দেশের তৃতীয় জনপ্রিয় খেলা হিসেবে হকিকে ধরা হলেও এখন আর সে অবস্থায় নেই খেলাটি। টার্ফে অনিয়মিত বিভিন্ন লিগ আর টুর্নামেন্টের কারণে হারিয়েছে পুরনো জৌলুস। তিন বছর আগে সর্বশেষ প্রিমিয়ার লিগ মাঠে গড়ালেও এরপর থেকে একরাশ শুন্যতা বিরাজ করছে হকি অঙ্গনে। খেলোয়াড়দের কষ্ট আর হতাশা বোঝার মতো যেন কেউ নেই এদেশে?
এ অবস্থার মধ্যে হকি ফেডারেশনের নতুন সভাপতির সাথে প্রথম বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে ভাচুয়ালি। এই বৈঠকে স্থবির হয়ে থাকা প্রিমিয়ার লিগ নিয়ে সুখবের অপেক্ষা ছিলেন খেলোয়াড়রা। লকডাউনের কারণে সভাটি গেল সপ্তাহে অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল। এবার সেটি অনলাইন প্লাটফর্মে অনুষ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু প্রিমিয়ার লিগের দলবদল কিংবা লিগ শুরু নিয়ে কোন আলোচনাই হয়নি।
এতে অপেক্ষা আরো বাড়ল খেলোয়াড়দের। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছ থেকে পাওয়া এক কোটি টাকা অনুদানই এখন বড় স্বপ্ন খেলাটিতে। এই অর্থের উপর নির্ভর করেই প্রিমিয়ার লিগ আয়োজনের স্বপ্ন দেখছে ফেডারেশন। এই সভায় গুরুত্বপূর্ণ অনেক সিদ্বান্ত আসতে পারে বলে ফেডারেশনের বিভিন্ন সুত্র থেকে জানা গেলেও পরে কিছুই হয়নি।
করোনা কালীন এই সময়ে খেলোয়াড়রা দ্রুত দলবদল আর লিগের তারিখ ঘোষনার দাবী জানিয়েছেন।
পাশাপাশি লিগটা যেন বিদেশী খেলোয়াড়বিহীন হয় সেজন ফেডারেশনের কাছে দাবী জানিয়েছেন তারা। হকিতে দলবদল ও প্রিমিয়ার ডিভিশন লিগ নিয়ে অনিশ্চয়তা যেন কাটছেইনা। এতে চরম হতাশায় পড়েছেন খেলোয়াড়রা। এমনিতেই গত তিন বছরের বেশি সময় হতে চলল কোন লিগ মাঠে গড়ায়নি। দেশের একটি অন্যতম প্রধান খেলার যদি এই সময়টাতে কোন লিগ না হয় তাহলে সেই খেলার উন্নতি তো দূরের কথা পথচলাই হয়ে পড়ে অমসৃন।
প্রায় দেড় বছর হতে চলল নির্বাচিত কমিটি দায়িত্বভার গ্রহন করেছে। কিন্তু এখনো পর্যন্ত প্রিমিয়ার লিগ শুরুর আগের প্রক্রিয়া দলবদল নিয়ে কোন সুখবর দিতে পারেনি। আর সে কারণেই প্রিমিয়ার লিগে অংশগ্রহনকারী বেশ কয়েকটি ক্লাব বর্তমান নির্বাহী কমিটি ভেঙ্গে দিতে যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রীর বরাবর চিঠি দিয়েছে। এখানে আবাহনী-লিমিটেড-মোহামেডান লিমিটেড এক কাতারে এসে দাড়িয়েছে।
