মাস্টারের মাইলফলকের মঞ্চে বাঘের নৃত্য

বিকেল তখন পাঁচটা বেজে পাঁচ মিনিট! ঢাকার তপ্ত গরম। তবে সবকিছু ছাঁপিয়ে পুরো ক্রিকেট দুনিয়ার চোখ তখন টিভির পর্দায়। এশিয়া কাপে বাংলাদেশের বিপক্ষে তখন ৯৯ রানে অপরাজিত শচীন। আর একটি রান করলেই নাম তুলবেন অনন্য এক রেকর্ডে।

নিরানব্বইতম সেঞ্চুরিটা পেয়েছিলেন বছর খানেক আগে। শততম সেঞ্চুরির অনন্য মাইলফলকের পেছনে ছুঁটতে ছুঁটতে পেড়িয়ে গিয়েছে এক বসন্ত। অনেক প্রতিপক্ষের বিপক্ষে কাঙ্খিত সেই সেঞ্চুরির কাছাকাছি পৌঁছালেও পাননি শততম সেঞ্চুরি। লম্বা সময় সেঞ্চুরিহীন থাকার পর সেদিন এশিয়ার কাপের চতুর্থ ম্যাচে বাংলাদেশের বিপক্ষে আবারও সেঞ্চুরির দ্বারপ্রান্তে শচীন! মিরপুর স্টেডিয়ামে দর্শক তখন কানায় কানায় পূর্ণ।

সাকিব আল হাসানের বল লেগ সাইডে পুশ করেই দৌড়ে পূর্ণ করলেন নিজের শততম আন্তর্জাতিক সেঞ্চুরি! এক বসন্ত পেরবার পর প্রথম দেখা পেলেন সেই কাঙ্ক্ষিত সেঞ্চুরির। ইতিহাসের একমাত্র ক্রিকেটার হিসেবে করলেন সেঞ্চুরির সেঞ্চুরি।

 ক্রিকেট ইতিহাসের অন্যতম সেরা জয় তুলে নেয় বাংলাদেশ! শততম আন্তর্জাতিক সেঞ্চুরির দিনেও হার নিয়েই মাঠ ছাড়তে হয় শচীনকে।

১৬ মার্চ, ২০১২। এশিয়া কাপের চতুর্থ ম্যাচে ভারতের মুখোমুখি বাংলাদেশ। প্রথম ম্যাচে পাকিস্তানের বিপক্ষে হেরে ইতোমধ্যেই ব্যাকফুটে বাংলাদেশ। অপরদিকে, শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে জয়ে ফাইনালের দিকে এক পা ভারতের। টানা দুই জয়ে তখন ফাইনাল অনেকটাই নিশ্চিত পাকিস্তানের। ভারত বাংলাদেশকে হারালেই ভারত-পাকিস্তানের ফাইনাল!

এক বছর আগেই ২০১১ ওয়ানডে বিশ্বকাপ জেতা ভারত তখন অন্যতম পরাশক্তি। তাই ভারতের বিপক্ষে জয় পাওয়াটা তখন বাংলাদেশের জন্য এক স্বপ্নই বলা চলে। তবে সেই স্বপ্নকে ২৫ হাজারের বেশি দর্শকের সামনে সেদিন বাস্তবে রূপ দিয়েছিল সাকিব-তামিম-মুশফিকরা।

টসে হেরে ব্যাটিংয়ে নেমে শফিউলের বলে বোল্ড হয়ে দলীয় ২৫ রানেই শেষ গৌতম গম্ভীর। প্রাথমিক ধাক্কা সামলে দ্বিতীয়  উইকেটে বিরাট কোহলিকে নিয়ে ১৪৮ রানের জুটি গড়েন শচীন টেন্ডুলকার! তুলে নেন ব্যক্তিগত ফিফটিও। দ্বিতীয় উইকেট জুটিতেই শচীনের ব্যাট ইঙ্গিত দিচ্ছিল শততম সেঞ্চুরিটা আসছে বাংলাদেশের বিপক্ষেই। দলীয় ১৭৩ রানে ব্যক্তিগত ৬৬ রানে ফেরেন বিরাট কোহলি। শচীন তখন ধীরে ধীরে সেঞ্চুরির দিকে এগোচ্ছেন। শচীনের সঙ্গী তখন সুরেশ রায়না।

