২০১০ বিশ্বকাপ: ম্যারাডোনার আনাড়িপনায় মেসিদের দীর্ঘশ্বাস

মেসির জীবনের সবচেয়ে ঐতিহাসিক ছবি কোনটি? অনেক দৃশ্যই আসতে পারে কিন্তু বিশ্বকাপের খুব কাছে থেকে অনন্ত আক্ষেপভরা চাহনিটাই হয়ে আছে তার জীবনের অন্যতম হাইলাইটস। শ্বেতচন্দনের রাজটীকার খুব কাছেই চলে এসেছিলেন ২০১৪ সালে। সেবার পারেননি, পারেননি আগের পরের তিনবারেও। 

বহু কারণে ব্রাজিলের আসরটা মানুষের মনে গেঁথে আছে। সীমানা পেরিয়ে লাখো আর্জেন্টাইন সেবার ব্রাজিলে ছুটে এসেছিলেন তাদের বিশ্বকাপ স্বপ্নের সারথিদের সমর্থন যোগাতে। দেখেছিলেন সেমিফাইনালে সার্জিও রোমেরোর বীরত্বগাঁথা, ফাইনালে গঞ্জালো হিগুয়াইনের কুখ্যাত সে মিস। রদ্রিগো প্যালাসিও কিংবা মেসির নিজেরই সুযোগ নষ্টের আক্ষেপে পুড়েছিলেন। শেষে হাপুস নয়নে কেঁদেছিলেন অতিরিক্ত সময়ে মারিও গোয়েৎজার একমাত্র গোলটায়।

কিন্তু অনেক ভাবে দেখলেই মেসির বাস্তবসম্মত ও সেরা সুযোগটা সেবার ছিলো না! সেটা এসেছিলো চার বছর আগে, ডিয়েগো ম্যারাডোনার অধীনে। ২০১৪-তে আলেহান্দ্রো সাবেয়ার দলটা ছিলো পোক্ত ও কার্যকরী একটা দল, যাকে তিলে তিলে তিন বছরে গড়েছিলেন তৎকালীন আর্জেন্টাইন কোচ। কিন্তু ২০১০ এ কোচ ম্যারাডোনার হাতে থাকা ‘বিকল্প’ গুলোর তুলনায় সে দলটা ছিলো নস্যি।

হোসে মরিনহোর অধীনে সে বছরই ট্রেবল জিতেছিলো ইন্টার মিলান। যার একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় ছিলেন আর্জেন্টাইন খেলোয়াড়রা। কমপক্ষে চারজন আর্জেন্টাইন ছিলেন দলটায়। মেসি আর কার্লোস তেভেজ চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জিতেছিলেন এর আগের দুই বছরে। বিশ্বকাপের পরের মৌসুমে সেবারের অধিনায়ক হ্যাভিয়ের মাসচেরানো যোগ দিয়েছিলেন মেসির সঙ্গে, দলটা আবারও হয়েছিলো ইউরোপসেরা।

হুগো তাকোল্লি আর হোসে প্যাকারম্যানের অধীনে অনূর্ধ্ব ২০ বিশ্বকাপ জেতা দলগুলো থেকে তিনজনকে দলে ডাকার বিলাসিতা ছিলো ম্যারাডোনার কাছে। সেবারের আর্জেন্টিনা দলটা নেহায়েতই দারুণ প্রতিভাধর একটা দল ছিলো না, ছিলো বয়সভিত্তিক পর্যায় থেকে একসঙ্গে খেলে মূল দলে আসা একটা গ্রুপও।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার, ২০০৮ সালে যখন দায়িত্বটা পেলেন ম্যারাডোনা, দলটার আক্রমণভাগ ছিলো তর্কসাপেক্ষে বিশ্বসেরা। মেসি আর হুয়ান রোমান রিকেলমের জুটিটা দারুণভাবে গড়ে উঠেছিলো। তারুণ্য আর অভিজ্ঞতার মিশেলে জিতেছিলেন দুই বছর আগের অলিম্পিক সোনাও।

