ক্রিকেটের শ্বশুরবাড়ি একাদশ

এক পরিবারে এক গাদা ক্রিকেটার থাকাটা নতুন কোনো ব্যাপার নয়। একই পরিবারের একাধিক সদস্য এক সাথে আন্তর্জাতিক ম্যাচও খেলেছেন। আবার কেউ কেউ বৈবাহিক সূত্রে কোনো ক্রিকেটীয় পরিবারের সাথে আত্মীয়তার সম্পর্ক গড়েছেন।

সেই খোঁজ করতে গিয়ে এমন অনেককেই পাওয়া গেল যারা বিখ্যাত কোনো সাবেক ক্রিকেটারের মেয়েকে বিয়ে করেছেন। তেমনই কয়েকজন শ্বশুর-জামাতা জুটি নিয়ে আমাদের এবারের আয়োজন। ওহ একজন শ্বাশুড়ি আছেন এদের মধ্যে, আবার একটা শ্বশুর-ছেলেবউ জুটিও আছে। এই শ্বশুরবাড়ির আত্মীয়স্বজন মানে, শ্বশুর/শ্বাশুড়ি-জামাই/ছেলেবউ নিয়ে দিব্যি একটা একাদশ বানিয়ে ফেলা যায়।

  • মোহাম্মদ ইলিয়াস ও ইমরান ফারহাত, কামরান আকমল (পাকিস্তান)

পাকিস্তানের এক কালের ওপেনার ইমরান ফারহাত ছিলেন স্টাইলিশ ব্যাটসম্যান। ১২ বছর জাতীয় দলে খেললেও বড় একটা সময় ছিলেন যাওয়া-আসার মধ্যে। সর্বশেষ খেলেছেন ২০১৩ সালে। তাঁর মতই অফ ফর্মের কারণে জাতীয় দল থেকে বাদ পড়েছিলেন উইকেটরক্ষক ব্যাটসম্যান কামরান আকমল। ২০১০ সালে সর্বশেষ খেলেন। আর তাঁর ফেরা হয়নি।

দু’জনের বিয়ে হয়েছে আরেক ক্রিকেটীয় পরিবারে। তাঁদের শ্বশুর হলেন সাবেক পাকিস্তানি ওপেনার মোহাম্মদ ইলিয়াস। তিনি ১৯৬৪ থেকে ১৯৬৯ সালের মধ্যে পাকিস্তানের হয়ে ১০ টি টেস্ট খেলেছেন। একটি সেঞ্চুরি ও দু’টি হাফ সেঞ্চুরি করেন।

মজার ব্যাপার হল, দুই ভায়রা ভাই মানে কামরান আর ইমরান পাকিস্তানের হয়ে এক সাথে খেলেছেনও। আরেকটা তথ্য এখানে না দিলেই নয় পরবর্তীকালে পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ডের (পিসিবি) নির্বাচকের দায়িত্ব পাওয়া ইলিয়াস তাঁর জীবনের শেষ টেস্টটা খেলেছেন ঢাকার মাঠে।

  • ইয়ান হিলি ও মিশেল স্টার্ক (অস্ট্রেলিয়া)

কাউকেই নতুন করে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার কিছু নেই। ইয়ান হিলি সর্বকালের অন্যতম সেরা উইকেটরক্ষক। অ্যাডাম গিলক্রিস্ট আসার আগ অবধি তিনিই অস্ট্রেলিয়ার উইকেটরক্ষকের কাজটা দক্ষ হাতে সামলে নিতেন।

তাঁর ভাতিজি এলিসা হিলিও উইকেটরক্ষক। সময়ের অন্যতম সেরা ফাস্ট বোলার মিশেল স্টার্কের হৃদয় গিয়ে জমা পড়ে হিলির গ্লাফসে। দু’জন বিয়ে করেন। ফলে ইয়ান হিলি এখন মিশেল স্টার্কের চাচা শ্বশুর।

এলিসা হিলি ও মিশেল স্টার্ক
  • আব্দুল কাদির ও উমর আকমল (পাকিস্তান)

