‘How’s the josh?’ – ‘High Sir!’
যুদ্ধ জিততে কি শুধু দক্ষতাই শেষ কথা? গায়ে যখন সৈনিকের কড়া পোশাক, তেরঙ্গার ছোঁয়া আর যখন ‘জয় হিন্দ’ তখন বন্দুক চালানোরর দক্ষতার সঙ্গেও যুক্ত হয় ‘জোশ!’
এই জোশই লড়তে শেখায় যখন আর কিছু করার ক্ষমতা অবশিষ্ট থাকেনা। একটা দলে যখন এরকম জোশ-এর ডোপিং হয় তখন সেমিকন্ডাক্টরের পরিবাহিতার মতো দলের মুডটাই অন্যরকম হয়ে যায়।
স্বার্থপর নয়, শুধু নিজের কথা ভাবেনি। বাবা মারা যাওয়ার পর যার প্রধান লক্ষ্যই ছিল পরিবারের দেখাশোনা করা আর বোনেদের বিয়ে দেওয়া। ‘Charity begins at home’ – সে ছেলে যে ঘর ছাড়িয়ে দেশেরও জোশ বাড়াবে তাতে আর সন্দেহের অবকাশ নেই।
তিনটে স্ট্যাম্পে বলটা রাখতে হবে, সে অফের দিকে ফেলে হোক বা লেগের দিকে। আসলে ওই তিনই যে সবকিছু। তাইতো তিন তার লাকি সংখ্যা। আর ১৯৮০ সালের জুলাইয়ের তিন তারিখেই যে তাঁর জন্ম। পাঞ্জাবের জলন্ধরে সরদার সরদেব সিং প্লাহা ও অবতার কৌরের কোল আলো করে সেদিন এসেছিল হরভজন, পাঁচ বোনের সঙ্গে একমাত্র ভাই। কিন্তু আদরে সে বাঁদর হয়ে যায়নি বরং বাবার অনুপ্রেরণায় কঠিন পরিশ্রমের ফলে সে একদিন ভারতের নাম উজ্জ্বল করতে চেয়েছিল।
ছেলেটা ব্যাটসম্যান হতে চেয়েছিল, সেভাবেই অনুশীলন করতো কোচ চরণজিৎ সিং ভুল্লারের কাছে। কোচের অকাল মৃত্যুর পর অন্য কোচ দেবিন্দর অরোরা তাকে স্পিন বোলিংয়ে মনোনিবেশ করতে বলে। সেটাই কিন্তু তার জীবনে টার্নিং পয়েন্ট। অরোরা স্যারের তত্ত্বাবধানে সকালে তিন ঘন্টা আবার বিকেলে তিনটা থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত চলতো স্পিন শিল্পের বুনন। আসলে তিন যেন হরভজনের জীবনের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে গিয়েছিল।
১৯৯৫-৯৬ মৌসুমে ১৫ বছর ৪ মাস বয়সে পাঞ্জাবের অনূর্ধ্ব ১৬ দলে চান্স পায় হরভজন। হরিয়ানার বিরুদ্ধে প্রথম ম্যাচের দুই ইনিংসে নেয় যথাক্রমে ৪৬ রানে ৭ ও ১৩৮ রানে ৫ উইকেট। দ্বিতীয় ম্যাচে দিল্লীর বিরুদ্ধে করে ৫৬ রান,আর তৃতীয় ম্যাচে হিমাচল প্রদেশের বিরুদ্ধে নেয় ৭৯ রানে ১১ উইকেট। চার ম্যাচে ৩২ উইকেট ও ৯৬ রানের সৌজন্যে উত্তরাঞ্চলের অনূর্ধ্ব ১৬ দলে সুযোগ পায়।
