দেশ শব্দটার পিছনে যে বিপণন লুকিয়ে আছে তা সবাই দেখতে পায় না। কেউ কেউ পায়। দেশ কী? মানুষ একটা দাগ কেটে দিল ছড়ানো ম্যাপের ওপর, তারপর? অমুক হল আমার দেশ, তমুক হল তাঁদের দেশ। কেউ কেউ পিঠে চাবুক মেরে বলেন – ‘দেশে থেকে বিদেশের জয় চাস?’ – একবার ভেবে দেখেছিলাম, কেন? একজন মানুষের স্বত:স্ফূর্ত আবেগ যে কক্ষপথে বয়, তা কি টেনে দেশের ম্যাপে ভরে দেওয়া যায়? চাবুক কি পাখির জন্য আলাদা ভিসার বন্দোবস্ত করতে পারে? সমর্থনই বা কেন আরোপিত হবে?
যে ম্যাচের ছবি, সেই ম্যাচে অতি বড় ভারতীয় সমর্থকও ভাবেন নি ভারত জিততে পারে, মাহির শট যখন পয়েন্টে জমা পড়ল তখন স্কোরবোর্ড দেখাচ্ছে পাঁচ উইকেট পড়ে গেছে; ছয়ের ওপর আস্কিং রেট। এরপর? আমরা জানতাম বেঁটেখাটো রায়না বাউন্সারে সাবলীল হতে পারেন না, মিশেল জনসন সেই অস্ত্রই প্রয়োগ করবেন। একটা উইকেট ৷ খেলা শেষ। কিন্তু তা হয়নি।
ঐ ম্যাচে এরপর যা ঘটেছিল তার সমস্ত বিন্দু জুড়লে আমি দেখতে পাই আমার দেশকে। যে স্বতঃস্ফূর্ত কান্না ভেতর থেকে উঠে আসে, সে কোনো আরোপিত দেশপ্রেমের পরোয়া করে না। ক্রিজ থেকে কিছুটা লাফিয়ে বাউন্সারে একটা সপাটে পুল করে দিলেন রায়না, পরের ওভারে পয়েন্টের পাশ দিয়ে যুবির স্কোয়্যার কাট যখন ছিটকে যাচ্ছে তখন কমেন্ট্রিবক্স থেকে ভেসে আসছে- ‘ইয়ে টুর্নামেন্ট ইনকা হ্যায়, ইয়ে ম্যাচ ইনকা হ্যায়, ইয়ে খেল ইনকা হ্যায় অউর ইয়ে শাম যুবি কা নাম…’
উত্তাল হয়ে ওঠে দর্শক। তবু নাছোড় ব্রেট লি। অজি দম্ভের প্রাচীর এত সহজে ভাঙে না। যদি না উল্টোদিকে তাঁর একশো পঁয়তাল্লিশের গোলাকে যে ভদ্রলোক লং অনের ওপর দিয়ে বাউন্ডারি পার করে দেন তাঁর নাম সুরেশ রায়না হয়। ওই শটের পর রায়নার মুখটা টিভিতে দেখিয়েছিল, থমথমে মুখে আচমকা যেন কেউ দিয়েছে রক্তের স্বাদ। চোখ ছলছলে, যুবির সাথে গ্লাভস পাঞ্চ করেই ফিরে যাচ্ছেন স্টাম্পে, ভেঙে-চুরে যাচ্ছে অজি ঔদ্ধত্যের দেয়াল। পারল তো!
নড়বড়ে রায়না ঐ যে চোয়ালে চাপ দিল, ঐ যে ‘এর দ্বারা হবে না’- গুলোকে বিস্ময় হাততালিতে পাল্টে দিল- ঐ টে কোনো এনিগমা, কোনো ম্যাজিক, কোনো অতি ক্রিকেটীয় মুহূর্ত যার ব্যখ্যা খুঁজতে ইচ্ছে করে না আজও। দশক ঘুরে গেলেও যা চিরন্তন!
দেশ শব্দটার পিছনে কত যে বিপণন লুকিয়ে! বিস্মিত হতে হয় রোজ। সেই নাভি থেকে উঠে আসা কান্নার জন্য আমাদেরও আজ একটা দেশ দরকার, যাকে জাপটে ধরে অনেক্ষণ কাঁদা যায়। বিভেদহীন একটা দেশ। কৈশোরের মত।
ক্রিজে যুবি ঐ যে তলোয়ারের মত ব্যাট চালালেন, কাঁদলেন, রক্ত ফক্ত নিয়ে কিছু একটা যেন হয়ে গেল, পেশাদারদের এতকিছু মানায় না; ক্রিকেট আর যাই হোক, জীবনের চেয়ে বড় তো নয়। বোকা আর জেদী লোকেদের সমস্যাই এই, ক্রিকেটীয় ব্যাখ্যা আর বিশ্লেষণের দাঁড়িপাল্লাও তাঁদের ধরতে পারে নি কোনোদিন, কিন্তু দেশ ধরেছিল তাঁদের, আগলেছিল, পিঠে হাত রেখেছিল।
প্রফেশনাল হতে হতে কেমন যেন শান্ত হয়ে গেল ক্রিকেট সমুদ্র, আর কি একটাও ঝড় উঠবে না কালী দা?