তাদের সঙ্গে যখন দলে যোগ হতেন গ্যাব্রিয়েল হেইঞ্জ, মার্টিন দেমিচেলিস, হুয়ান সেবাস্তিয়ান ভেরনের মতো পরীক্ষিত পারফর্মাররা, আফ্রিকার আসরে শিরোপার বড় দাবিদার হওয়ার সব ধরণের রসদই চলে এসেছিলো কোচ ম্যারাডোনার হাতে।

বাছাইপর্বে তবুও ধুঁকছিলো আর্জেন্টিনা। সমালোচনা তখন অবধারিত। এর প্রেক্ষিতে সমালোচনা করা সাংবাদিকদেরকে জবাবটা সংবাদ সম্মেলনে দিতেন ম্যারাডোনা। আর্জেন্টিনার দায়িত্বে থাকাকালীন পুরোটা সময় ধরেই অবশ্য দিয়েছেন!

১৯৮৬ এর নায়ক যখন আলফিও বাসিলের কাছ থেকে পদটা নেন, তখন শীর্ষপর্যায়ে তার অভিজ্ঞতা ছিলো শূন্যের কোঠায়। বাছাইপর্বে ছয় ম্যাচের চারটিতে হারে আলবিসেলেস্তেরা, যেখানে ছিলো বলিভিয়ার মাঠে ৬-১ ব্যবধানের কুখ্যাত হারটাও। এর ফলে খাদের কিনারেই চলে গিয়েছিলেন মেসিরা। পেরুর বিপক্ষে বাছাইপর্বের শেষ ম্যাচে মার্টিন পালের্মোর গোলে সেবারের মতো লজ্জা এড়িয়েছিলো দলটা।

বিশ্বকাপের আগ পর্যন্ত ১০৮ জন খেলোয়াড় দলে ভিড়িয়েছিলেন তিনি। তবুও বিশ্বকাপের আগ পর্যন্ত ঠিক দলটা নির্বাচন করা দূরের বাতিঘর হয়েই ছিলো ম্যারাডোনার কাছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় এরিয়েল গার্সের কথা। হাইতির বিপক্ষে একটা ম্যাচ খেলেই জায়গা পেয়েছিলেন দলে। তবে ৩০ বছর বয়সি ফুটবলারের অনুকূলে একটা ব্যাপার ছিলো, ম্যারাডোনার স্বপ্ন! ১৯৮৬ বিশ্বকাপ সতীর্থ অস্কার রুগেরি এ ব্যাপারে বলেন, ‘সে আমাকে বলেছিলো যে, সে স্বপ্নে গার্সকে বিশ্বকাপ শিরোপা তুলতে দেখেছে।’ ব্যাপারটা সত্য ছিলো, নাকি রসিকতা সেটা আজও অজানা৷ তবে রুগেরির মন্তব্য আলোচনার জন্ম দিয়েছিলো বটে!

৩৬ বছর বয়সী পালের্মো ছিলেন দলে। সার্জিও রোমেরো, মারিয়ানো আন্দুহার আর ডিয়েগো পোজোর সম্মিলিতভাবে আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলার অভিজ্ঞতা ছিলো মোটে ১৩ ম্যাচের। এমন সব সিদ্ধান্ত ম্যারাডোনার ব্যর্থতার আভাস দিচ্ছিলো শুরুতেই।

শারীরিকভাবে দূর্বল-এ যুক্তিতে রিকেলমেকে দল থেকে তাড়ানো হলো। তার অনুপস্থিতি আর্জেন্টাইন দলে একটা গর্ত তৈরি করে দিয়েছিলো যা অন্তত সে বিশ্বকাপে পূরণ করা সম্ভব হয়নি। 

ম্যারাডোনার ঔদ্ধত্যপূর্ণ ও অবিমৃষ্যকারী সিদ্ধান্ত এখানেই শেষ হলেও বর্তে যেতো আর্জেন্টিনা। ইন্টার মিলানকে ট্রেবল জেতানোর অন্যতম কারিগর হ্যাভিয়ের জানেত্তি আর এস্তেবান ক্যাম্বিয়াসোকেও দলে ডাকেননি। এ নিয়ে কখনো ব্যাখ্যাও আসেনি ম্যারাডোনার তরফ থেকে। 