মাত্র ১৫ বছর ৯ মাস বয়সে অনূর্ধ্ব ১৯ জাতীয় দলে তাঁর ডাক পড়ে। ১৯৯৬-৯৭ মৌসুমে পাঞ্জাবের অনূর্ধ্ব ১৯ দলের হয়ে ভালো খেলার পর সার্ভিসেসের বিরুদ্ধে রঞ্জি ট্রফিতে তার অভিষেক হয়, কিন্তু তাঁকে আবার জুনিয়র দলে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। সেখানে দুই ম্যাচে যথাক্রমে ৫ ও ৭ উইকেট নেওয়ার পর আবারও পাঞ্জাবের সিনিয়র টিম এবং পরে দুলীপ ট্রফির জন্য উত্তরাঞ্চলের হয়ে ডাক পড়ে। এর মধ্যে ১৯৯৮ এর অনূর্ধ্ব ১৯ বিশ্বকাপ খেলতে যায় এবং মোট ৮ উইকেট পায়। ফিরে এসে আবারও রঞ্জি এবং দুলীপ ট্রফিতে ভালো পারফরমেন্স করে।
ডোমেস্টিকে ভালো খেলার পুরস্কার পেতে দেরি হয়নি হরভজনের। ১৯৯৮ সালের ২৫ শে মার্চ ব্যাঙ্গালোরের তৃতীয় টেস্টে অভিষেক ঘটে হরভজনের। ড্র হওয়া সেই ম্যাচের প্রথম ইনিংসে ২ উইকেট পায় হরভজন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, এই ম্যাচেই অস্ট্রেলিয়ার হয়ে অভিষেক হয় অ্যাডাম ডেল ও ডারেন লেম্যানের। এটা ছিল শচীন তেন্ডুলকরে ২০৭ বলে ১৭৭ রানের সেই ম্যাচ।
উইকেটরক্ষক উইকেটের পিছন থেকে বারবার ‘হরভজন’ … ‘হরভজন’ বলে ডাকবে এতবড় নাম,সত্যিই খুব সমস্যার। নয়ন মোঙ্গিয়া তাই নাম দেয় ‘ভাজ্জি!’ সেদিন থেকে সে আপামর ভারতবাসীর কাছে হয়ে ওঠে ‘ভাজ্জি’।
ইতিমধ্যে ১৯৯৮ সালের ১৭ এপ্রিল শারজায় কোকাকোলা কাপের প্রথম ম্যাচে ভাজ্জির অভিষেক ঘটে ওয়ানডে ইন্টারন্যাশনালে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে। এই ম্যাচে ১০ ওভারে ৩২ রান দিয়ে তুলে নেয় ম্যাট হর্ন-এর উইকেট। এই ম্যাচেই সৌরভ গাঙ্গুলি করেন ১০৫ রান।
বোলিং অ্যাকশন নিয়ে সমস্যা, দলে কুম্বলের মতো স্থায়ী স্পিনার, সুনীল যোশী-মুরলী কার্তিক-শরনদীপ সিংদের ট্র্যাফিক জ্যামে ভাজ্জি ট্র্যাকচ্যুত হয়ে যেতে থাকে। খাপছাড়াভাবে দলে চান্স পেতে থাকে আবার দলের বাইরে চলে যায়। শচীন তেন্ডুলকরের নেতৃত্বে ১৯৯৯-২০০০ সফরে যে ভারতীয় দল অস্ট্রেলিয়া সফরে যায় সেই দলে ভাজ্জি থাকলেও একটাও ম্যাচ খেলার সুযোগ আসেনি।
আসলে অস্ট্রেলিয়ার মাঠে এক স্পিনারের নীতিতে দলে চান্স পাওয়াটাই বিস্ময়ের হ’ত, তার উপর তাসমানিয়ার বিরুদ্ধে প্রস্তুতি ম্যাচে ওরকম হতশ্রী পারফরমেন্স (০/১৪১)! এই সফরেই ভারত,পাকিস্তান ও অস্ট্রেলিয়াকে নিয়ে অনুষ্ঠিত কার্লটন এবং ইউনাইটেড ত্রিদেশীয় সিরিজেও ভাজ্জির ভাগ্যে শিকেটি ছিঁড়লোনা।
জাতীয় দলে নিজের জায়গা পাকা করতে না পারলেও ঘরোয়া ক্রিকেট খেলতে থাকে। ইতিমআধ্যে তার বাবারও মৃত্যু ঘটে আর অন্যদিকে তাঁকে এনসিএ-তে পাঠানো হয়। সেখানে শ্রীনিবাস ভেঙ্কটরাঘবন ও এরাপল্লী প্রসন্নের তত্ত্বাবধানে ট্রেনিং শুরু করে কিন্তু তার আচরণে তারা মোটেই প্রসন্ন হতে পারেননি। পরে নিজেই নিজের ভুল বুঝতে পারে।
