তাহলে শেষ পর্যন্ত কি দাঁড়াল?
ডগলাস অ্যাডামসের বিখ্যাত সিরিজ ‘The Hitchhiker’s Guide to the Galaxy’ র মতে আমাদের জীবনের চরম প্রশ্নের উত্তর হচ্ছে ‘৪২’। এই উত্তরটি বের করতে পৃথিবীর (নাকি ব্রহ্মাণ্ডের?) সবচেয়ে শক্তিশালী কম্পিউটারের ৭৫ লক্ষ বছর সময় লেগেছিল। কিন্তু ততদিনে কারও আর এটা মনে নেই যে চরম প্রশ্নটি কী ছিল।
সুতরাং উত্তর খোঁজার আগে প্রশ্নটি সম্বন্ধে আমাদের নি:সন্দেহ হতে হবে। চারজনের মধ্যে কে শ্রেষ্ঠ? – এটাই সম্ভবত আমাদের প্রশ্ন। কিন্তু কী দিক দিয়ে শ্রেষ্ঠ? প্রতিভা? তাহলে কপিল দেব আর ইয়ান বোথামের মধ্যে টস করতে হয়। পরিসংখ্যান এবং ধারাবাহিকতা? সেক্ষেত্রে ইমরান খান সাহেব।
আইসিসির টেস্ট ক্রম? এবার টস হবে বোথাম আর ইমরানের মধ্যে। সীমিত ওভারের ম্যাচও ধরতে চান? তাহলে কপিল আর ইমরানের মধ্যে যে কোন একজনকে বেছে নিতে হবে আমাদের। উইজডেনের তালিকা বা বিশ্বসেরা টিমের বিরুদ্ধে পারফরম্যান্স? এখানে কপিল দেব এগিয়ে। ক্যাপ্টেনশিপও ধরতে হবে? এবার ইমরান এগিয়ে যাবেন।
আপনি হয়ত সোবার্স বা ক্যালিস পন্থী – একটা ক্ষেত্রে বিশ্বসেরা হতে হবে, অন্য ক্ষেত্রে মোটামুটি কাজ চালানো গোছের হলেই চলবে? তাহলে রিচার্ড হ্যাডলি হচ্ছেন আপনার লোক। বিশ্বকাপ ট্রফি দেখতে চান ক্যাবিনেটে? ইমরান বা কপিল। ‘স্যার’ উপাধি আপনার মতে বেশি গুরুত্বপূর্ণ? তাহলে অন্য দুইজনের মধ্যে থেকেই বাছতে হবে। ক্যারিয়ারের শেষ অবধি বিশ্ব সেরা? স্যার রিচার্ড হ্যাডলি। ক্যারিয়রের শুরুতে বিস্ফোরণ? স্যার ইয়ান বথাম। সবচেয়ে শক্তিশালী দল তৈরি করে গেছেন? ইমরান খান। টি ২০ ক্রিকেটের পক্ষে সবচেয়ে মানানসই ক্রিকেটার? সেরা ফিল্ডার? কপিলদেব।
সবকিছু ঘেঁটে গেল? ধন্যবাদ! সেটাই উদ্দেশ্য ছিল।
লেখকের বক্তব্য এটাই যে চারজনের মধ্যে কে শ্রেষ্ঠ তার উত্তর আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির ওপর নির্ভর করছে। বিভিন্ন ক্রাইটেরিয়া ধরলে আলাদা আলাদা উত্তর বেরোবে। সুতরাং এক্ষেত্রেও উত্তর ‘৪২’ হবে ধরে নিয়ে এগোনো যাক।
একই যুগে চারজন দুরন্ত অলরাউণ্ডারের আবির্ভাব যথেষ্ট আশ্চর্যের। কিন্তু এই লড়াইটা চারের জায়গায় পাঁচ জনের মধ্যে হত যদি দক্ষিন আফ্রিকাও এই সময় টেস্ট ক্রিকেট খেলার সুযোগ পেত। সেক্ষেত্রে এই চারজনের সঙ্গে আমরা দেখতে পেতাম ক্লাইভ রাইসও কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করছেন।
রিচার্ড হ্যাডলির সঙ্গে রাইস কাউন্টি ক্রিকেটে একের পর এক উচ্চমানের পারফর্মেন্স দিয়ে গেছেন নটিংহ্যামশায়ারের হয়ে। সেই যুগে সম্ভবত সিঙ্গাপুরে অলরাউন্ডারের একটা টুর্নামেন্ট হত, সেটাতেও বেশি বিখ্যাত প্রতিদ্বন্দ্বীদের টপকে সবচেয়ে বেশিবার জয়লাভ করেছেন রাইসই।
আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে যদি মহাভারতের যুদ্ধের সঙ্গে তুলনা করা হয় যেখানে মহারথীরা নিজের নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমানের জন্যে নিজের নৈপুণ্য তুলে ধরছেন, সেক্ষেত্রে ক্লাইভ রাইসকে একলব্যের ভূমিকায় চিন্তা করা যেতে পারে – যিনি নিজের কোন দোষ ছাড়াই সর্বশ্রেষ্ঠ যোদ্ধার পরীক্ষায় নিজেকে প্রমান করার সুযোগ পেলেন না।
আর ক্লাইভ রাইসেরও বেশ কিছু আগে দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে আরও এক বিশ্বমানের অলরাউণ্ডার, মাইক প্রোক্টরকে, উঠে এসেছিলেন। প্রোক্টরও খুব কমই টেস্ট ক্রিকেট খেলেছেন। তবে তার মধ্যেও মাইক প্রোক্টর, গ্রিম পোলক এবং ব্যারি রিচার্ডস মিলে পর পর দুই সিরিজে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে জয় এনে দিয়েছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকাকে। ব্যাবধান ছিল ৩-১ এবং ৪-০। এরা সবাই খেললে নিশ্চিত ভাবেই স্বর্ণযুগের জৌলুস আরও বাড়ত।
আজ আমরা কেউই খুব একটা ভালো নেই। বেশ কয়েকজন কাছের মানুষের উইকেট পড়ে গেছে, কয়েকজন এখনও লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন। আর যতজন না জীবন হারিয়েছেন, জীবিকা হারিয়েছেন তারও বহুগুণ বেশি মানুষ।
তবুও কতদিন আর রোগ, জীবিকা আর মৃত্যুর চিন্তা নিয়ে থাকা যায়? বা প্রাকৃতিক দুর্যোগের? আর সেইজন্যেই জীবনে ক্রিকেটের মতো অকিঞ্চিৎকর জিনিসেরও প্রয়োজনীয়তা আছে। যেমন আছে সঙ্গীত বা সাহিত্যের। নিছক বিনোদন নয়, আমাদের মানসিক ভারসাম্য রক্ষার জন্যেই আজ এগুলির প্রয়োজন আছে।
একদিক দিয়ে আমরাও সবাই অলরাউন্ডার হওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছি। জীবিকা উপার্জন, পরিবারের স্বাস্থ্য, কিছুটা একে অপরকে সাহায্য, অল্প আধ্যাত্মিকতা, নিজের রুচি অনুযায়ী বিনোদন – এইসব বিভিন্ন দিকগুলি ব্যাল্যান্স করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি সবাই।
সেই চেষ্টাও চলুক। আর তার মধ্যেই মাঝে মধ্যে একটু সময় বের করে ক্রিকেট নিয়ে আড্ডাও হোক। ভিভ না বিরাট? সোবার্স না লারা? শচীন না সানি? – এইসব ইস্যুতে আবার তুফান উঠুক চায়ের পেয়ালায়।