ভূবনমোহিনী নাটকের অতিনাটকীয় নায়ক

নিজের চোখকেও বিশ্বাস করানোর কোনো উপায় ছিল না। না, কোনো ভাবেই নয়।

৬৭ বলে ৩ রান। ১৫২ বলে ৫০ রান। ১৯৯ বলে ১০০ রান। ২১৯ বলে ১৩৫ রান। এক ব্যাটসম্যান শিখিয়ে দিয়ে গিয়েছিলেন কিভাবে টেস্ট ব্যাটিং করতে হয়, কিভাবে খাঁদের কিনারায় দাঁড়ানো একটা দলকে অতিমানবীয় কায়দায় টেস্ট জেতাতে হয়! আর চতুর্থ ইনিংসে ৩৫৯ রান তো আর মুখের কথা নয়।

এখানে আক্রমণ আর পাল্টা আক্রমণ হলেই শুধু  চলে না – দরকার বিরাট সাহস। সেই সাহসটা দেখাতে তিনি পেরেছিলেন। সেটাকে কখনো প্রচণ্ড অস্থিরতা মনে হয়েছে, কখনো বা স্রেফ পাগলামী। তবে, সবচেয়ে বড় ব্যাপার হল – জব ওয়েল ডান। একদম সুনিপুণভাবে। ফলে, লোকটার মেজাজ নিয়ে যতই প্রশ্ন তুলুন মাঠের বাইরে, মাঠে তাঁর টেম্পারমেন্ট একদম ষোল আনাই খাঁটি।

প্রথম ইনিংসে ব্যাটিং লজ্জায় যাদের মাথা হেট হতে বাধ্য হয়েছিল, অল আউট হয়েছিল ৬৭ রানে, সেই ইংলিশদেরই মাথা উঁচু হয়েছিল ২০১৯ সালের ২৫ আগস্ট। প্রথম বারের মত ওয়ানডে বিশ্বকাপ জয়ের মাত্র কয়েকটা দিন বাদেও, সেটাও আবার অ্যাশেজের মঞ্চে।

হেডিংলির সেই টেস্ট ম্যাচটা শেষ অবধি তারা জিতে যায় মাত্র এক উইকেটে। কত নাটক যে চলেছে তা জয়ের ওই ব্যবধানই বলে দিচ্ছে। সাদা পোশাকের ক্রিকেটে এত রোমাঞ্চকর ভূবনমোহিনী ম্যাচের নজীর সাম্প্রতিক সময়ে আর খুব বেশি নেই।

ঠিক যেন বিশ্বকাপের ফাইনালের মতই আরো একটা রোমাঞ্চকর লড়াই। এবারও ইংলিশদের মুখে হাসি। আর নায়ক? এবারও সেই একজনই। কে আবার, ওই যে নিউজিল্যান্ড বংশোদ্ভূত ছেলেটা, যার নামের পাশে তখন ‘স্যার’ লাগিয়ে দেওয়ার চিন্তা ভাবনা চলছিল।

নিশ্চয়ই বুঝে ফেলেছেন এই নাটকের নায়ক একজন অতিনাটকীয় স্টোকস, বেঞ্জামিন অ্যান্ড্রু স্টোকস – যিনি ক’দিন আগেই ইংল্যান্ডকে বিশ্বকাপ জিতিয়েছেন। তবুও, এই হেডিংলি টেস্টের শেষ ইনিংসেই গ্যালারি থেকে দর্শকরা এক হয়ে জুতো পর্যন্ত দেখিয়েছেন। সে অপমানটা গায়ে মেখেছেন কি না জানা যায়নি, তবে বিজয়ের রঙটা ঠিকই তাঁর ব্যাটে স্পষ্ট।

টেস্টে এমন ম্যাচ জেতানো ইনিংস বিরল বললেও কম বলা হয়। সেখানে হয়তো ওয়েস্ট ইন্ডিজের ব্রায়ান লারার নাম আসবে, পাকিস্তানের ইনজামাম উল হকের মুলতান কাণ্ডের স্মৃতি আসবে, কিংবা আসবে সাম্প্রতিক সময়ের কুশল পেরেরার প্রসঙ্গ। কিন্তু, স্বয়ং অ্যাশেজের মঞ্চ বলেই কি না, স্টোকসের ইনিংসটা এখন থেকে তালিকার ওপরের দিকেই থাকবে।

টেস্টে কিভাবে পরিস্থিতির সাথে মানিয়ে খেলতে হয় সেটা স্টোকসের চেয়ে কেই বা ভাল জানেন। ধীরগতিতে শুরু করলেন। শেষটা হল দানবীয়। টেল এন্ডার জ্যাক লিচকে সাথে নিয়ে লড়াই করলেন। নিজের ইনিংসের শেষ ৭৭ রান করতে গুণলেন মাত্র ৪৪ বল। ভাবা যায়!

কে জানতো এমন অভাবনীয় কিছু ঘটবে হেডিংলির মাঠে! জানলে কি আর দর্শকরা দুয়ো দেয়! এখন অন্তত নিজেদের কাজের জন্য ক্ষমা চেয়ে তাঁরা বলতেই পারেন – স্যালুট স্টোকস! ভাগ্যিস তুমি নিউজিল্যান্ডের হয়ে না খেলে ইংল্যান্ডের হয়ে খেলছো!

এমন একজন ক্রিকেটারকে তো এখন মাথায় তুলে রাখতেই হয়। বিশ্বকাপের ফাইনালে ম্যাচ সেরার পুরস্কার পাওয়ার পর গুঞ্জন ছিল, এবার নাইটহুড দিয়ে দেওয়া হবে স্টোকসকে। তখন বিষয়টা আর সম্ভবনা আর গুঞ্জণের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি, বেন স্টোকসকে দেওয়া হয় অর্ডার অব দ্য ব্রিটিশ এম্পায়ার খেতাব।

ইংল্যান্ড আদিখ্যেতা দেখিয়ে ভাস্কর্য বানিয়ে ফেললেও অবাক হওয়ার কিছু নেই। কিংবা তাঁর চেয়েও বেশি কিছু। এমন একটা চরিত্র ব্রিটিশ ক্রিকেটে দূরের কথা, ক্রিকেট বিশ্বেই বিরল। আসলে স্টোকসের সেই ইনিংসটার জন্য শুধু ইংল্যান্ডের ক্রিকেটই নয়, গোটা বিশ্বই তাঁর কাছে ঋণী হয়ে থাকবে।

বেন স্টোকস সেই সময়ের পর তাঁর ব্যক্তিজীবনে অনেক উত্থান-পতন দেখেছেন, সয়েছেন অনেক। পারিবারিক টানাপোড়েন, ইনজুরি আর মানসিক অবসাদে তিনি বিপর্যস্ত। তবে, হেডিংলির স্মৃতি বলে – স্টোকস জানেন কিভাবে দু:স্বপ্নকে ছাই চাপা দিয়ে ফিনিক্স পাখি উঠে দাঁড়াতে হয়। স্টোকস উঠে আসবেন, অপেক্ষা কেবল সময়ের!

লেখক পরিচিতি

সম্পাদক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link