কেরিয়ারের আসল টার্নিং পয়েন্টটা এসেছিল ২০০১ সালের বর্ডার গাভাসকার ট্রফিতে। কুম্বলের চোটের কারণে দলে ডাক পায় আর ৩ টেস্টের সিরিজে ৩২ টি উইকেট নিয়ে স্টিভের অশ্বমেধের ঘোড়া থামাতে প্রধান ভূমিকা নেয়। শুধু তাই নয় টেস্টে ভারতের হয়ে প্রথমবারের জন্য হ্যাটট্রিক করে ইডেন টেস্টে পন্টিং, গিলক্রিস্ট ও ওয়ার্নকে সাজঘরে ফিরিয়ে! এই টেস্টের পরই অস্ট্রেলিয় মিডিয়া লিখলো, ‘Harbhajan Singh terminated the whole Australian team’. ব্যাস টার্মিনেটর টার্মটা স্পিনের মতোই ঘুরে ঘুরে হয়ে গেল ‘টার্বুনেটর’!
এরপর আর ফিরে তাকাতে হয়নি যদিও মাঝেমধ্যে টেস্টে এক স্পিনারের নীতিতে বাদ পড়েছে। অন্যদিকে সাদাবলের ক্রিকেটে ভারতীয় দলে ভাজ্জিই হয়ে উঠেছিল পয়লা নম্বর স্পিনার।
টেস্টে ৪০০ উইকেট পাওয়া ভারতীয়দের চার জনের মধ্যে অন্যতম ভাজ্জি। ১৯০ ইনিংসে ৪১৭ টেস্ট উইকেট আর ২২৭ ওয়ানডে ইনিংসে ২৬৯টি উইকেট নিয়ে ভারতের অন্যতম সেরা স্পিনার ভাজ্জি। আন্তর্জাতিক টি-২০ তেও আছে ২৫টি উইকেট।
কুড়ি-বিশ এবং ওয়ানডে বিশ্বকাপজয়ী টিমের সদস্য ভাজ্জি,যুগ্মভাবে বিজয়ী চাম্পিয়ন্স ট্রফি দলের সদস্যও সে। এই রেকর্ড আর কেবলমাত্র যুবরাজেরই আছে। জিতেছেন একাধিক আইপিএল এবং চাম্পিয়ন্স লিগ টি-টোয়েন্টি ট্রফিও। নয় নয় করে আই পি এলেও পেয়েছে ১৫০ খানা উইকেট। তবে বারবার দলের বাইরে না গেলে, আঙুলে চোট না পেলে বা দুসরা নিয়ে অ্যাকশনে সমস্যা না হলে হরভজনের ক্যারিয়ারের স্ট্যাট অন্যভাবে লেখা হত।
তবে বোলার ভাজ্জির সঙ্গে সঙ্গে ব্যাটসম্যান ভাজ্জির কথা না বললে যে অসম্পূর্ণ থেকে যায়। টেস্টে দুটো সেঞ্চুরি ও ৯ টি হাফ সেঞ্চুরির মালিক সে। আর যখনই দরকার পড়েছে ছোট কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ কিছু ইনিংস খেলেছে ভাজ্জি। কী করে ভুলি কুয়ালালামপুরে ২০০৬ এর ডিএলএফ কাপে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে কঠিন পিচে ওই ৬০ বলে ৩৭ রানের কথা! কী করে ভুলি ২০০৮ এর বিতর্কিত সিডনি টেস্টে শচীনের টেন্ডুলকারের সঙ্গে ১২৯ রানের জুটিতে ৯২ বলে ৬৩ রানের কথা। আসলে কেউ ভুলবেনা সেদিনের কথা-ভাজ্জি না, ভারতীয় দল না, সাইমন্ডস না, অস্ট্রেলিয়ান দল না এবং অবশ্যই শচীন টেন্ডুলকার না!