সর্বকালের সেরা লেগ স্পিনার – এই প্রসঙ্গে পাকিস্তানের আব্দুল কাদিরের নাম আসবেই। স্বয়ং শেন ওয়ার্ন তাঁকে গুরু মানতেন। এই গ্রেটের মেয়ের সাথে বিয়ে হয় উমর আকমলের। আকমল যদিও, অনেক সম্ভাবনা নিয়ে এসেছিলেন আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে। তবে, ছন্নছাড়া জীবনের কারণে এখন তিনি হারিয়ে যাওয়ার পথে। উমরের শ্যালক, মানে কাদিরের ছেলে উসমান কাদিরও লেগ স্পিনার, পাকিস্তানের হয়ে অভিষেকও হয়ে গিয়েছে তাঁর।

মানে এই দাঁড়ালো যে, উমর আর কামরান – দুই ভাই-ই বিয়ে করেছেন সাবেক দুই টেস্ট ক্রিকেটারের মেয়েকে। এটাও তো একটা রেকর্ড!

  • মাধব মন্ত্রী ও গুন্ডাপ্পা বিশ্বনাথ (ভারত)

ভারতের প্রথম দিককার টেস্ট ক্রিকেটার হলেন মাধব মন্ত্রী হলেন স্বয়ং সুনীল গাভাস্কারের মামা। চার টেস্ট খেলা মন্ত্রী ছিলেন একাধারে উইকেটরক্ষক ও উদ্বোধনী ব্যাটসম্যান। সুনীলের বোন কবিতার বিয়ে হয়েছিল ভারতের মারকুটে ও নান্দনিক টেস্ট ব্যাটসম্যান গুন্ডাপ্পা বিশ্বনাথের সাথে। সেই হিসেবে মাধব মন্ত্রী হলেন বিশ্বনাথের মামাশ্বশুর।

  • মিকি স্টুয়ার্ট ও মার্ক বুচার (ইংল্যান্ড)
মার্ক বুচার ও অ্যালেক স্টুয়ার্ট

মিকি স্টুয়ার্ট ও অ্যালান বুচার – দু’জন এক সাথে সারেতে খেলেছেন। ইংল্যান্ডের জাতীয় দলের হয়েও খেলেছেন। তাঁদের ছেলে যথাক্রমে অ্যালেক স্টুয়ার্ট ও মার্ক বুচার ভাল বন্ধু। তাঁরা দু’জনও সারে হয়ে খেলেছেন ইংল্যান্ডের জাতীয় দলে। অ্যালেকের বোন মানে মিকির মেয়ে জুডির সাথে বিয়ে হয় মার্ক বুচারের। যদিও, বিবাহ বিচ্ছেদ হয়ে গেছে তাঁদের।

  • দীনেশ কার্তিক ও সুশান ইতিচেরিয়া (ভারত)

বলা হয়, মহেন্দ্র সিং ধোনি না থাকলে আরো লম্বা সময় ভারতীয় দলকে সার্ভিস দেওয়ার সুযোগ পেতেন দীনেশ কার্তিক। যদিও, ঘরোয়া ক্রিকেট বিশেষ করে ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগের (আইপিএল) সুবাদে তাঁর একালে বেশ নামডাক।

সে তুলনায় তাঁর শ্বাশুড়ি মানে সুশান ইতিচেরিয়ার নামটা একালের লোকেদের চেনার কথা না। ভারতীয় এই নারী ক্রিকেটার ১৯৭৬ থেকে ১৯৭৮ সালের মধ্যে ভারতের হয়ে সাতটি টেস্ট ও দু’টি ওয়ানডে খেলেন। তাঁর মেয়ে মানে দীনেশের স্ত্রী দিপীকা পাল্লিকাল ভারতের শীর্ষস্থানীয় স্কোয়াশ খেলোয়াড়।