গুঞ্জন ছিলো, জানেত্তির ‘কুফা’ একটা ভাবমূর্তি ছিলো আর্জেন্টিনায়৷ অতিমাত্রায় কুসংস্কারাচ্ছন্ন ম্যারাডোনা যে ব্যাপারটা উপেক্ষা করতে পারেননি। তাদের সঙ্গে রিয়াল মাদ্রিদ মিডফিল্ডার ফার্নান্দো গাগোর দলে না থাকা আর্জেন্টিনাকে রক্ষণ আর মাঝমাঠে নিদারুন ভারসাম্যহীনতায় ফেলে দিয়েছিলো। 

এ সমস্যাগুলোর সমাধান মারিও বোলাত্তি, হোনাস গুতিয়েরেজ, ভেলেজ সার্সফিল্ড দের মতো অপরীক্ষিতদের দিয়ে করতে চেয়েছিলেন ম্যারাডোনা। কিন্তু দুধের সাধ কি আর ঘোলে মেটে?

সংবাদ সম্মেলনে ম্যারাডোনা যতোই রুদ্রমূর্তি ধারণ করুন না কেনো, কোচ হিসেবে ছিলেন অতি উদারবাদী। খাবার-দাবার কিংবা যৌন ক্রিয়াকলাপে কোনোপ্রকার বাঁধা ছিলো না তার দলে। এই রেসিপি শুরুতে দলকে ফল দিচ্ছিলো দারুন। নাইজেরিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া ও গ্রীসের মতো সহজ প্রতিপক্ষকে তুড়িতেই উড়য়ে দিয়েছিলো মেসি-তেভেজ-হিগুয়েইনদের আক্রমণভাগ। বেঞ্চে ছিলেন তরুন আগুয়েরো, ইন্টারের নায়ক দিয়েগো মিলিতোরা। আনহেল ডি মারিয়া, আর ভেরন কিংবা ম্যাক্সি রদ্রিগেজের একজন থাকতেন দুই ফ্ল্যাঙ্কে। মাঝমাঠের পুরোটা জুড়ে থাকার দায়িত্ব ছিলো মাসচেরানোর কাঁধে।

তেভেজ, হিগুয়েইনের নৈপুণ্যে শেষ ষোলতেও মেক্সিকোকে উড়িয়ে দেয় আলবিসেলেস্তেরা। ফলে ম্যারাডোনার ঔদ্ধত্যপূর্ণ মেজাজের স্থায়িত্ব বাড়ে আরও এক রাউন্ড।

কোয়ার্টার ফাইনালের আগে বলে বসলেন, ‘জার্মানিকে নিয়ে প্রচার করা বুল*টে বিশ্বাস করা চলবে না’। জোয়াকিম লোর দলটাও কোয়ার্টারে এসেছিলো দারুণ প্রতাপে। আগের ম্যাচেই ইংল্যান্ডকে ৪-১ গোলে উড়িয়ে আসা দলটা এ পর্যন্ত করেছিলো ১৩ গোল।

তরুণ থমাল মুলার, মেসুত ওজিল কিংবা অভিজ্ঞ লুকাস পোডলস্কি, মিরোস্লাভ ক্লোসাদের নিয়ে কোনো বাড়তি ভাবনাই ভাবেননি ম্যারাডোনা, এমনকি চোটের কারণে  রক্ষণের বড় ভরসা ওয়াল্টার স্যামুয়েলসকে গ্রুপ পর্বে হারানোর পরেও! 

মেক্সিকোর বিপক্ষে খেলা দলটাই জার্মান মেশিনের সামনে নামিয়ে দেয়া হয়, অন্যদিকে জার্মানরা প্রয়োজনমাফিক পরিবর্তন এনেছিলও দলে। মেক্সিকো ম্যাচের মতোই ওটামেন্ডি এদিন শুরু করেছিলেন রাইটব্যাক পজিশনে। তৃতীয় মিনিটেই থমাস মুলারের গোলে যার ‘অবদান’ ছিলো অনস্বীকার্য। পোডলস্কি ম্যাচের বাকিটা সময় রীতিমতো ছেলেখেলা করেছিলেন তাকে নিয়ে!

