১.
জানুয়ারি ২০১৯।
অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে তাদের মাটিতে খেলা চতুর্থ টেস্টে ১৯৩ করে আউট হয়েছিলেন তিনি। ২০১৮-১৯য়ের ওই সিরিজে ৪ টেস্টে মোট ৫২১ রান করেছিলেন তিনি। সেই সিরিজে অন্যদের পাশে রাখলে যা ছিল অলৌকিক পর্যায়ের। সেদিন প্রায় চারটে সেশন পুরো খেলা হয়ে গেছে তার। চেতেশ্বর পুজারা তখন অপরাজিত ১৮১। চতুর্থ টেস্টের দ্বিতীয় দিন। লাঞ্চের আগের শেষ বলটা করা বাকি।নতুন করে গার্ড নিলেন তিনি। টেস্ট ক্রিকেট দাবি করে ‘অন্যরকম’ ম্যাটেরিয়াল। এবং লোকটার অস্ত্রাগারে সেটা ভালোমতই ছিল সেদিন।
সম্ভ্রম কেউ ডেকে ডেকে এমনি এমনি দেয় না। অর্জন করতে হয়।ওই সিরিজ সবাইকে বাধ্য করেছিল ‘হ্যাটস অফ চেতেশ্বর পূজারা’ বলতে। সেই সিরিজে তিনি শুধু ব্যাট করে গিয়েছিলেন, ব্যাট করে গিয়েছিলেন আর ব্যাট করে গিয়েছিলেন।
২.
আগস্ট ২০২১।
২০২১ সালের ভারত-ইংল্যান্ড সিরিজের প্রথম দু’টি টেস্টের একটি ইনিংস ছাড়া সবকটাতে, তৃতীয় টেস্টেরও প্রথম ইনিংসে এবং তার আগেও বেশ কয়েকটি ইনিংসে শুধুই ব্যর্থতার নিকষ কালো রঙের অন্ধকার। ব্যাটে রাস্তার বন্ধ টিপকলের থেকে চুঁইয়ে পড়া জলের মত রানের কৃশকায় ধারা। এবং সেই তৃতীয় টেস্টে রাস্তা হারানো টিম খাদের কিনারে, সামনে ইনিংস হারের প্রবল হাতছানি। সঙ্গে নিজেরও নিশ্চিত বাদ পড়ে যাবার চূড়ান্ত বিপন্নতা সৃষ্টি হওয়া।
এই অবস্থায় ‘এশিয়ার বাইরে নিজের সেরা টেস্ট স্ট্রাইক রেট’ বের করে এনেছিলেন তিনি।
২০১৮-১৯ মৌসুমে সিরিজে চার টেস্টে মোট ৫২১ রান করে যেখানে শেষ করেছিলেন, উল্টো পথে হেঁটে সেদিন প্রায় সেখান থেকেই শুরু করাটাও ছিলেন তিনি। সেদিন দিনের শেষে ১৮০ বলে ১৫টি চমকপ্রদ বাউন্ডারি সহ ৯১ রানে অপরাজিত থেকে পরের দুদিন অধিনায়ক ও বাকি টিমকে নিয়ে মরণপণ লড়াইয়ের পূর্বাভাস রেখে যাওয়াটাও ছিলেন তিনি।
সেই নিশ্ছিদ্র সংকল্প, সেই অলৌকিক মন:সংযোগ, এর সঙ্গে সেদিন হিসেব করা আগ্রাসন মিশিয়ে দেওয়াটাও ছিলেন তিনি। সেদিন বিপক্ষ বোলারদের মরার আগে না মরার রানসর্বস্ব হুঁশিয়ারি দিয়ে রাখাটাও ছিলেন তিনিই। সেই টেস্টের ফল যাই হোক না কেন, দুটো জিনিস গ্যারান্টি দিয়ে বলা যেত সেদিনই।
এই পাল্টানো তিনি পরদিন সকালেই নতুন বলের বিরুদ্ধে ১০০ করলে নিয়ন্ত্রিত আগ্রাসনের সঙ্গে রক্ষণের মিশেলেই ২০০র দিকে পাড়ি দেবার চেষ্টাটা করবেনই, তবে অনুপ্রাণিত টিমকে সঙ্গে নিয়েই।
সেদিন তার অত্যাশ্চর্য মারকুটে ইনিংসটা আবার প্রমাণ করে দিয়ে গেছে যে, দেওয়ালে পিঠ ঠেকলে পাল্টা মার দেওয়াটাই সেরা অপশন।
পরদিন খেলা শুরু হবার মুখে নতুন করে গার্ড নিয়েছিলেন সেই ফুরিয়েও না ফুরনো, ব্যাট হাতে মারমুখী, পুরনোর মধ্যেও নতুন লোকটা, চেতেশ্বর পুজারা।
৩.