তবুও যেন সমস্যার আশু কোন সমাধান দেখছেন না হকি সংশ্লিষ্ট কেউ। তারওপর করোনা ভাইরাসের ক্রমাবনতি আরো বেশি শংকার মধ্যে ফেলে দিয়েছে খেলাটিকে। আলাদা ষ্টেডিয়াম থাকার পরও সেই সুবিধাকে কাজে লাগানো যাচ্ছেনা। টার্ফের চেয়ে টেবিলের খেলাই বেশি হয় হকিতে। সে কারণে বেকার হয়ে শত শত খেলায়াড়ের বোবা কান্না শোনার মতো যেন কেউ নেই।
এই অবস্থার সবচেয়ে বেশি ক্ষতির মুখে পড়া খেলোয়াড়দের কথা চিন্তা করেই ক্রীড়াবান্ধক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার তহবিল থেকে ১ কোটি টাকা অনুদান দেওয়া হয়েছে। গত ঈদ উল ফিতরের পর সেই অর্থ হাতে পেলেও এখনো লিগ শুরু কিংবা দলবদলের তারিখ সম্পর্কে কিছুই জানাতে পারেননি ফেডারেশনের কর্মকর্তারা।
অথচ এই একই সময়ে বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগ ফুটবলের (বিপিএল) পাশাপাশি শেষ হয়েছে ঢাকার সিনিয়র ডিভিশন ক্রিকেট লিগ (ডিপিএল)। খেলোয়াড়দের পাশাপাশি খেলার কথা বিবেচনা করেই এমন সিদ্বান্ত নেওয়া হয়েছে বলে দেশের প্রধান দুটি খেলার ফেডারেশনের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
কিন্তু হকিতে যেন বইছে উল্টো হাওয়া। এখানে খেলোয়াড়দের চেয়ে বেশি গুরুত্ব পায় কর্মকর্তারা। মাঠে খেলা না হলে যে ক্ষতি হবে খেলোয়াড়দের সেটি যেন বেলালুম ভুলে গেছেন তারা। এখন সে কারণেই খেলোয়াড়দের প্রশ্ন, কবে শুরু হবে দলবদল আর কবে দেওয়া হবে প্রিমিয়ার ডিভিশন হকি লিগ শুরুর তারিখ। রাসেল মাহমুদ জিমি, আশরাফুল ইসলাম, মাঈনুল ইসলাম কৌশিক, পুস্কর ক্ষিসা মিমো, অসীম গোপদের যে অপেক্ষার প্রহর আর শেষই হচ্ছেনা। কবে শেষ হবে সেই সময় বলতে পারছেন না কেউ।
হকি অন্ত:প্রাণ মানুষগুলো যেন একে একে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। ভারপ্রাপ্ত সাধারন সম্পাদক যেন ভারই সইতে পারছেন না। নয়তো লিগ নিয়ে কোন সুখবর তিনি দিতে পারতেন। ভারপ্রাপ্ত কাউকে দিয়ে ফেডারেশন যে চালানো যায়না, সেই কথাই চিঠিতে উল্লেখ করে নির্বাহী কমিটি ভেঙ্গে দেবার দাবী জানানো হয়েছে যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রীর কাছে। বাংলাদেশ হকি ফেডারেশনের (বাহফে) সর্বশেষ নির্বহী কমিটির সভাপতি বিমান বাহিনীর সদ্য বিদায়ী প্রধান নিজে উদ্যোগী হয়ে প্রধানমন্ত্রীর বারবরে আর্থিক সহায়তা চেয়ে আবেদন করেন।
ক্রীড়াবান্ধব হিসেবে প্রধানমন্ত্রী হকির সংগঠকদের নিরাশ না করে ১ কোটি টাকা অনুদান দিয়েছেন। এরপর যতটা চাঙ্গা হওয়ার কথা তার কিছুই হয়নি ফেডারেশনে। যদিও ক্রীড়াঙ্গনের অভিবাবক যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রীকে চিঠি দেবার বিষয়ে ক্লাবগুলোর মধ্যে চলছে মতানৈক্য। মূলত সার্ভিসেস দলগুলো আছে বলেই এখন পর্যন্ত খেলোয়াড়রা বেঁচে আছেন। নয়তো হকি খেলার মতো খেলোয়াড় খুজে পাওয়া যেত না।
