সেদিন গুগলে ঘাটাঘাটি করছিলাম। হঠাৎ তাঁর নামটা সামনে চলে এল। নামটা আমার কাছে অপরিচিত নয়। ক্রিকেট সম্পর্কে অল্প কিছু যা জানি তাতে উনার নামটা শোনা অত্যন্ত স্বাভাবিক। কিন্তু যখনই উনার জন্ম তারিখটির দিকে চোখ পড়ল, আমি তো হতবাক। বিস্ময়ে লাফিয়ে ওঠার মত অবস্থা আমার।
হ্যাঁ, আমাদের দুজনের জন্ম একই দিনে। আমার জন্মের ঠিক ৫৫ বছর আগে ১৯৫১ সালের ২৯ জানুয়ারি অ্যান্টিগার আর্লিংস ভিলেজ এলাকায় জন্ম গ্রহণ করেন তিনি। আরে! ওনার নামটাই তো বলা হয়নি এতক্ষণ। নামটা দীর্ঘ,স্যার আন্ডারসন মন্টিগোমারি এভারটন রবার্টস।
ছোট করে বললে স্যার অ্যান্ডি রবার্টস। হ্যাঁ,সেই অ্যান্ডি রবার্টস যিনি জোয়েল গার্নার, মাইকেল হোল্ডিং আর কলিন ক্রফট এর সাথে মিলে গড়ে তুলেছিলেন ভয়ংকর সেই পেস কোয়াট্রেট। ব্যাটসম্যানদের জন্য সাক্ষাৎ যম ছিলেন তিনি। খ্যাত ছিলেন নীরব ঘাতক নামে। ৬ ফুট ২ ইঞ্চির দীর্ঘদেহি এই পেসার ছিলেন ওয়েস্ট ইন্ডিজের সবচেয়ে দ্রততম বোলার।
রবার্টসের প্রধান অস্ত্র ছিল পেস,বাউন্স আর অ্যাকুরেসি। ডানহাতি এই বোলার ছিলেন মূলত ইনসুইং বোলার। তবে ভালো আউটসুইংয়ারও করতে পারতেন তিনি। আর বাউন্সার ছিল রবার্টসের স্টক ডেলিভারি। তাঁর বাউন্সার ছিল দুই ধরনের। স্কিডি আর স্লোয়ার। স্লোয়ার বাউন্সারগুলো ব্যাটসম্যানদের লোভী করতো হুক শটের জন্য।
আর এভাবেই তাদের ফাঁদে ফেলতেন তিনি। অন্যদিকে, স্কিডি বাউন্সারগুলো ছিল এক একটা মরণাস্ত্র। অসামান্য গতির বলগুলো ছিল আনপ্লেয়েবল। ক্রিকেট ইতিহাসের অন্যতম ভয়ংকর ডেলিভারি হল এই স্কিডি বাউন্সার। আর রবার্টস এর বলে গতি কেমন ছিল সেটা শুধু একটা উদাহরণেই বোঝা যাবে। রবার্টসের বলের সময় যখন গর্ডন গ্রিনিজ স্লিপে দাঁড়াতেন তখন তিনি বাড়তি একটি প্রটেক্টিভ গার্ড ব্যবহার করতেন।
রবার্টস তাঁর ক্যারিয়ারের সবচেয়ে গতির বলটি করেন ১৯৭৫ সালে। অজিদের বিপক্ষে। বলটির গতি ছিল ১৫৯.৫ কিলো/ঘণ্টা। এত কিছুর পরেও রবার্টস ছিলেন এক্সপ্রেশনলেস। কোনোদিন তাঁকে স্লেজিং করতেওও দেখা যায়নি।