  • ওয়াল্টার হ্যাডলি ও ক্যারেন হ্যাডলি (নিউজিল্যান্ড)
বাবা ওয়াল্টার হ্যাডলির সাথে রিচার্ড হ্যাডলি।

রিচার্ড হ্যাডলি – তাঁকে কে না চেনে? হ্যাডলির বাবা ওয়াল্টার হ্যাডলিও নিউজিল্যান্ডের বিখ্যাত ক্রিকেটার ছিলেন। টেস্ট খেলেছেন মাত্র ১১ টা – তবে নিউজিল্যান্ড ক্রিকেটে তাঁর অবদান বলে শেষ করা যাবে না। তাঁর তিন ছেলে ব্যারি, ডেল ও রিচার্ড – তিনজনই ছিলেন আন্তর্জাতিক ক্রিকেটার।

যখন রিচার্ড ও ক্যারেন এক সাথে ছিলেন

এর মধ্যে রিচার্ড হ্যাডলি হলেন নিউজিল্যান্ডের ইতিহাসের সর্বকালের সেরা ক্রিকেটার। ক্রিকেটের ইতিহাসে তিনি অন্যতম সেরা অলরাউন্ডার। হ্যাডলি রিচার্ডের বিয়ে হয়েছিল ক্যারেনের সাথে। ক্যারেন ১৯৭৮ সালে অনুষ্ঠিত নারী বিশ্বকাপে নিউজিল্যান্ডের হয়ে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে একটা ওয়ানডে খেলেছিলেন।

ক্যারেন-রিচার্ডের এখন ছাড়াছাড়ি হয়ে গেলেও এটা সত্যি যে কিছু সময়ের জন্য ওয়াল্টার ছিলেন ক্যারেনের শ্বশুর।

  • ববি সিম্পসন ও অ্যান্ড্রু হিলডিচ (অস্ট্রেলিয়া)
ববি সিম্পসন

দীর্ঘ চার দশক অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেটের স্মরণীয় এক চরিত্র ছিলেন ববি সিম্পসন। বলা হয়, স্যার ডন ব্র্যাডম্যান ও রিচি বেনোর পর অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেটে ৬২ টি টেস্ট ও দু’টি ওয়ানডে খেলা এই ভদ্রলোকের অবদানই সবচেয়ে বেশি। অলরাউন্ডার, অধিনায়ক, কোচ কিংবা ধারাভাষ্যকার নানা ভূমিকায় দেখা গেছে তাঁকে।

অ্যান্ড্রু হিলডিচ

তাঁর মেয়ে কিমের বিয়ে হয় অ্যান্ড্রু হিলডিচের সাথে। মেলবোর্নে ১৯৭৯ সালের ২৪ জানুয়ারি ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ওয়ানডে দিয়ে আন্তর্জাতিক অভিষেক হয় হিলডিচের। আর ববির আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের শেষ দিন হল ১৯৭৮ সালের তিন মেয়ে, ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে জ্যামাইকা টেস্টের পঞ্চম দিন। মানে, মাত্র ২৬৬ দিনের জন্য শ্বশুর-জামাই এক সাথে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলতে পারেননি।

হিলডিচের ক্যারিয়ার থামে ১৮ টি টেস্ট ও আটটি ওয়ানডেতে। পরে তিনি ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়ার (সিএ) নির্বাচক প্যানেলে ঠাঁই পান যার প্রধান ছিলেন স্বয়ং অ্যালান বোর্ডার।

  • শফিক উল হক হীরা ও ইশতিয়াক আহমেদ (বাংলাদেশ)

শফিক উল হক হীরা বাংলাদেশ জাতীয় দলের শুরুর দিককার অধিনায়কদের একজন। তাঁর নেতৃত্বে ১৯৭৯ ও ১৯৮২ – দুটি আইসিসি ট্রফি খেলে বাংলাদেশ দল। পূর্ব পাকিস্তানের হয়ে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট খেলা হীরা কখনো অবশ্য আন্তর্জাতিক খেলার সুযোগ পাননি।