দ্বিতীয়ার্ধে দলটা যেভাবে আরও বিশৃঙ্খল হয়ে পড়েছিলো তাতে ৪-০ ব্যবধানের চূড়ান্ত ফলাফলটা কমই মনে হচ্ছিলো। আরও একবার শেষ আটে থামে আর্জেন্টিনার স্বপ্নযাত্রা, দুদিন বাদেই পদচ্যুত্য হন ম্যারাডোনা। আর বিশ্বকাপে অজেয় মনে হতে থাকা জার্মানদের যাত্রা থামে স্পেনের কাছে, আগের রাউন্ডে প্যারাগুয়ের কাছেই যারা হারের দ্বারপ্রান্তে ছিলো।

বাকিটা ইতিহাস। আন্দ্রেস ইনিয়েস্তা ডাচদের বিপক্ষে ফাইনালে করলেন অবিস্মরণীয় এক গোল, যাতে ভর করে প্রথম বিশ্বকাপটা ঘরে তোলে স্পেন। লা ফিউরিয়া রোহাদের যাত্রাটা জার্মানি কিংবা আর্জেন্টিনার মতো রোমাঞ্চ ছড়ায়নি, গোলোৎসব দেখেনি একটা ম্যাচেও। তবে নকআউট পর্বে চার ম্যাচে ১-০ গোলের জয় প্রমাণ করে বিশ্বকাপের সবচেয়ে নিখুঁত দলটা ছিলো স্পেনেরই।

আর্জেন্টিনার ক্ষেত্রে অপেক্ষাটা বেড়েছিলো আরও চার বছরের জন্যে, কিংবা বারো, বা তারও বেশি? কে জানে! এ উত্তর যেমন অজানা, তেমনি অজানা সে উত্তরটাও। কি হতো যদি ওটামেন্ডির জায়গায় চিরতরুণ জানেত্তি থাকতেন সেদিন, তৃতীয় মিনিটের গোলটা কি হজম করতো আলবিসেলেস্তেরা? কিংবা মাঝমাঠে ক্যাম্বিয়াসো যদি থাকতেন? তাহলে কি ‘শীর্ষ মানের’ দলের বিপক্ষে প্রথম দেখাতেই এভাবে ভেঙে পড়তো আর্জেন্টিনা? সম্ভবত, রিকেলমে থাকলে পুরোপুরি আক্রমণসর্বস্ব দল নামাতে হতো না সেদিন, যার ফলে রক্ষণ আর মাঝমাঠের আকার ঠিক রেখেই মাঠে নামার স্বাধীনতাটা পেতো ’৮৬ এর চ্যাম্পিয়নরা। 

২০১৪ কিংবা ২০১৮ এ যে মেসি বিশ্বকাপের মঞ্চে নেমেছেন তার থেকে সেবারের মেসি ছিলেন পুরোপুরি ভিন্ন। টানা ফাইনালে হারার বোঝাটা সেবার ছিলো না তার ঘাড়ে। রিকেলমে, আর ক্যাম্বিয়াসোর ক্যালিবার মিডফিল্ডে থাকলে হয়তো প্রতিযোগিতাটায় ঝড়ের বেগেই জিততেন, জেতাতে পারতেন মেসি!

ম্যারাডোনার বুনো ‘দূরদৃষ্টি’ আর কৌশলগত আনাড়িপনায় খেসারত দিয়ে সবচেয়ে প্রতিভাবান একটা প্রজন্ম থাকাসত্বেও খুব আগেই নিজেদের বিশ্বকাপ স্বপ্নের এপিটাফ দেখে আর্জেন্টিনা।

মেসি চার বছর পর শিরোপাটা থেকে এক কদম দূরত্বে ছিলেন। কিন্তু প্রতিভাগুলোকে ঠিকঠাক এক সুতোয় গাঁথতে পারলে ২০১০ বিশ্বকাপেই হয়তো বনে যেতেন বিশ্বসেরা। সেটা হয়ে গেলে এতদিনে ‘পেলে নাকি ম্যারাডোনা’ বিতর্কেও মেসিই টানতে পারতেন যবনিকা। হয়নি, তাই অনন্ত আক্ষেপই সঙ্গী মেসির। আর্জেন্টিনারও বৈকি?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link