রবার্টস এর অভিষেক হয় ১৯৭৪ সালে, মাত্র ২৩ বছর বয়সে। বার্বাডোজের ম্যাচটিতে প্রতিপক্ষ ছিল ইংল্যান্ড। নয় বছরের ক্যারিয়ারে মোট ৪৭টি টেস্ট খেলেছেন। ২৫.৬ গড়ে নিয়েছেন ২০২টি উইকেট। ৫ উইকেট নিয়েছেন ১১ বার আর সাথে ২বার ১০ উইকেট। সেরা বোলিং ফিগার ৭/৫৪। পাশাপাশি ৫৬ ওয়ানডেতে ২০.৩৫ গড়ে নিয়েছেন ৮৭ উইকেট। সেরা বোলিং ৫/২২। এর সাথে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে ২১ গড়ে রয়েছে ৮৮৯টি উইকেট। ঘরোয়া ক্রিকেটে খেলেছেন লিওয়ার্ড আইল্যান্ডস, হ্যাম্পশায়ার, লেস্টারশায়ার আর নিউ সাউথ ওয়েলসের হয়ে।
রবার্টস তার ক্যারিয়ারের সেরা সময় কাটান হ্যাম্পশায়ারের হয়ে। সে সময় কাউন্টির সবচেয়ে গতির বোলার ছিলেন তিনি। ১৯৭৪ সালে হ্যাম্পশায়ারের হয়ে তিনি ১৩.৬২ গড়ে লাভ করেন ১১৯টি উইকেট। ১৯৭৪-৭৫ মৌসুমে ভারতের স্পিন পিচে আগুন ঝরিয়েছিলেন তিনি। ৪ ম্যাচের সিরিজে লাভ করেন ৩২টি উইকেট। গড় ছিল সাকুল্যে ১৮.২৭।
রবার্টস ছিলেন ক্লাইভ লয়েডের ১৯৭৫ আর ১৯৭৯ এর বিশ্বকাপজয়ী দলের গর্বিত সদস্য। ১৯৭৫ এর বিশ্বকাপে ৫ ম্যাচে নেন ৮টি উইকেট। ইকোনমি রেট ছিল ৩ এর কম। সেই বিশ্বকাপে পাকিস্তানের সাথের ম্যাচে এগারো নম্বরে ব্যাট করতে এসে ডেরেক মারেকের সাথে ৬৪ রানের জুটি গড়ে জেতান দলকে।ঐ ইনিংসে তার রান ছিল ২৪*।
১৯৭৫-৭৬ মৌসুমে অস্ট্রেলিয়ায় গিয়ে ৫-১ এ হেরে আসে ক্যারিবিয়ানরা। রবার্টস নেন ২৬ গড়ে ২৪ উইকেট। যে একমাত্র ম্যাচটা দল জিতেছিল সেই ম্যাচের দ্বিতীয় ইনিংসে একা ৭ উইকেট নিয়ে দলকে জেতান তিনি। ঐ সিরিজের পরেই লয়েড গড়ে তোলেন বিধ্বংসী পেস কোয়েট্রেট।যাদের নেতা ছিলেন রবার্টস।
১৯৭৬ সালের ইংল্যান্ড সিরিজে দারুণ খেলেন রবার্টস। ২৮ উইকেট নিতে উইকেট প্রতি খরচ করেন ২০টি করে রান। লর্ডসে ২ ইনিংসে ৫টি করে নেন ১০টি উইকেট। পরের ম্যাচে ওল্ড ট্র্যাফোর্ডের পেস সহায়ক পিচে নেন ৯ উইকেট। হেডিংলেতে পরের ম্যাচেও নেন ৯টি উইকেট। উল্লেখ্য যে, হেডিংলের ম্যাচটা ছিল রবার্টস এর ক্যারিয়ারের ১৯তম ম্যাচ। সেই ম্যাচে ওয়েস্ট ইন্ডিজের ইতিহাসের দ্রুততম বোলার (বৈশ্বিক ভাবে চতুর্থ) হিসেবে নেন শত উইকেট। যে রেকর্ডটি আজও টিকে রয়েছে।
ক্যারিয়ারের সেরা সময়ে ২ বছর খেলেছিলেন ক্যারি প্যাকাররের ওয়ার্ল্ড সিরিজে।এখানেও দারুণ পারফর্ম করেন। ক্যারি প্যাকার ওয়ার্ল্ড সিরিজের পর কিছুটা গতি হারালেও সময়ের সাথে সাথে হয়ে উঠেছেন আরও অভিজ্ঞ,আরও পরিণত এবং আরও নিখুঁত।