সামিরা ও ইশতিয়াক

তাঁর মেয়ে সামিরা হকের বিয়ে হয় প্রয়াত চিত্র নায়ক সালমান শাহ’র সাথে। পরে তিনি আবারো বিয়ে করেন। যদিও, সেই বিয়ে দীর্ঘায়িত হয়নি। ২০২১ সালে সামিরা বিয়ে করেন সাবেক ক্রিকেটার ও ক্রিকেট ধারাভাষ্যকার ইশতিয়াক আহমেদকে। ইশতিয়াকও বাংলাদেশ জাতীয় দলে খেলেছেন, তবে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলার সুযোগ পাননি।

  • স্পেশাল মেনশন: গুলাম আহমেদ ও শোয়েব মালিক

এটা দেখে চমকে উঠতে পারেন। তবে, ব্যাপারটা আসলেই সত্যি। গুলাম আহমেদ ভারতের সাবেক অধিনায়ক। তার ভাগ্নে আসিফ ইকবাল আবার ছিলেন পাকিস্তানের অধিনায়ক। গুলামের ছেলে নিসার হলেন ভারতের খ্যাতনামা টেনিস তারকা সানিয়া মির্জার কাজিন। সানিয়ার বিয়ে আবার হয়েছে পাকিস্তানের সাবেক অধিনায়ক শোয়েব মালিকের সাথে। তাহলে মালিক আর গুলামের সম্পর্কটা কি দাঁড়ালো?

  • শ্বশুরবাড়ির একাদশ

এবার তাহলে একাদশটা কেমন দাঁড়াচ্ছে? চলুন দেখে নেই। সবাইকে স্থান দেওয়া না গেলেও মোটামুটি ভালই দাঁড়িয়েছে ব্যাপারটা।

টপ অর্ডার: ওপেনার থাকবেন ইমরান ফারহাত ও কামরান আকমল – দুই পাকিস্তানি দুই ভায়রা ভাই। তিনে নামবেন মার্ক বুচার। 

মিডল অর্ডার: চার নম্বরে গুন্ডাপ্পা বিশ্বনাথ। পাঁচে শোয়েব মালিক, স্পিনিং অলরাউন্ডার। ছয় নম্বরে ইয়ান হিলি। উইকেটরক্ষ-ব্যাটসম্যান হিসেবে এই একাদশে তাঁর বিকল্প নেই।

লোয়ার মিডল অর্ডার: ক্যারেন হ্যাডলি। পেস বোলিং অলরাউন্ডার – এখানে তাঁর বিকল্প দেখছি না।

লোয়ার অর্ডার: মিশেল স্টার্ক, গুলাম আহমেদ, আব্দুল কাদির। অধিনায়ক হিসেবে থাকবেন ডান হাতি অফ স্পিনার গুলাম আহমেদ। মিশেল স্টার্ক দলের মূল স্ট্রাইক বোলার, আব্দুল কাদির দেখাবেন লেগ স্পিনের ভেলকি।

স্ট্যান্ড বাই: উমর আকমল ও দীনেশ কার্তিক।

কোচ: অবশ্যই ববি সিম্পসন। ১৯৮৭ সালে তাঁর অধীনেই প্রথমবারের মত বিশ্বকাপ জিতে অস্ট্রেলিয়া দল। সহকারী কোচ হিসেবে থাকবেন সুজান ইতিচেরিয়া

টিম ম্যানেজার: মিকি স্টুয়ার্ট। ইংল্যান্ড দলের ম্যানেজার ছিলেন এক সময়। দল নিয়ে অ্যাশেজেও গিয়েছেন।

নির্বাচক: নির্বাচকদের প্যানেলটা এখানে বেশ ভারি ও দারুণ – ওয়াল্টার হ্যাডলি, অ্যান্ড্রু হিলডিচ, মোহাম্মদ ইলিয়াস ও মাধব মন্ত্রী। চার সদস্যের এই কমিটির প্রধান ওয়াল্টার হ্যাডলি।

 

লেখক পরিচিতি

সম্পাদক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link