গত দশকের মাঝামাঝি সময় থেকেই নিজেদের ক্রিকেট ইতিহাসের সবেচেয়ে বাজে সময় পার করছে শ্রীলংকা। মাঠ কিংবা মাঠের বাইরে দু’জায়গাতেই পার করছিল দু:সময়। এর মাঝেই ২০১৯ সালে দ্বিমুথ করুণারত্নের নেতৃত্বে দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে যায় লঙ্কানরা।
ফলাফল যা হবার তাই; স্টেইন, রাবাদা, ফিল্যান্ডারদের পেস আর কেশব মহারাজের স্পিনের সামনে প্রথম ইনিংসে দাঁড়াতেই পারেননি লংকান ব্যাটসম্যানরা। তাই চতুর্থ ইনিংসে যখন তাদের সামনে জয়ের লক্ষ্যমাত্রা দাঁড়ায় ৩০৪ রান, লংকানদের সবচেয়ে আশাবাদী সমর্থকও বোধহয় জয়ের স্বপ্ন দেখেননি।
আর ২২৬ রানে নবম উইকেট পতনের পর পরাজয়টা ছিল কেবলই সময়ের ব্যাপার। কিন্তু অন্যরকম ভেবে রেখেছিলেন একজন। আগের ইনিংসেও ফিফটি করেছিলেন কিন্তু ব্যাটিং ধ্বস ঠেকাতে পারেননি। শুরু থেকেই শুরু করলেন মারকুটে ব্যাটিং, শেষ উইকেট জুটিতে বিশ্ব ফার্নান্দোর সাথে ৭৮ রানের জুটি গড়ে দলকে জয়ের নোঙরে পৌঁছে দেন।
সেই ঐতিহাসিক ৭৮ রানের জুটি ফার্নান্দোর অবদান ছয় রানের, যার মধ্যে চার রানই এসেছে ওভার-থ্রো-তে! নিজে অপরাজিত ছিলেন ১৫৩ রানের মহাকাব্যিক এক ইনিংস খেলে। অনেকের মতে, এই ইনিংসটি ছাপিয়ে গিয়েছিল অজিদের বিপক্ষে লারার সেই ইনিংসকেও।
শ্রীলঙ্কার এই ব্যাটসম্যানটি হলে কুশল জেনিথ পেরেরা, লঙ্কানদের নতুন মাতারা হারিকেন। যদিও ক্যারিয়ারের শুরুতে পাওয়া এই তকমাটা আদৌ ধরে রাখতে পারেননি তিনি। সাম্প্রতিক অন্য অনেক লঙ্কান প্রতিভার মতই বিকশিত হয়নি তাঁর ক্যারিয়ার।
কুশল পেরেরার ক্রিকেট জীবন শুরু হয় শ্রীলঙ্কার বিখ্যাত রয়েল কলেজের হয়ে। এরপর প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে আলো ছড়িয়ে ডাক পান জাতীয় দলে। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে এক ম্যাচে ২৭০ বলে ৩৩০ রান করেই মূলত আলোচনায় আসেন এই বাঁ-হাতি হার্ড হিটার ব্যাটসম্যান।
২০১৩ সালে অস্ট্রেলিয়া সফরে দীনেশ চান্ডিমাল ইনজুরিতে পড়লে তার স্থলে অভিষেক হয় পেরেরার। অভিষেক ম্যাচে ১৬ বলে ১৪ রান করে অপরাজিত থাকেন তিনি। সেবারের ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগেও (আইপিএল) ডাক পান তিনি, জায়গা করে নেন রাজস্থান রয়্যালসের তাঁবুতে।
দারুণ সব পুল শট খেলার পাশাপাশি অফ সাইডে দারুণ শক্তিশালী কুশল পেরেরা। ব্যাটিংয়ের পাশাপাশি উইকেট কিপিং করতেও পটু তিনি। দারুণ ব্যাটিংয়ের সুবাদে দ্রুতই ওপেনিং এ প্রমোশন পান তিনি।
বাংলাদেশের বিপক্ষে ৪৪ বলে ৬৪ রান করে নিজের ক্যারিয়ারের প্রথম অর্ধশতক তুলে নেন তিনি। একদিনের ক্রিকেটের প্রথম শতকটাও বাংলাদেশের বিপক্ষেই, পালেকেল্লেতে সেদিন আউট হবার আগে খেলেন ১০৬ বলে ১২৪ রানের ঝড়ো এক ইনিংস।
টেস্টে খুব বেশি ম্যাচ না খেললেও লাল বলের ক্রিকেটে কম যান না পেরেরা। অন্তত রেকর্ড তাই বলে, টেস্ট ইতিহাসেরই অন্যতম সেরা ইনিংসের রেকর্ড তার দখলেই। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে রান করেছেন প্রায় ৪২ গড়ে। কিন্তু ইনজুরি আর ডোপিংয়ের মিথ্যে অভিযোগ বেশ কিছুটা পিছিয়ে দেয় পেরেরাকে।
অনেক ঝড় পেরিয়ে শ্রীলঙ্কার হয়ে খেলেন ২০২১ সাল পর্যন্ত। ২২ টেস্ট, ১০৭ টি ওয়ানডে আর ৬০ টি টি-টোয়েন্টিতেই আটকে আছে তাঁর ক্যারিয়ার। ফিরবেন যে, তেমন কোনো আভাসও নেই!
অধিনায়কত্বও করেছেন জাতীয় দলের। কিন্তু সেখানেও তিনি আপাদমস্তক ব্যর্থ। সব মিলিয়ে তিনি বিরাট একটা আক্ষেপ। তিনি হতে না পারা এক সনাথ জয়াসুরিয়া।
শ্রীলঙ্কার রথী-মহারথীদের ভিড়ে কুশল পেরেরা হয়তো পরিসংখ্যানে কখনোই স্মরণীয় হবেন না, কিন্তু দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে খেলা অপরাজিত ১৫৩ রানের মহাকাব্যিক ইনিংসের কল্যাণে ক্রিকেটপ্রেমীদের মনের মণিকোঠায় ঠিকই জায়গা করে নিয়েছেন তিনি।