আলো-আঁধার, ভাল-খারাপ, সুখ-দু:খ, হাসি-কান্না এমন সব বৈপরীত্যে নিয়েই চলছে এই মস্ত বড়ো এক পৃথিবী। এই পৃথিবীর প্রতিটি পরতে পরতে দেখা মিলবে বৈপরীত্যের। এমনই এক উদাহরণের সাক্ষী এবারের ইউরোপিয়ান ফুটবলের গ্রীষ্মকালীন দলবদল। লিওনেল মেসি ছেড়েছেন তাঁর ঘর বার্সালোনা, অন্যদিকে ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো ফিরেছেন ওল্ড ট্রাফোর্ডে দীর্ঘ ১২ বছর শেষে।
৩ মৌসুম তুরিনের দল জুভেন্টাসে কাটিয়ে রোনালদোর এবার দলবদল কিছুটা নিশ্চিতই ছিল। টাকার বস্তা, অভাবনীয় সুযোগ সুবিধা নিয়ে তাকে দলে ভেড়াতে মরিয়া ছিল ম্যান সিটি। পিএসজিও সেই দৌড়ে রয়েছে এমন গুঞ্জন শোনা গেলেও, একপ্রকার নিশ্চিত ছিল রোনালদো গায়ে জড়াতে যাচ্ছেন আকাশি নীল জার্সিটা। তবে সকল সম্ভাবনা, গুঞ্জনের অবসান ঘটিয়ে রোনালদো ফিরলেন তার পুরোনো ঘরে, যেখানে এখনো রোনালদো ঘরেরই ছেলে। ১২ বছরের দূরত্ব কি আর ছেলেকে পর করা যায়।
স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসন তো এক সাক্ষাৎকারে বলে ফেলেছিলেন, ‘রোনালদো, ও আমার ছেলে।’ সেই ছেলেকে আবার ঘরে ফিরিয়েছে রেড ডেভিলরা। ১৫ মিলিয়ন ইউরোতে দলে এসেছে এখনো ম্যান ইউ ফ্যানদের চোখের মনি ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো।
২০০৩ থেকে ২০০৯ এই ৬ বছরে রোনালদো নিজের ক্যারিসম্যাটিক পারফরম্যান্সে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডকে জিতিয়েছেন তিনটি প্রিমিয়ার লিগ, একটি চ্যাম্পিয়নস লিগ, অভিষেকেই এফএ কাপ, ক্লাব বিশ্বকাপ-সহ আরো নানান শিরোপা। স্পেনের রাজধানীতে পা রাখবার আগে রেড ডেভিলদের হয়ে ২৯২ ম্যাচে করেছেন ১১৮ গোল, প্রশংসনীয়। ক্যারিয়ারের শুরুতে ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের মতো হাড্ডা-হাড্ডি লড়াইয়ে নিজেকে ছাড়িয়ে যেতে চেয়েছেন প্রতি সিজনেই। কি-সব অসাধারণ ফ্রি-কিক! কত শত ডি-বক্সের বাইরে থেকে করা পাওয়ারফুল শট! এসব কিছুই মনে এখনো গেঁথে আছে ম্যান ইউ ভক্তদের।
তবে এসব কিছুই পুরোনো, এসব কিছুই এখন অতীত। সময়ের পরিক্রমায় টগবগে যুবক ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো এখন ৩৬ বছর বয়সী একজন স্ট্রাইকার। মাঝ মাঠ থেকে উইং ব্যবহার করে ক্ষিপ্র গতিতে দুই-তিনজকে ড্রিবল করে বল নিয়ে হয়ত এখন তিনি ছুটবেন না, চেষ্টা করবেন ডি-বক্সের আশেপাশে থেকেই দলের জন্য গুরুত্বপূর্ণ সব গোল বের করতে। তবে তিনি এখনও একজন উইঙ্গার হিসেবে খেলতে পারদর্শী। প্রমাণ স্বরুপ জুভেন্টাসে খেলা তার তিন সিজন। শেষ মৌসুমে তাঁকে খেলতে হয়েছে আলভারো মোরাতার সাথে জুটি বেঁধে।
তবে তাকে ইউনাইটেডের হয়ে একজন স্ট্রাইকার হিসেবেই খেলতে হবে। ম্যান ইউ কোচ ওলে গুনার সোলশায়ারের পছন্দের ট্যাকটিস কিংবা ফরমেশন তেমনটাই আভাস দেয়। তার সবচেয়ে পছন্দের ফরমেশন ৪-২-৩-১। সেক্ষেত্রে সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে রোনালদোই একমাত্র স্ট্রাইকারের রোল প্লে করবেন। এর মানে দাঁড়ায় ম্যান ইউ সম্ভবত তার কাছ থেকে আশা করছেন তিনি অনেক বেশি গোল করবেন লাল জার্সিতে।