৪৪ তম ওভারের চতুর্থ বল। ৯৯ রানে অপরাজিত শচীন। সাকিবের করা মিডল স্টাম্পের উপর বল লেগ সাইডে পুশ করেই দৌড় দিলেন শচীন। নন স্ট্রাইক প্রান্তে পৌঁছেই পূর্ণ করলেন শততম আন্তর্জাতিক সেঞ্চুরির। প্রতিপক্ষ হলেও শচীনের সেঞ্চুরিতে পুরো স্টেডিয়াম জুড়েই দর্শকদের করতালি আর অভিবাদন। সেঞ্চুরির সেঞ্চুরি – এমন অবিশ্বাস্য, অকল্পনীয় কীর্তিটা যেন শচীনের জন্য নিতান্তই এক সাধারণ ব্যাপার।

দলীয় ৪৭ তম ওভারে মাশরাফি বিন মর্তুজা  পর পর দুই বলে আউট হন শচীন ও রায়না। শচীনের ১৪৭ বলে ১ ছক্কা ও ১২ চারে ১১৪ রানের ইনিংস ও রায়না ৩৮ বলে ৫১ রানের ঝড়ো ফিফটির পর মহেন্দ্র সিং ধোনির ১১ বলে ২১ রানে নির্ধারিত ৫০ ওভারে ৫ উইকেটে ২৮৯ রানের বড় সংগ্রহ দাঁড় করায় ভারত। বাংলাদেশের পক্ষে মাশরাফি নেন ২ উইকেট।

ঘরের মাটিতে প্রভীন কুমার, ইরফান পাঠান, রবিচন্দ্রন অশ্বিনদের বিপক্ষে এই রান তাড়া করাটা খুব একটা কঠিন ছিল না। কিন্তু প্রায়শই ব্যাটিং শিবির হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়ার পুরনো ইতিহাস তো আছেই। শক্তিশালী ভারতের বিপক্ষে এই জয় তুলে নিতে হলে সাকিব-তামিমদেরকে নিতে হবে গুরুদায়িত্ব!

জিততে হলে বাংলাদেশের ইতিহাসে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রান তাড়ার রেকর্ড গড়তে হবে! কিন্তু সেদিন যেন মিরপুরের তপ্ত গরমে ভিন্ন রকম এক শীতলতার আভাস পাওয়া যাচ্ছিল। শচীনের শততম সেঞ্চুরি ম্লান করে দিয়ে ঐতিহাসিক এক জয় তুলে নিতে পারবে কি বাংলাদেশ?

২৯০ রানের বিশাল লক্ষ্যমাত্রা তাড়া করতে নেমে দলীয় ১৫ রানে নাজিমউদ্দিনকে হারিয়ে শুরুতেই ধাঁক্কা খায় বাংলাদেশ। জহুরুল ইসলামকে নিয়ে দ্বিতীয় উইকেটে অবশ্য ঘুরে দাঁড়ান তামিম ইকবাল। দ্বিতীয় উইকেটে দু’জনে মিলে যোগ করেন ১১৩ রান। এই দু’জনের ব্যাটে তখন জয়ের স্বপ্ন দেখছে বাংলাদেশ।

দুই প্রান্তে দু’জনেই দেখা পেয়েছেন ব্যক্তিগত ফিফটির। এর পরই প্রভীন কুমার, রবীন্দ্র জাদেজার কাছে ধরা দিয়ে দ্রুতই প্রস্থান তামিম-জহুরুলের। তামিমের ৯৯ বলে ৭০ ও জহুরুলের ৫৩ রানে তখন ৩ উইকেটে ১৫৬ রান বাংলাদেশের।

শেষ ৮৫ বলে প্রয়োজন তখনো ১৩৪ রানের, হাতে ৭ উইকেট। ক্রিজে নাসির হোসেইন ও সাকিব আল হাসান। হঠাৎ মিরপুরে শুরু সাকিব ঝড়! ৩৬ ওভারে ১৬৬ থেকে সাকিবের ঝড়ো ব্যাটিংয়ে ৪১ ওভারে দলের রান ২১৮! ৫ ওভারের ব্যবধানে ৫৫ রান করে বাংলাদেশ। ম্যাচে তখন বাংলাদেশের আধিপত্য।

শেষ ৯ ওভারে বাংলাদেশের দরকার ৭২ রান, হাতে তখনো ৭ উইকেট। ৪২ ওভারে অশ্বিনের বলে স্টাম্পিং আউট সাকিব! ৩১ বলে ৫ চার ও ২ ছক্কায় ৪৯ রানের ঝড়ো ইনিংসের সমাপ্তি। যদিও এই আউট নিয়ে আলোচনা-সমালোচনার শেষ নেই। অনেকের মতেই বেনেফিট অব ডাউটে সাকিব নট আউট ছিলেন!