নভেম্বর ২০১৭।
২০১৭ সালের ১৬, ১৭, ১৮, ১৯ আর ২০ নভেম্বর, এই পাঁচদিনই শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে কলকাতা টেস্টে ব্যাট করেছিলেন পুজারা। এটি ছিল সিরিজের প্রথম টেস্ট এবং অত্যন্ত বৃষ্টিবিঘ্নিত। প্রথম দিনের শেষে ভারতের ১৭/৩ স্কোরে তিনি ৮ রানে অপরাজিত ছিলেন। দ্বিতীয় দিনের শেষে ভারতের ৭৪/৫ স্কোরে তিনি ৪৭ রানে অপরাজিত ছিলেন।
তৃতীয় দিন প্রথম ইনিংস শেষ করেছিল ভারত ১৭২ রানে আর পুজারা আউট হন ৫২ রানে। চতুর্থ দিনের একদম শেষে দ্বিতীয় ইনিংসে ব্যাট করতে এসে দুই রানে অপরাজিত ছিলেন তিনি, ভারত ছিল ১৭১/১-এ। পঞ্চম ও শেষ দিনে পুজারা ২২ রান করে আউট হন। তৃতীয় ভারতীয় ক্রিকেটার হিসেবে পুজারার টেস্টে পাঁচ দিনই কোন না কোন সময়ে ব্যাট করা কলকাতা টেস্টটি ড্র হয়েছিল শেষ পর্যন্ত।
৪.
জানুয়ারি ২০২২।
তিন বছর আগে এসব ভাবাই যেতনা।
ভারত বনাম দক্ষিণ আফ্রিকা টেস্ট সিরিজ, দক্ষিণ আফ্রিকার মাঠে। সেদিন ৩৯ বলে পাঁচটি চারসহ ২৭ রানে অপরাজিত তিনি। দিনের শেষ ওভারে বল করছেন কেশব মহারাজ। প্রথম তিনটি বলে কোন রান হয়নি।চেনা চিত্রনাট্য হল শেষ ৩টি বলেও কোন রান হবে না। একে তো অনেকেরই মতে জীবনের শেষ টেস্ট ইনিংস খেলতে নেমেছেন তিনি, তার উপর প্রথম ইনিংসেও ৩৩ বলে ৩ রান করে আউট হয়ে গেছেন তিনি।
এক অসম্ভব চাপ সামলে খেলতে হচ্ছে তাঁকে। এবং কেশব মহারাজের একটু শর্ট চতুর্থ বলটি সপাট স্কোয়ার কাটে তিনি পাঠিয়ে দিলেন কভার পয়েন্ট বাউন্ডারিতে। পৌঁছলেন ৪০ বলে ছয়টি চারসহ ৩১ রানে। পঞ্চম বল অফস্টাম্পের বাইরে, তিনি ছেড়ে দিলেন। এবার আসছে দিনের শেষ বল।
বলটা এল। অফের বাইরে আবার। তিন বছর আগের ভিন্টেজ তিনি হলে চোখ বুজে ছেড়ে দিতেন এই বলটা।কিন্তু সেদিন ছিল ‘অন্য দিন’। স্টিয়ার করলেন দিনের শেষ বলটাও, ডিফেন্সিভ মোডেই। স্লিপের বন্ধন এড়িয়ে সে বল মুক্তি পেল থার্ডম্যান বাউন্ডারিতে গিয়ে। ৪২ বলে ৭টি চারসহ ৩৫ রানে পৌঁছে অপরাজিত অবস্থায় দিন শেষ করলেন তিনি, চেতেশ্বর পূজারা।
তার টেস্ট ক্রিকেট জীবন আপাতত বিপন্মুক্ত কিনা, উত্তর অবশ্য পরদিন মেলেনি। কিন্তু সেদিন পাহাড়প্রমাণ চাপের মুখে যেভাবে তিনি ব্যাটে পাল্টা দিয়েছিলেন, সেটা দেখে তাকে নিয়েই আমার ঠিক তিন বছর আগের ২০১৮-১৯ মৌসুমের ভারত বনাম অস্ট্রেলিয়া চতুর্থ টেস্টের দ্বিতীয় দিন মনে পড়ে গিয়েছিল। সময় কি দ্রুত পাল্টায়!
৫.
২৫ জানুয়ারি ২০২২।
২০১০ থেকে আজ অবধি পুজারা ৯৫ টি টেস্ট খেলে তিনটি দ্বিশতরান সমেত ১৮ টি শতক আর ৩২ টি অর্ধশতক সহ ৪৩.৮৮ গড়ে ৬৭১৩ রান করেছেন, ৬৫টি ক্যাচ নেওয়া সমেত। ক্রিজে থাকাটা একদা যিনি অভ্যাসে পরিণত করে ফেলেছিলেন। যখন তিনি আউট হলেও মনে হত, তিনি আউট হচ্ছেন কিন্তু হারছেন না।
শেষ টেস্ট তিনি খেলে ফেলেছেন কিনা অথবা আরো পাঁচটি টেস্ট খেলে টেস্ট খেলার সেঞ্চুরি তিনি করতে পারবেন কিনা, উত্তর দেবে মহাকাল। আগামীতে যাই হোক, ভারতের টেস্ট ক্রিকেট নিয়ে আগামীতে লেখা কোন উপন্যাসে তাঁর জন্য বেশ ক’টি পাতা বরাদ্দ করতেই হবে।