপ গার্দিওলাকে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ থেকে বিদায় নিতে হল মাথা নিচু করেই। তবে লিগ টাইটেল আর চ্যাম্পিয়ন্স লিগে ব্যার্থ হবার পর সে মৌসুমেও কোপা দেল রে’র ট্রফিটা ঠিকই উঁচিয়ে ধরতে পেরেছিলেন পেপ গার্দিওলা।

তবে বাজে এই মৌসুমের চাইতেও বাজে খবর বার্সার জন্যে তখনও অপেক্ষা করছে।  পেপ গার্দিওলা দায়িত্ব ছেড়ে দিলেন। আর তা শুধু বার্সেলোনাই নয়, পুরোদস্তুর কোচিং থেকেই নির্বাসনে চলে গেলেন এক মৌসুমের জন্যে!

পেপ গার্দিওলার প্রস্থান বার্সেলোনাকে লিগ শিরোপা জেতা থেকে বিরত রাখতে পারেনি। এমনকি গার্দিওলার সেই ট্রেবল জয়ের রাতও বার্সাকে আরেকবার এনে দিয়েছিলেন লুইস এনরিকে, সেটাও নিজের প্রথম মৌসুমেই। তবুও গার্দিওলা চলে গেলেন, ন্যু ক্যাম্প থেকে কি যেন একটা নিয়ে গেলেন। দলটার ডাগআউটে এরপর আরো অনেক কোচ এসেছে, দলটা শিরোপাও জিতেছে, কিন্তু গার্দিওলার সেই দলটার মত আর কখনও ফুটবল খেলা দেখেনি ক্যাম্প ন্যু!

সেই দলটার মত আর কখনও চমকও দেখা হয়নি কাতালুনিয়ার!

লেখক পরিচিতি

আদ্যোপান্ত স্টোরিটেলার!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link