সাকিব ফেরার পর আবার রানে ভাঁটা পড়ে! ৪৭ ওভারে ৪ উইকেটে তখন ২৪৭ রান, ক্রিজে নাসির ও মুশফিক। শেষ ৩ ওভারে জয়ের জন্য দরকার ৩৩ রানের! তখন এক প্রকার অসম্ভবই মনে হচ্ছিল বাংলাদেশের জন্য। সেখান থেকে ১৬ বলে ৪৫! নাসির তখন পঞ্চাশ রানে অপরাজিত, মুশফিকের ব্যাটে বাউন্ডারি খরা। ম্যাচে বাংলাদেশের পরাজয় অনেকটাই নিশ্চিত। এর আগে এমন অবস্থান থেকে বাংলাদেশের জয়ের রেকর্ড নেই বললেই চলে।

এরপরই হঠাৎ মুশফিক ঝড়। ইরফান পাঠানের দুই বলে দুই ছক্কা! ঝিমিয়ে পড়া ম্যাচে হঠাৎ মিরপুরে দর্শকদের উল্লাস-হৈচৈ। মুশফিকের দুই ছক্কায় আবারও জয়ের আশায় বাংলাদেশ। ৪৮ তম ওভার থেকে আদায় করেন ১৭ রান। শেষ ২ ওভারে দরকার তখন মাত্র ১৬ রানের। ৪৯ তম ওভারের প্রথমেই নো বল সহ ৫ রানে বাংলাদেশকে জয়ের দিকে আরও একধাপ এগিয়ে দেন প্রবীন কুমার!

এরপর ওই ওভারের প্রথম লিগ্যাল ডেলিভারিতে লং অনের উপর দিয়ে চোখ জুড়ানো এক ছক্কা হাঁকিয়ে বাংলাদেশকে জয়ের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেন মুশফিক। মুশফিকের সেই ছক্কা বাংলাদেশের ড্রেসিং রুমে সাকিব-মাশরাফিদের বাঁধ ভাঙা উল্লাস। জয় থেকে তখন মাত্র এক পা পেছনে বাংলাদেশ।

১১ বলে দরকার মাত্র ৫ রানের। পরের তিন বলে আসে তিন রান। ৮ বলে দরকার মাত্র ২ রানের। ৪৯ তম ওভারের পঞ্চম বলে বাউন্ডারি হাঁকাতে গিয়ে ব্যক্তিগত ৫৪ রানে নাসির ফেরেন। বাংলাদেশের জয় ততক্ষণে প্রায় নিশ্চিত। শেষ ওভারে দরকার মাত্র ২ রানের! প্রথম বলে সিঙ্গেল নিয়ে ম্যাচে হার এড়ানো নিশ্চিত করেন মুশফিক। এরপর দ্বিতীয় বলে স্ট্রাইকে থাকা মাহমুদউল্লাহ রিয়াদের মিড অফে বাউন্ডারি হাঁকানোর মধ্যে দিয়ে এক ঐতিহাসিক জয়ের দেখা পায় বাংলাদেশ দল।

তামিম, সাকিব, নাসির, মুশফিকদের অনবদ্য ব্যাটিংয়ে ৪ বল বাকি থাকতে ৫ উইকেটের জয় পায় বাংলাদেশ। ২৫ বলে ৩ ছক্কা ও ৩ চারে ৪৬ রানের অপরাজিত ম্যাচ জয়ী ইনিংস খেলেন মুশফিক! মুশফিক-সাকিবদের তাণ্ডবের দিনে শততম সেঞ্চুরি ম্লান হয়ে যায় শচীনের।

অবশ্য ওই ম্যাচে হারের জন্য ভারতীয় বোলারদের চেয়ে বেশি সমালোচিত হয় শচীনের ধীর গতির ইনিংস। অনেকের মতে, শচীনের ইনিংসের কারণে ওই ম্যাচে আরো বড় স্কোর করতে পারেনি ভারত। পরে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে আরও এক দুর্দান্ত জয়ে নেট রান রেটে এগিয়ে থেকে ভার‍তকে টুর্নামেন্ট থেকে সরিয়ে দিয়ে প্রথমবারের মতো এশিয়া কাপের ফাইনালে পৌঁছে যায় বাংলাদেশ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link