‘Monkey’ হোক বা ‘মা কী’ ক্রিকেট ঈশ্বর ছাড়া ভাজ্জির ক্যারিয়ার বাঁচাতে কেউই পারতোনা। কালিমালিপ্ত হত ভারতীয় ক্রিকেট। ‘তুমি নির্মল করো, মঙ্গল করে…’ -সেদিন সবার সাক্ষী, আপত্তি এক লহমায় ম্লান হয়ে গিয়েছিল শচীনের সাক্ষ্যে। যে নাকি স্বার্থপর তার কথাতেই জন হান্সেন বলতে বাধ্য হয়েছিল ‘not guilty!’
মাঙ্কিগেট বিতর্ক ছাড়াও ভাজ্জি বারবার বিতর্কে জড়িয়েছে তার মেজাজের জন্য। শ্রীশান্তকে চড় মেরে সাসপেন্ড হয়েছে আই পি এল থেকেও। আবার খালিস্তান জঙ্গি জার্নেল সিং ভিন্দ্রাওয়ালেকে ‘স্বাধীনতা সংগ্রামী’ বলে বিতর্কে জড়িয়েছে। চুল খুলে মদের বিজ্ঞাপন করে ধর্মীয় ভাবাবেগে আঘাত দিয়েও বিতর্কে জড়িয়েছে। আবার অকল্যান্ড এয়ারপোর্টে নিজের জুতোও পরিষ্কার করতে হয়েছে!
অশ্বিনদের উত্থানে ২০১৫ সালেই শেষ হয়ে গিয়েছিল ওয়ানডে ও টেস্ট কেরিয়ার। ২০১৬ তে শেষ হয় আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি ক্যারিয়ারও। এখনও আইপিএলে খেলা চালিয়ে যাচ্ছেন।
আদ্যোপান্ত ফ্যামিলি ম্যান ভাজ্জি বলিউড অভিনেত্রী গীতা বাসরার সঙ্গে পাকাপাকিভাবে ক্যারিয়ার শুরু করেন ২০১৫ সালে। আবার যেন সেই আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার শেষ ও ডমেস্টিক ক্যারিয়ারের শুরু। পুরস্কার হিসেবে পেয়েছে হিনায়া হীর প্লাহাকে। ২০০৩ সালে অর্জুন আর ২০০৯ সালে পায় পদ্মশ্রী।
হরভজন সিং এক লড়াইয়ের নাম। যে বারবার দলের বাইরে গিয়েও ফিরে এসেছে। কুম্বলের মতো মহান স্পিনার দলে থাকা সত্ত্বেও ভাজ্জির সাফল্য অবাক করার মতো। ভাজ্জি মানেই দলে ফুরফুরে হাওয়া, ভাজ্জি মানেই বিপক্ষের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে রক্তের বদলা নেওয়া। ভাজ্জি এক জোশের নাম, ভাজ্জি এক লড়াইয়ের নাম। সেজন্যই তো গাঙ্গুলি থেকে ধোনি ভাজ্জি হয়ে উঠেছিল বিশেষ সেনানী। আসলে তার ক্যারিয়ারের পেছনে সৌরভের অবদান তো কম নয়, ‘He made me a fearless spinner!’
বিপক্ষের কাছে কুঁকড়ে যাওয়া ভারতীয় দলের কাছে এরকম ফিয়ারলেস সেনার দরকার ছিল। ভারতবাসী সেই ফিয়ারলেস হরভজনকে চিরকাল মনে রাখবে যা পারফরমেন্সের সঙ্গে পারফরমেন্সের চেয়েও বেশিকিছু! আসলে পাঞ্জাব কা পুত্তার কবে যে সবার ঘরের ছেলে হয়ে গিয়েছিল কেউ বুঝতেই পারেনি।