একটি খেলার যদি তিন বছরের মধ্যে কোন লিগ না হয় তাহলে সেই খেলাটির বেঁচে থাকাই হয়ে পড়ে কষ্টকর বিষয়। সেখানে বছরে কয়েকটা জাতীয় দিবসে টুর্নামেন্ট আয়োজন করে খেলাটিকে বাচাঁনো সম্ভব নয়। খেলোয়াড়রা বারবারই বিষয়টি বোঝানোর চেষ্টা করেছেন। জাতীয় দলের নিয়মিত খেলোয়াড় পুস্কর ক্ষিসা মিমো গত এক যুগ ধরে দেশের শীষ্য পর্যায়ে হকি খেলছেন। কিন্তু তার যেন কষ্টের কোন শেষ নেই। গেল তিন বছর লিগ না হওয়া যেমন কিছুতেই মেনে নিতে পারছেন না।
হতাশ কন্ঠে মিমো বলেন, ‘হকিকে যদি দেশের তৃতীয় জনপ্রিয় খেলা বলা হয় তাহলে কেন এই অবহেলা। আমাদের তো সারাবছরের প্রধান আয় হয়ে থাকে প্রিমিয়ার লিগ খেলে। খেলাটিতে যত সমস্যাই থাকুক না কেন, সবাই আন্তরিক হলে কোন সমস্যাই আর সমস্যা হিসেবে থাকেনা। ভেদাভেদ বুলে আমাদের খেলোয়াড়দের কথা বিবেচনা করে দ্রুততম সময়ের মধ্যে দলবদল ও লিগ শুরুর তারিখ ঘোষনা করা হোক।’
হকি ফেডারেশন থেকে বারবার বলা হচ্ছে, প্রিমিয়ার লিগ মাঠে ফেরাতে বেশিরভাগ সময় বড় বাধা হয়ে দাড়ায় অর্থ। এখন যদি ১ কোটি টাকা দিয়েও লিগ মাঠে না গড়ানো যায় তাহলে তো সমস্যা সেই তিমিরেই থেকে গেল। এই অর্থ কিভাবে ক্লাবগুলোর মধ্যে বন্টন করা যায় সেই সিদ্বান্তও এখনো নিতে পারেনি ফেডারেশনের কর্মকর্তারা। আর অংশগ্রহনকারী দলগুলোর মধ্যে কিছুটা সমস্যা বিরাজ করছে।
এদিকে সর্বশেষ মৌসুমে প্রিমিয়ার লিগ না খেলা উষা ক্রীড়া চক্র কি প্রথম বিভাগে খেলবে, নাকি বাইলজ সংশোধন করে আবারো প্রিমিয়ারে খেলানো হবে সেই সিদ্বান্ত নেওয়া হয়নি। সবমিলিয়ে খেলোয়াড়দের কথা ভাববার মতো কর্মকর্তারা ফেডারেশনে খুব একটা নেই। থাকলে হয়তো নিজেদের মধ্যে ভেদাভেদ ভুলে দেশের হকি ও খেলোয়াড়দের কথা চিন্তা করে প্রিমিয়ার লিগ খেলার বিষয়ে এক প্লাটফর্মে দাড়াতে পারতেন।
হকিতে এখন নিজেদের মধ্যে ঐক্যটা বড় বেশি প্রয়োজন। নয়তো হকিকে বাচিঁয়ে রাখা বেশ দুঃসাধ্য ব্যপার হয়ে দাড়াবে। পাশাপাশি ক্লাবগুলো মধ্যে আস্থাহীনতা তৈরি হয়েছে সেটি কাটাতে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া যে সময়েল দাবীতে পরিণত হয়েছে। খেলাটির উন্নয়নে সবাইকে এক কাতারে এসে কাজ করতে হবে। তাহলেই খেলোয়াড়দের পাশাপাশি বাচঁবে বাংলাদেশের হকি।