কিন্তু প্রশ্ন থেকেই যায়, রোনালদো তাদের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারবে তো? সেক্ষেত্রে গত তিন মৌসুমে জুভেন্টাসে কাটানো রোনালদোর পরিসংখ্যান ঘাটলে হয়ত পরিষ্কার একটা ছবি পাওয়া যাবে।
জুভেন্টাসের হয়ে গত তিন মৌসুমে ১৩৪ ম্যাচে ১০১ গোল করছেন তিনি। গড়ে প্রতি মৌসুমে যা দাঁড়ায় ৩৪ গোল। রোনালদো রিয়ালে থাকা ভয়ংকর রোনালদো হয়ত আর নেই। তবে তিনি যে এখনও গোল করতে জানেন সেটাই হয়ত কাজে লাগাতে চাইবেন তারই এককালের সতীর্থ ম্যান ইউ কোচ ওলে গুনার শুলসার।
শুধু গত মৌসুমে সিরি এ-তে তাঁর গোলের সংখ্যা ২৯ টি। ইউরোপের শীর্ষ লিগগুলোর মধ্যে তিনি সেরা গোলদাতা তালিকার তৃতী স্থানে রয়েছেন। তার উপরে রয়েছেন যথারীতি রবার্ট লেওয়ানডস্কি ৪১ গোল এবং লিওনেল মেসি ৩০ গোল করে। যদিও গত মৌসুমে ক্রিশ্চিয়ানো পারেননি তার দলকে লিগ শিরোপা জেতাতে।
তবুও গত মৌসুমে ট্রফিলেস ছিলনা জুভেন্টাস, জিতেছিলো কোপা ইতালিয়া শিরোপা। আর অন্যদিকে ছাড়িয়ে গেছেন নতুন রেকর্ড। আন্তর্জাতিক পর্যায় ১০৯ গোল করে পেছনে ফেলেছেন ইরানের আলী দাই কে। নাম লিখিয়েছেন গিনিজ ওয়ার্ল্ড রেকর্ড বইয়ে।
ক্ষুদ্র ক্ষুদ পরিসংখ্যান থেকেই বোঝা যাচ্ছে রোনালদো শেষ হয়ে যাননি। রোনালদো এখনো চাইলে ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগে থাকা বাঘা-বাঘা সব স্ট্রাইকারদের সাথে টক্কর দিতে পারবেন। তার শারীরিক সক্ষমতাও রয়েছে, মানসিক দৃঢ়তা যেন চীনের প্রাচীর।
রোনালদো দলে আসায় যেমন দর্শক সমর্থক সকলেই খুশি, তেমনি তরুণ খেলোয়াড়রাও বেশ খুশি তার মতো একজন খেলোয়াড়রুপী যোদ্ধাকে তাদের সতীর্থ হিসেবে পেয়ে। নি:সন্দেহে তিনি বর্তমান সময়ে সেরাদের একজন। তবে, বয়সটা বেড়ে যাচ্ছে – আর ক’দিন সার্ভিস দিতে পারবেন সেটা বলা মুশকিল।
তবে রোনালদো দলে আসায় খানিকটা বেগ পোহাতে হতে পারে বেশকিছু খেলোয়াড়কে। কেননা গানার হয়ত রোনালদোকেই বেশি সুযোগ দিতে চাইবেন, ট্রফি খড়া ঘুচাতে। সেক্ষেত্রে ১৯ বছর বয়সী তরুণ গ্রিনউড রয়েছেন সবচেয়ে বেশি শঙ্কায় তার খেলার সময় নিয়ে। অন্যদিকে অ্যান্টনিও মার্শাল পরেবেন আরো বড় বিপাকে দলে থাকা অভিজ্ঞ দুই স্ট্রাইকার এডিনসন কাভানি এবং রোনালদোর ভিড়ে তাকে হয়ত সাইড বেঞ্চে বসেই কাটাতে হবে। অন্যদিকে জর্ডান সাঞ্চো, র্যাশফোর্ড এদের প্লেয়িং টাইমেও দেখা দিতে পারে ঘাটতি।
এসব কিছুই এখন সম্ভাবনা। ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড সমর্থক, ক্লাব কর্তারা থেকে শুরু করে সবাই হয়ত চাইবেন রোনালদোর গোল স্কোরিং স্কিল এবং তার অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে ট্রফি খড়াতে ভোগা শেলফ গুলোতে একটু বৃষ্টির ছোয়া পেতে। সাথে চাইবেন তরুণ খেলোয়াড়দের শতভাগ। পরিকল্পনায় পরিবর্তন আসবে হয়ত। হয়ত ম্যান ইউ আবার ফিরে যাবে সেই ডেভিল মোডে, ডমিনেট করবে প্রতিটি টুর্নামেন্ট, লিগ।
আগামী ফেব্রুয়ারিতে ৩৭ এ পা রাখবে রোনালদো। এই বয়সে সমর্থকদের প্রত্যাশার প্রতিদান কতটুকু দিতে পারবে সে, তা দেখতে আমাদের অপেক্ষা করতে হবে এই আন্তর্জাতিক বিরতি শেষ হবার। ততদিন অধীর আগ্রহে বসে থাকবে ওল্ড ট্রাফোর্ড, রোনালদো-রোনালদো ধ্বনিতে মুখরিত হবার আশায়।