ক্যারিয়ারের শেষ সময়ে এসেও দিয়ে গেছেন নিজের সেরাটা। ১৯৮০ সালে ট্রেন্টব্রিজে ২ ইনিংসে রবার্টস এর বোলিং ফিগার ছিল ৫/৭২ ও ৩/৩৭। আর ইংরেজদের দেয়া ২০৮ রানের টার্গেটে ব্যাট করতে নেমে ১৮০ রানে ৮ উইকেট হারিয়ে দল যখন ধুঁকছিল তখন অপরাজিত ২২ রানের ইনিংস খেলে দলকে জেতান ‘ব্যাটসম্যান’ রবার্টস।
১৯৮২-৮৩ মৌসুমে ঘরের মাটিতে ভারতের বিপক্ষের সিরিজে ২২ গড়ে নেন ২৪টি উইকেট। এর মাঝে কিংস্টনের স্যাবিনা পার্কে একাই নেন ৯টি উইকেট। ’৮৩ এর বিশ্বকাপেও ভাল কিছু স্পেল উপহার দেন তিনি। ফাইনালে রবার্টস এর ৩/৩২ এর স্পেলটাই ম্যাচ উইনিং স্পেল হতে পারতো যদি না ভারতের দেয়া ১৮৪ এর ছোট টার্গেটে ব্যাট করতে নেমে মাত্র ১৪০ রানে অল আউট হত ওয়েস্ট ইন্ডিজ।
বিশ্বকাপের পরের ভারত সফরই ছিল তার ক্যারিয়ারের শেষ সফর। ফিটনেস সমস্যার কারণে প্রথম ৪ ম্যাচে খেলতে না পারলেও ৫ম ম্যাচে ইডেন গার্ডেন্সে মাঠে নামেন তিনি। নেন ৫৬ রানে ৩ উইকেট। পরে ১০ নম্বরে ব্যাট হাতে নেমে অধিনায়ক লয়েডের সাথে গড়েন ১৬১ রানের জুটি। যেখানে তাঁর অবদান ছিল ৬৮টি রান। সেটা আবার ছিল রবার্টস এর সর্বোচ্চ ইনিংস।
ব্যাটসম্যান হিসেবে খুব একটা খারাপ ছিলেন না রবার্টস। বরং সময়ের সাথে সাথে ব্যাটিংয়ে মনোযোগ দিয়েছিলেন তিনি। ২৭ টেস্ট পর যার ব্যাটিং গড় ছিল সাকুল্যে ৭.৩৮! সেই তিনিই পরের ২০ ম্যাচে রান করেছেন ২৬.৬৫ গড়ে। ক্যারিয়ার শেষে ৪৭ ম্যাচে ৩ ফিফটিতে সাড়ে ৭০০’র উপর রান ছিল নামের পাশে। গড়টাও প্রায় ১৫।
খেলা ছাড়ার পর ১৯৯০ সালে কিছুদিন এর জন্য ক্যারিবিয়ানদের কোচ হন তিনি। ২০০১ সালে বাংলাদেশে আসেন কিছুদিন এর জন্য। বোলিং পরামর্শক হয়ে। যাওয়ার আগে মাশরাফি বিন মর্তুজা আর তালহা জুবায়েরকে দিয়ে যান জেনুইন পেসারের স্বীকৃতি। এরপর কিছুদিন এর জন্য ভারতের বোলিং কোচ হন। ২০০৬ সালে নির্বাচিত হন ওয়েস্ট ইন্ডিজ এর নির্বাচক হিসেবে। তবে ২০০৮ সালে বরখাস্ত করা হয় তাঁকে।
খেলোয়াড়ি জীবনে ১৯৭৫ সালে উইজডেন এর বর্ষসেরা ক্রিকেটার নির্বাচিত হন। ২০০৯ সালে আইসিসির হল অব ফেমে অন্তর্ভুক্ত হয় তাঁর নাম। ২০১৪ সালে লাভ করেন সম্মানসূচক ‘ব্রিটিশ নাইটহুড’। আজও তার নামে কেঁপে ওঠে ব্যাটসম্যানরা। আজো হয়তো কারো দু:স্বপ্নে আসেন তিনি।